আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে আদৌ নির্বাচন হবে, না নির্বাচনের নামে শাসকদলের মুখগুলি সেই কুবের ভান্ডার দখলের সাংবিধানিক অধিকার পকেটে পুরবে সেই অভিযোগ বা আশঙ্কার কথা রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতার জন্য তোলা থাক। তবে এই নির্বাচনের ঘোষণা দার্জিলিঙ পাহাড়কে আবার সেই তপ্ত দার্জিলিঙে ফিরিয়ে আনার একটা সম্ভাবনার ছবি আঁকতে চলেছে তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
তৃণমূল ও তার বসিয়ে দেওয়া অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার বিরুদ্ধে পাহাড়ের বিরোধী দল বিমল গুরুঙ-এর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, অজয় এডোয়ার্ডের হামরো পার্টি, সিপিআরএম, জিএনএলএফ একত্রে নির্বাচনে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য এই মোর্চার পেছনের মূল চাবিকাঠি বিজেপি-র।
বিষয়টা নির্বাচনের জোট বা জয় পরাজয় নয়। বিষয়টা এই যে পাহাড়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক রোদ-বৃষ্টি-ছায়ার এই চক্রবৎ আবর্তিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে। আসলে এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। আজ অবধি কেউই তো পাহাড়ের মূল সমস্যার উৎসকে সমাধানের কথাটাকেই সামনে আনছেন না। হয় তারা তা জানেন না, নয়ত জেনেও না জানার ভান করে তাকে জীইয়ে রেখে সেই কুৎসিত ভোট মৃগয়ার টোপ হিসাবে ব্যবহার করার লোভনীয় উপায় বলে ধরে নেন।
এটা যেন সেই হিন্দু বনাম মুসলমান-এর সেই সম্পর্কের সমস্যা। একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান গান গেয়ে জলসায় হাততালি পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক পাঁক ঘেটে তার থেকে সাম্প্রদায়িক বিষ্ঠা ছড়াতে এই দুই সম্প্রদায়ের বিভাজনের বিভেদকে কৃত্রিম উপায়ে টিকিয়ে রাখতে হয়। দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকার সমস্যাটা যে নিছক অর্থনৈতিক বৈষম্যের নয়,অথবা উন্নয়নের প্রশ্ন নয়, এটা যে একটা জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার মতো একটা বিশ্বজনীন সমস্যার সমাধানের পথ অনুসন্ধানের সমস্যা সেটা ভাবাই হচ্ছে না। ধরেই নেওয়া হচ্ছে এই সমস্যা যেন কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিনেতৃত্ব নির্ভর।
দার্জিলিঙ পাহাড় তো দূরের কথা, এর পাদদেশের এক বিশাল সমতলভূমিও মূল ভারতীয় ভূখন্ড বলতে যা বোঝাত তার অংশ ছিল না। এটা মেনে নিয়েই এই সমস্যার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। ১৮৩৫ সালে এক বিতর্কিত দানপত্রের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিকিম রাজার কাছ থেকে যে দার্জিলিঙ পাহাড়কে তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল সেটাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে অস্ত্রের জোরে আয়তন বৃদ্ধি করে আজকের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এই দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চল। সে সময় এর আনুমানিক লোক সংখ্যা ছিল একশরও কম।
কোনও জায়গা অথবা দেশ যখন তার নুতন পরিচয় নিয়ে রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা নেয় তখন প্রায় সেই জনশূন্য এলাকায় তাকে গড়ার জন্য বাইরে থেকে লোক এনে বসতি স্থাপন করতে হয়। তাদের রক্ত ঘামে সেই জায়গায় গড়ে ওঠে জনবসতি। সৃষ্টি হয় সম্পদ। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। যেমন শ্রীলঙ্কার চা সম্পদ গড়তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তামিলদের। এখন তাদের বিদেশি বললে তারা তা মানবে কেন? তবে তাই বলে তারা শ্রীলঙ্কা থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে সেই দাবি মানাও মুশকিল। পৃথক জেলা বা একটা স্বশাসিত কেন্দ্রের অন্তর্গত একটা অঞ্চলের দাবি তো মানা যেতে পারে।
দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকাকে বসতির উপযোগী করতে ও চা সাম্রাজ্য সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য আনা হয়েছিল নেপাল থেকে শ্রমিকদের। তখন সেখানে বাঙলা ভাষীদের কোনও উপস্থিতি ছিল না। আজকের উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলিগুড়ির যে কয়েকশ বসতি ছিল সেখানেও বাঙলা ভাষীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কথাটা উঠল কারণ মাঝে মাঝেই উগ্র বাঙালি জাত্যভিমানের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বলা হয় নেপালী ভাষীরা বিদেশী। সেই অর্থে তাহলে তো বাঙালিকে বলতে হয় বিদেশী। এখানকার সিংহভাগ বাঙালির আগমন ঘটেছে স্বাধীনতার পর।
পাহাড়ের অস্থিরতার এই কম্পন পাহাড়ি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার কম্পন। এই দাবি প্রথমে উঠেছিল ১৯০৭ সালে হিল ম্যান অ্যাসোসিয়েশনের নামে। এরপর একই দাবি নিয়ে ১৯১৭, ১৯২৯, ১৯৩৪, এবং ১৯৪৩ সালে দাবি পত্র পেশ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর আবার ১৯৫২, ১৯৫৫, ১৯৮১ এবং ২০০৭ সালে যে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি ওঠে আসলে তা বাঘের পিঠে বসে একেক সময় একেক প্রেক্ষাপটকে হাতিয়ার করে পাহাড়ি জাতিসত্তার ভাবাবেগকে জাগিয়ে তুলে পাহাড়ের মানুষের হৃদয় দখল করবার প্রচেষ্টা। সেই দাবি বাঘের পিঠ থেকে নেমে যখনই প্রশাসনিক শক্তির ছাতার তলে নিরাপত্তার আশ্রয় খুঁজতে গেছে তখনই সেই জাতিসত্বার আবেগের বাঘ তাকে উদরস্থ করেছে।
বিগত এই ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অনেক কিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। হিটলারের পরাজয় ঘটেছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিশ্বাস্য অবলুপ্তি ঘটেছে। ৪২এর সেই রাখী বন্ধনে বাংলার ঐক্যের সংকল্পের মৃত্যু ঘটিয়ে সোনার বাংলার বিভাজন ঘটেছে। অথচ গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি সেই জায়গাতেই স্থির হয়ে আছ। শুধু মাঝে মধ্যে এই দাবি আদায়ের আন্দোলনের ব্যাটন এক হাত থেকে আরেক হাতে, এক সুযোগ সন্ধানীর হাত থেকে আরেক সুযোগ সন্ধানীর হাতে হস্তান্তর হয়েছে।
মনে রাখা দরকার এই জাতিসত্তার দাবি ও ভাবাবেগ কোনও এক সুবাস ঘিসিঙ বা বিমল গুরুঙ বা কোনও অনীত থাপা বা অজয় এডওয়ার্ড-এর উপর নির্ভর করে না। এরা কিন্ত সবাই দার্জিলিঙ পাহাড়ের রাজনৈতিক মঞ্চে এসেছেন একটাই আওয়াজ নিয়ে-- সবাই গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করেন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা এই রাজনৈতিক অভিযানে উপস্থিত হয়েছেন। এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের ছাতার তলে দার্জিলিঙ পাহাড়ের ক্ষমতায় আসীন প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার অনীত থাপা স্বয়ং ঘোষণা করেছেন তিনিও গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবিকে সমর্থন করেন। যেখানে তার রক্ষা তথা সৃষ্টি কর্তা তৃণমূল কংগ্রেস গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবিকে জীবন দিয়ে বিরোধিতা করার কথা ঘোষণা করেছে সেখানে অনীত থাপা কীভাবে সর্বোচ্চ নেত্রীর সমর্থন না থাকলে এমন ঘোষণা করতে পারেন? আসলে তৃণমূল নেতৃত্বও জানেন গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবির বিরোধিতা করলে পাহাড়ে টিকে থাকা যাবে না। বাঙালি পার্টি তৃণমূল দল তো পাহাড়কে রাজ্য থেকে পৃথক করার দাবি করে সমতলের বাঙালি ভাবাবেগকে আঘাত করার ঝুঁকি নিতে পারে না, অথচ পাহাড়ের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাতে রাখতে হবে।
আগে কলকাতার ময়দানে যখন ফুটবলের রমরমা অবস্থা তখন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ক্লাব গুলি তাদের ডামি টিম গঠন করত। যাতে প্রয়োজনে লীগ টেবিলের নম্বরে হেরফের করার ক্ষেত্রে এদের ব্যবহার করা যায়। পাহাড়ের রাজনৈতিক ময়দানের অনীত থাপাদের দলের ভূমিকা যে তাই তার প্রমাণ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার জোট সঙ্গি তৃণমূল রাজ্য সরকারে প্রবল প্রতাপে অবস্থান করলেও তারা এই নির্বাচনে মাত্র পাঁচ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ৯৫ শতাংশ আসনে প্রার্থী দেবে অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা।
