হাঁটি। সঙ্গে চলে একটা গোটা শহর। পায়ে পায়ে চলে আসে কত কথা, কিছু বা ধরে রাখি, কিছু বা পড়ে থাকে পথের পাশে। তা, পড়ে থাকলেও অবশ্য কেউ কেউ ধরে নেয়, তুলে রেখে দেয় সেইসব কথা, রঙ বেরঙের ইতিহাসমালা। থেকে যায় একটা শহর গড়ে ওঠার, হয়ে ওঠার ইতিহাসে। আর সে ইতিহাসে জড়িয়ে থাকে ওতপ্রোত, রসনার ইতিহাস এবং খুব অনিবার্য সেটা। আজ আমাদের কথাগাড়ি গড়িয়ে যাচ্ছে শিলিগুড়ি শহরের সেই রসনাবিলাসের দিকে।
বাঙালি থাকবে, আর রসনাতৃপ্তির আয়োজন থাকবে না? তাও কী হয়? শিলিগুড়ি শহরের বিশেষ আর্কষণের অন্যতম হল পর্যটন। বাকিগুলির কথায় যথাসময়ে আসা যাবে। তো, এই টুরিজম বা পর্যটনের সূত্রেই উড়ে আসে রেস্টুরেন্ট প্রসঙ্গ। মধ্যবিত্ত বাঙালির ভোজনবিলাসের আয়োজনে শিলিগুড়িতে প্রথম বাঙালি রেস্টুরেন্ট হলো বসুমল্লিকের রেস্টুরেন্ট। শিলিগুড়ি থানা সংলগ্ন যে আদি কালিবাড়ি তার পিছনে অধুনা বাবুপাড়ায় ছিল বিশ্বেশ্বর বসুর বোর্ডিং আর শচীন ঘোষের ‘ডায়ান হোটেল’। এ সবই ষাট সত্তর দশকের কথা। অবাঙালি আয়োজনও ছিল-- মহাবীরস্হান পেরিয়ে পুরোনো রাধাগোবিন্দ মন্দিরের উল্টোদিকের গলিতে. ছিল হোর্ডিং বিহীন একটি জনপ্রিয় দোকান। কচুরি ভেঙে তার মধ্যে ছোলা, চাটনি সহযোগে লোভনীয় খাদ্য সরববাহ করতো যে দোকানটি তার নাম ছিল- 'বানাকে' বা' বানাক্কে'। বহু রস স্মৃতি বিজডিত এ দোকান নব্বই দশকেও চালু ছিল। আর, ছিল শিলিগুডির পুরোনো স্টেশন সংলগ্ন 'সোরাবজীর ক্যাফে'। সত্তর দশকের অন্যতম রেস্টুরেন্ট, সাহেবিয়ানা আর আভিজাত্যের কৌলিন্য তো ছিলই তার সঙ্গে সমসাময়িক তরুণ তুর্কিদের আড্ডার সৌরভে আমোদিত ছিল, মুখরিত সোরাবজীর ক্যাফে। চমৎকার পরিবেশনা এবং খাদ্যগুণ, একদিকে আভিজাত্যের বিভব অন্যদিকে মননচর্চার অসামান্য এক স্হান ছিল এই সোরাবজীর ক্যাফে। নব্বইয়ের সূচনা পর্যন্ত এর অবস্থিতির কথা অনেকেই স্মৃতি আউড়ে বলে দিতে পারেন এখনও।
সত্তর দশকেই গড়ে উঠেছিল নেতাজী কেবিন। অবস্হান পরিবেশ, খাদ্য ও পরিবেশনার গুণে আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আড্ডার সংস্কৃতি হোক বা টোস্ট অমলেট, নানাবিধ চা -- আজও রসিকের কাছে সমান আকর্ষণীয় নেতাজি কেবিন। ভোজনরসিকের তো বটেই নানা আলোচনায় মুখরিত হয়ে থাকতো বিধান মার্কেট এলাকার 'নেতাজি কেবিন। এখনও জনপ্রিয়তা আর লোকসমাগমে ভাঁটা পড়েনি এর। চা, টোস্ট বা ঘুঘনির পাশাপাশি এসেছে হরেকরকম পদ। স্হানীয় লোকজন তো বটেই বহিরাগত বহু মানুষের মুখে ফিরে ফিরে আসে নেতাজি কেবিনের নাম।
