মহাকবি বাল্মিকী তাঁর সুবিশাল মহাকাব্যে অসংখ্য চরিত্রের অবতারণা করলেও একটি দুইটি চরিত্রকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে স্বাভাবিকভাবেই অন্য চরিত্রগুলো তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। রামায়ণ তাই রামের জয়গান হবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তবু কিছু চরিত্রের ওপর আরও একটু আলো ফেললে হয়ত পাঠকের খিদে মিটত।
রামায়ণের আদিপর্বে চার ভাই রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নর গল্প। দশরথ ও তাঁর তিন স্ত্রী কৌশল্যা, সুমিত্রা ও কৈকেয়ী, তাঁদের সন্তানের জন্ম, তাঁদের শিক্ষা, বিবাহ ও অবশেষে কৈকেয়ীর ইচ্ছেয় রামের বনবাস। রাম ও সীতার বিয়ের পরই খানিকটা যেন গল্পের সুতো বেশি ছাড়ার আগেই গুটিয়ে ফেলার তাড়া ছিল মহাকবির। তাই যেন অবশ্যম্ভাবীভাবেই সীতার বোনেদের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রামের অন্যান্য ভাইদের। অযথা পাত্রী খোঁজা, কিম্বা নতুন কোনো স্বয়ংবর সভার প্রয়োজনই পড়ল না।
এরপর সীতার অযোধ্যায় প্রবেশ। আজও চোখ বুজলে সাদা কালো টেলিভিশনে দেখা সেই বিখ্যাত রামায়ণের দৃশ্যটাই ভেসে ওঠে। রাম সীতা জাঁকজমক প্রবেশের সময় তাঁদের পেছন পেছন গৃহ প্রবেশ করছেন লক্ষ্মণ-ঊর্মিলা, ভরত-মান্ডবী এবং শত্রুঘ্ন-শ্রুতকীর্তি কিছুটা উপেক্ষিত, কিছুটা রাম সীতার বিপুলায়তন ঐশ্বরিক ছায়ায় ঢাকা।
রামের বনবাসের সময় ভরতকে সকলেই সন্দেহের চোখে দেখে। রামের মনেও যে সন্দেহের বীজ ঢুকেছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমন পরিস্থিতিতে মান্ডবীর প্রতি মনোভাব কেমন ছিল সবার? কী করেছিলেন মান্ডবী? নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু কি বলেছিলেন? মহাকবি তো বটেই তাঁর উত্তরসূরিরাও এর কোনো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেননি। রামের বনবাস এক অর্থে ভরতেরও বনবাস। তিনি অযোধ্যা থেকে বেরিয়ে নন্দীগ্রামে অগ্রজের পাদুকা নিয়ে রাজত্ব চালাতে লাগলেন। সেখানেও কি স্থান হল মান্ডবীর? না, তিনি শাশুড়িমায়েদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। আর সেভাবে মান্ডবীকে রামায়ণ জুড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কি কম দুঃখের যেখানে রানী হওয়ার জন্য তাঁর সব রাস্তাই খোলা ছিল (কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রে)? একবারও কি মান্ডবীর মনে রাজরাণী হওয়ার সাধ জাগেনি। মহাকাব্যে উত্তর নেই এরও!
এবার দেখা যাক মহাকাব্যে মান্ডবীর উল্লেখ কতটুকু আছে। কৃত্তিবাস আদি পর্বে লিখেছেন যখন রাম জানান, চার ভাইয়ের একসঙ্গে বিয়ে না হলে তিনি সীতাকে গ্রহণ করবেন না, তখন পুরোহিত শতানন্দ জনককে বলেন, "তোমার কনিষ্ঠ ভাই, কুশধ্বজ নাম। / তাঁর দুই কন্যা আছে রূপগুণ - ধাম।।" এই সময় আমরা প্রথম মান্ডবীর উপস্থিতি টের পাই। এরপর রাম সীতার বিয়ের বর্ণনার শেষের দিকে খানিকটা যেন জোর করেই কবিকে জানাতে হয়,
"ঊর্মিলা সহিত তথা রহেন লক্ষ্মণ।
মান্ডবীর সহিত ভরত বিচক্ষণ।।
শ্রুতকীর্তি সহিত আছেন শত্রুঘন।
এইরূপে বাসর বঞ্চিল চারিজন।।"
এইভাবেই রাম সীতার বিয়ের মাঝে আরও তিনটি রাজকুমার ও রাজকুমারীর বিয়ে হয়ে গেল। অথচ পাঠকের চোখে, মনে তা তেমনভাবে কোনো আলোড়ন তুলল না। বিয়ের ঠিক পরপরই ভরত তাঁর মাতুল যুধাজিৎ-এর সঙ্গে মাতুলালয়ে চলে গেলেন শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে। অথচ তাঁদের সদ্য পরিণীতা স্ত্রীদের কী হল, তাঁরা কোথায় গেলেন, তাঁদের মনের অবস্থার খবর কেউ পেল না।
মান্ডবী ছিলেন জনকের ভাই কুশধ্বজ ও রানী চন্দ্রভাগার বড় মেয়ে। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান সপ্তরী জেলার রাজবিরাজ অঞ্চলে। যথেষ্ঠ সুন্দরী ছিলেন ভরত পত্নী। তবু তাঁর জন্য কোনো স্বয়ংবর রচিত হয়নি। সীতার বিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন তাঁকে বাছা হল ভরতের জন্য। ভাগ্যের পরিহাস বুঝি একেই বলে।
পরের পর্বগুলোতে মান্ডবীকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ভরত স্বয়ং সেখানে উপেক্ষিত। একেবারে শেষে যখন লক্ষ্মণ যখন আত্মাহুতি দিলেন রামও আর প্রিয় ভাইয়ের বিয়োগে রাজত্ব করতে চাইলেন না৷ ভরত তখন লব কুশকে রাজভার দিয়ে ভাইয়ের সঙ্গ নিলেন। মান্ডবীর কি হল? শ্রুতকীর্তির? সেভাবে কেউ খেয়ালই করলেন না।
ভরত ও মান্ডবীর দুইটি পুত্র হয়েছিল। তাদের নাম হল তক্ষ ও পুষ্কল। পরবর্তীতে তক্ষ সিন্ধুনদের পূর্বে তক্ষশীলা ও পুষ্কল পুষ্কলাবতী নামে এক নগর স্থাপন করে রাজত্ব করেন।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team