 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 রূপন সরকার
                                            
                                                
                                                রূপন সরকার 
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        দীর্ঘ টানাপোড়েনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৪ সালে আলিপুরদুয়ার জেলার সূচনা ঘটে। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার কুমারগ্রাম, আলিপুরদুয়ার এক, আলিপুরদুয়ার দুই, কালচিনি, মাদারিহাট, ফালাকাটা, এই ছয়টি ব্লক নিয়ে এই জেলার ভৌগোলিক সীমা নির্ধারিত হয়, যার পূর্বে কুমারগ্রাম থেকে পশ্চিমে বীরপাড়া এবং উত্তরে লেপচাখা থেকে দক্ষিণে কোচবিহার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই জেলার ভৌগোলিক আয়তন ৩৩৮৩ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ১৫,৪০,০০০ জন নিয়ে গঠিত। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই জেলা বিশ্ববাসীর কাছে ডুয়ার্স নামে পরিচিত। জল, জঙ্গল, নদী বেষ্টিত, ভুটান পাহাড়ের পাদদেশ সংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থান বলেই নাকি নাম হয়েছে 'ডুয়ার্স'। 'ডোর' বা 'দরজা' থেকে 'ডুয়ার্স'। অর্থাৎ ভুটানের প্রবেশদ্বার। পান্ডববর্জিত ডুয়ার্সের প্রতি কোনওকালেই, কোনও শাসকই খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এতদঞ্চলে বসবাসকারি মানুষেরা অতীত হোক বা বর্তমানে দাঁতে দাঁত কামড়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। সেই জীবন সংগ্রাম থেকেই উঠে এসেছে নানান সাংস্কৃতিক ধারা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তথা জীবন শৈলী। ডুয়ার্সকে প্রকৃত অর্থেই নৃতত্ত্বের যাদুঘর বলা যায়। মেচ, রাভা, গারো, ড্রুকপা, রাজবংশীর মতো স্থানীয়দের পাশাপাশি কালের নিয়মে আদিবাসী, নেপালী, বাঙালি, হিন্দিবাসী, মারোয়াড়ী ইত্যাদি জাতি, জনজাতির মানুষ ডুয়ার্সের জনবিন্যাসকে বৈচিত্র্যময় যেমন করেছে, তেমনি সংঘাতের পরিবেশও তৈরি হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে এক সমন্বয়ের ধারা, এই তিমির তীর্থ সবুজ ভূমি অঞ্চলে। গড়ে উঠেছে নানা বর্ণময় সংস্কৃতি, জীবন জীবিকার উৎস।
প্রাক-ব্রিটিশ সময়কাল পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী ডুয়ার্সের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন ১৬শ শতকের কোচ রাজবংশ। এতৎসত্ত্বেও এই বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল মূল রাজনৈতিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্নই ছিল। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বারাই সর্বপ্রথম ডুয়ার্স পাদপ্রদীপের নিচে আসে। ব্রিটিশরাই প্রথম উপলব্ধি করেছিল ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার কথা। তাই ডুয়ার্সের অধিকাংশ অঞ্চল তথা রংপুরের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল নতুন প্রশাসনিক ইউনিট জলপাইগুড়ি জেলা। তখন থেকেই সেই অর্থে কিরাতভূমি ডুয়ার্সের কুমারীত্ব উন্মোচিত হয় এবং আধুনিক প্রশাসনের সূত্রপাত ঘটে।
এর আগে পর্যন্ত ডুয়ার্স ছিল শক্তিমানদের লুঠের জায়গা। কখনো মোঘল, কখনো ভুটান, কখনো স্থানীয় শক্তিমানদের দ্বারা। এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা সংস্কৃতিক ধারাকে সমৃদ্ধ, উন্নত অথবা মূলস্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা খুব কম হয়েছে অথবা আদৌ হয়েছে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জলপাইগুড়ি জেলা গঠন হলেও জেলার পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার বৃহৎ অঞ্চল প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চিত। অন্তঃসত্ত্বা মাকে বস্তায় ঝুলিয়ে কাঁধে করে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সদর হাসপাতালে আনতে হয় সন্তান প্রসবের জন্য। বহু জায়গায় পদব্রজে যোগাযোগ রক্ষা হয় এমনকি পানীয় জল থেকেও তারা বঞ্চিত। এই বঞ্চনা বা অপ্রাপ্তি থেকেই এতদঞ্চলের মানুষের মধ্যে জেলা গঠনের দাবি ওঠে।