অন্যদিকে বিজেপি সর্বভারতীয় দল। তারা রাজনৈতিক ভাবে ছোট রাজ্য গঠনের পক্ষে। কিন্তু এই রাজ্যের বিধানসভার আসন ২৯৪। পাহাড়ী মানুষের প্রভাব পাহাড়ের তিনটি আসন ছাড়া আর সমতলে খুব বেশি হলে আরও ৩-৪টি আসনে নেপালী ভাষীরা নির্ণায়ক হতে পারে। বিজেপি এই ৭টি আসনের জন্য সমতলের বাকি ২৮৭ টি আসনে বাঙালি ভাবাবেগকে অস্বীকার করতে পারছে না। অথচ লোকসভার নির্বাচনে দার্জিলিঙ আসনটি অত্যন্ত মূল্যবান। তাই তাদের সাংসদ রাজু বিস্তা এই তৃণমূল বিরোধী জোটের পক্ষে এমন সক্রিয় ভূমিকা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিজেপির কাছে দার্জিলিঙ পঞ্চায়েত নির্বাচনের জেতা খুব জরুরি হয়ত নয়, তবে এই নির্বাচনের জোট সিঁড়ি বেয়ে আগামী লোকসভার আসনটি ধরে রাখা তাদের মূল উদ্দেশ্য।
উত্তরবঙ্গ জুড়ে গঙ্গার ওপারের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে একটা মানসিকতা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতারা মাঝে মধ্যেই যে উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠনের দাবি তোলেন সেটা এই মানসিকতার আঁচটাকে টের পেয়েই করেন। মুশকিল হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২০শতাংশ উত্তরবঙ্গের। তাই বাকি ৮০শতাংশ বাঙালির ভোট ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে দক্ষিণবঙ্গের বিজেপি নেতারা এর বিরোধিতা করেন।
বিমল গুরুঙ যে মাঝে মধ্যে বিজেপি বিরোধী বিবৃতি দেন তার কারণ তার বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার অনেকগুলি জামিন অযোগ্য ধারায় ফৌজদারি মামলা করে রেখেছেন। আবার শত চেষ্টা করেও যে রাজ্য সরকার তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি তার কারণ সে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তা বলয়ের আশ্রয়ে ছিল। এই শূন্য স্থান পূর্ণ করতে দার্জিলিঙ এর এক বিশাল ধনী ব্যবসায়ী অজয় এডওয়ার্ড তার হামরো পার্টিকে এই গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসেছিল। রাজ্য সরকারের আশঙ্কা ছিল অজয় বিমল গুরুঙ-এর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। তাই রাতারাতি তার বেশ কিছু কাউন্সিলরকে তার দল থেকে ভাঙ্গিয়ে অনীতের দলে এনে দার্জিলিঙ পুর প্রশাসন দখল করে নেওয়া হল। অজয়ের অভিযোগ প্রচুর অর্থের বিনিময়ে এদের কেনা হয়েছে।
অজয় এডওয়ার্ড ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যবসার স্বার্থেই তিনি কিন্তু খুব একটা রাজ্য সরকার বিরোধী ভূমিকা নেন নি। কিন্ত তৃণমূল নেতৃত্ব তার সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী মানসিকতায় তাড়াহুড়ো করে সমতলের দল ভাঙানোর খেলা পাহাড়ে খেলতে গিয়ে অজয়কে সম্পূর্ণভাবে বিরোধী মঞ্চে ঠেলে দিল। সুবাস ঘিসিঙ-এর জিএনএলএফ বিমল গুরুংকে নিয়ে একটা অভিমান জনিত মানসিকতায় ভুগছিল। এখানে বিজেপির রাজু বিস্তা একটা সেতু বন্ধনের ভূমিকা পালন করছেন। রাজু কিন্ত প্রতিদিন যেন রাজনৈতিক দাবার পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠছেন বলতেই হয়। তৃণমূল বিরোধী এই জোট গঠনে তিনি পেছনে থেকে যথেষ্ট সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছেন বলে মনে হয়।
এই নির্বাচনেও মূল সুর যে থাকবে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি এতে কোনও সন্দেহ নেই। অনীতরা যদিও বলার চেষ্টা করছেন তারাও এই রাজ্য গঠনের দাবির বিরোধী নয় কিন্ত তৃণমূলের ছাতার তলে তাদের এই দাবি সাধারণ পাহাড়বাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। তাদের একমাত্র আশা সরকারের সেই ডিভাইড এন্ড রুল নীতির কোনও সুবিধা তারা নিতে পারে কিনা। তবে এখানেও কিন্তু বিপরীত ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ এই সব নানা উন্নয়ন পর্ষদের নামে পদে থাকার কিছু সুবিধা হয়ত কয়েকজন পাচ্ছে কিন্ত সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই না পাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি থাকায় তারা হয়ে উঠেছে আরো ক্ষুব্ধ। এই নির্বাচনে যদি এই বিরোধী জোট ভাল ফল করে তবে পাহাড়ের রাজনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা অশনি সংকেত হতে পারে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team