আলিপুরদুয়ার জেলা গঠিত হলেও জেলাবাসীর আর্থ-সামাজিক তথা শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্রগতি বা প্রগতি কতখানি হয়েছে জেলা গঠনের আজ এক দশক পরে তা মূল্যায়ন করা যেতেই পারে। এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, জেলা গঠন মানে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। সেই দিক থেকে বেশ কিছু প্রশাসনিক ইউনিট আলিপুরদুয়ার জেলাবাসীর কাছে উন্মুক্ত হয়েছে, যার সরাসরি সুবিধে জেলাবাসী লাভ করেছে। জেলা ভাগের আগে যে প্রশাসনিক পরিষেবা গ্রহণ করতে আলিপুরদুয়ারবাসীকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে তৎকালীন জেলা সদর জলপাইগুড়িতে আসতে হতো, সেই জীবন যন্ত্রনা থেকে জেলাবাসী মুক্তি লাভ করেছে। ডুয়ার্স কন্যা নামে আলিপুরদুয়ারে নতুন জেলার প্রশাসনিক ভবন তৈরি হয়েছে। অবয়বের দিক থেকে সেটি একটি দর্শনীয় স্থান বটে। জেলা সদরের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে, অন্তত পরিকাঠামোর দিক থেকে। জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদকে ভেঙে আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে গ্রামীণ প্রশাসনের স্বার্থে। বিভিন্ন শিক্ষা দপ্তর, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ সবেতেই প্রশাসনিক দূরত্ব কমে যাওয়ার সরাসরি লাভ জেলাবাসী পক্ষে গিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ অবশ্যই প্রশসংসার দাবি রাখে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের ফলে কালচিনি ব্লকের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাসরা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি, পানা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
তবে কিছু অপরিকল্পিত পরিকাঠামো তৈরিতে প্রশাসনিক উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। যেমন নিউ হাসিমারা থেকে নিমতি চৌপথি যাওয়ার রাস্তায় পান্ডববর্জিত এলাকায় কৃষক বাজার তৈরির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আবার আলিপুরদুয়ার জেলার ভৌগোলিক অবস্থান যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে জেলার দক্ষিণাংশ অর্থাৎ ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার-২ এবং কুমারগ্রাম ব্লক হল কৃষি অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে কালচিনি, মাদারিহাট ও আলিপুরদুয়ার-১ এ রয়েছে টি-টিম্বার-ট্যুরিজম কেন্দ্রিক অর্থনীতি। সেক্ষেত্রে জেলা ভাগের পর কৃষি অর্থনীতি কেন্দ্রিক ব্লক আলিপুরদুয়ার-দুই থেকে কোনও এক অজানা কারণে কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার টি-টিম্বার-ট্যুরিজম কেন্দ্রিক ব্লক বীরপাড়াতে নিয়ে যাওয়ার ফলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সংক্রান্ত খরচ বেড়ে গেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে খাদ্যশস্যের স্বাভাবিক দামের উপর।
জেলা গঠনের ফলে আলিপুরদুয়ার নতুন সিএমওএইচ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, ব্লক বা গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাস্তবিকপক্ষে কোনও উন্নতি হয় নি। এমনকী ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তার তো দূরের কথা, রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনারদের দিয়ে কোনওরকমে গ্রামীন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সচল রাখা হয়েছে। জেলার একপ্রান্ত রাজাভাতখাওয়া, জয়ন্তি, লেপচাখা সহ এতদঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে গেলে আজও ২০-৩০-৪০ কিলোমিটার সমতল ও পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে জেলা সদরে আসতে হয়। যানবাহন বলতে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বাইক বা কখনো ব্যক্তিগত বাহন। পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই জেলা সদর হাসপাতালেও ।
জেলাবাসীদের অভিযোগ, পরিবহণ ব্যবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। জেলা সদর থেকে প্রান্তিক কুমারগ্রামে হাতে গোনা সরকারি ও বেসরকারি বাস। জেলার আরেক প্রান্ত জয়ন্তিতে একটি মাত্র সরকারি বাস। জয়গা, বীরপাড়া, ফালাকাটা অঞ্চলেও চলাচল করে হাতে গোনা কয়েকটি বাস। কালচিনি থেকে সেন্ট্রাল ডুয়ার্স, রাঙামাটি পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪-১৬ কিলোমিটার রাস্তায় কোনও গণ পরিবহণ নেই, নেই কোনও শিক্ষা তথা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। জেলার ভৌগোলিক পরিসরে দৈনন্দিন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেল পরিষেবা কোন কার্যকর ভূমিকায় নেই। গণপরিবহন নামমাত্র। তবে হ্যাঁ, জাতীয় বা রাজ্য সড়কগুলি পূর্বের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে উন্নতি হয়েছে। এই সময়কালে জাতীয় সড়কের পাশে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে, তার পরিবর্তে প্রায় কোনও বৃক্ষরোপণই হয় নি।
জেলা গঠনের ফলে আইনি পেশার প্রসার হলেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্যতম অঙ্গ সরকারি চাকুরি যা পূর্বের তুলনায় ক্রমহ্রাসমান। কৃষির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে নি। বরং চাকরি না হওয়া, সরকারি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়িক লেনদেন কমে গিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়নি বলেই পুরাতন শহরগুলির প্রসার ঘটেনি, কোন নতুন শহর গড়ে ওঠে নি। জনপদগুলিতে যেটুকু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত কারণে বলা যেতে পারে।
জেলার সম্পদ টি, টিম্বার, ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে কোনও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। টিম্বার অর্থাৎ জেলার বনাঞ্চল আজ অসুরক্ষিত। বন বিভাগে কমবেশি ৭০% কর্মী নিয়োগ কমিয়ে আনা হয়েছে। নতুন প্ল্যান্টেশানের টাকা বরাদ্দ হচ্ছে না। শুধু যত্রতত্র অপরিকল্পিত বনবাংলো তৈরি করে জেলার বনাঞ্চলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পর্যটনের কোনো ইমেজ বিল্ডিং করা হয় নি। বরং পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন ব-কলমে লুটের জায়গা হয়েছে। যদি রাজাভাতখাওয়া-জয়ন্তিক-বক্সা অঞ্চলই ধরি তাহলে দেখবো প্রথমে রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তি প্রবেশের জন্য টাকা, বক্সা যেতে গেলে সান্তালাবাড়ি থেকে আবার টিকিট কাটা, ট্যুর গাইড নেওয়া, সাফারির টাকা অর্থাৎ একজন পর্যটক আর্থিকভাবে ভালো রকমের সচ্ছল না হলে তার ডুয়ার্স ঘোরা স্বপ্নেই থেকে যাবে। একারণে বর্তমানে অনেকে ডুয়ার্স থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অথচ পর্যটনকে কেন্দ্র করে ডুয়ার্সের তথা জেলার অর্থনীতি নতুন মাত্রা পেতে পারত।

জেলা গঠনে জেলাবাসীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক উন্নয়নও চোখে পড়ে কই? বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম মাধ্যম ক্লাব সংস্কৃতির অবনমন চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাক্ষেত্রে আলিপুরদুয়ার কলেজকে আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করা হলেও তার পরিকাঠামোগত উন্নতি কোথায়? বরং ঐতিহ্যবাহী আলিপুরদুয়ার কলেজের অস্তিত্ব বিপন্ন। এছাড়া জেলায় নতুন কোন কলেজ তৈরি হয়নি, নতুন কোনও স্কুল স্থাপিত হয় নি, একটি-দুটি স্কুলে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে মাত্র। উল্টে পুরনো প্রতিষ্ঠিত সরকারি স্কুলগুলি আজ তার পূর্বের গরিমা হারাতে বসেছে বলেই শোনা যায়।
জেলা গঠিত হওয়ার পর দশ বছরে পা দিয়ে প্রশাসনিক ও আইনি কাজে দূরত্ব কমা এবং কিছু ব্রিজ-রাস্তা-ঘাট তৈরি হওয়া ছাড়া আর কোথায় কী উন্নয়ন চোখে পড়েছে সেই প্রশ্ন যদি প্রতিটি আলিপুরদুয়ার জেলাবাসীকে করা যায় তবেই বেরিয়ে আসতে পারে প্রকৃত ছবিটি। কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন হল, সেই প্রশ্নের উত্তর কি জেলার কর্তাব্যক্তিদের কাছেও আছে?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