মূলত, আশির দশক থেকেই রসনাতৃপ্তির আয়োজনে শিলিগুড়িতে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল বিধান মার্কেট এলাকায় পরিমলের ‘মা কেবিন’। বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে মা কেবিনের মাংসের চপ, মোগলাই, কাটলেট প্রভৃতির আর্কষণ ছিল প্রবল। পুজো পার্বণের জমজমাটি ভিড় আর সঙ্গে পরিমলদার হাসিমুখের আতিথেয়তা অনেকেই মনে রেখেছেন। আশির দশকেই অত্যাধুনিক, ঝাঁ চকচকে ‘রেকস্’ গড়ে উঠেছিল রোড স্টেশনের ধারে, যদিও বেশিদিন স্হায়ী হয় নি। হিলকার্ট রোডেই ছিল জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট ‘সম্রাট’ আর ছিল চাইনিজ বার কাম রেস্টুরেন্ট আভিজাত্যে ভরপুর 'ডিকিজ'। মেঘদূত সিনেমা হলে সিনেমা দেখে মধ্যবিত্ত বাঙালির ভিড় জমতো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার উপরে উঠে ‘মমতা রেস্টুরেন্টে’। চমৎকার ধোসা,আলুর পরোটা আর সস্তা দামে রসনা তৃপ্তির আয়োজন স্বস্তিদায়ক ছিল বড়ই। এই দশকের সূচনাতেও মমতা রেস্টুরেন্ট চমৎকার চলেছে।
সত্তরের দশকেই তৈরি হলো সালুজা গোষ্ঠীর বিখ্যাত ‘হোটেল সালুজা’ এবং ‘সালুজা রেস্টুরেন্ট’। এখন পর্যন্ত সালুজার গৌরব অটূট। আশির দশকের শেষে গড়ে ওঠে ‘রঞ্জিৎ রেস্টুরেন্ট'। রঞ্জিৎ ও নিউ রঞ্জিৎ হোটেলের পাঞ্জাবি খানা এবং দক্ষিণী খাদ্যসম্ভার রসিকের কাছে সমান সমাদৃত আজও। শুধু কী বাহারি খানা? বাঙালিয়ানা ও বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের ভাত মাছের তৃপ্তির আয়োজনে দুটি হোটেল ছিল খুবই জনপ্রিয়। কল্পনা পাইস হোটেল এবং হোটেল কল্পতরু। অধুনা বিধান মার্কেটের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মূল ‘কল্পনা পাইস হোটেল’ সমধিক পরিচিত ছিল বিভূতিবাবুর হোটেল নামে। এই হোটেলের চিতল মাছের পদ শিলিগুড়িবাসীর স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। পর্যটনবিলাস ও আভিজাত্য কৌলীন্যে যে দুটির নাম না করলে এ অধ্যায় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সেই দুটি হল ‘মৈনাক টুরিস্ট লজ’ এবং ‘হোটেল সিনক্লিয়ার্স’। নিজ মাহাত্ম্যে তো বটেই শিলিগুড়ি মূল শহর থেকে খানিকটা বাইরে মাল্লাগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকার গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছিল এই দুটি। এদের আতিথেয়তার নৈপুণ্য শিলিগুড়ির পর্যটন শিল্পকে আলাদা মর্যাদা এনে দিয়েছিল। এরই মাঝে নেহেরু গোল্ড কাপ এবং দেশি বিদেশিদের পর্যটকদের আনাগোনায় ক্রমশ পর্যটকদের আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল শিলিগুড়ি।
কিন্তু, এই যে রসনাবিলাস সেখানে মিষ্টির একটা বড় ভূমিকা আছে, সে কথা বাঙালি হয়ে ভুলে গেলে চলে না মোটেই। শিলিগুড়ির সবচেয়ে পুরোনো মিষ্টির দোকান মুঙ্গারাম। এর অবস্থান বর্তমানের জমজমাট মহাবীরস্হান অঞ্চলে। অতি প্রাচীন এই মিষ্টির দোকান মহাবীর মন্দিরের ঠিক পাশেই। বর্তমানে কর্ণধার অশোক নারায়ণ গুপ্তা জানালেন, ১৯০২ সালের দোকান তাদের। এ শহরে চতুর্থ প্রজন্ম চলছে। তবে, দোকানের ভার এখনও তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। তাদের ঠাকুরদা মুঙ্গারাম হালুইকর এ দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। শিলিগুড়ির বিখ্যাত ক্ষীরের সিঙারার স্রষ্টাও মুঙ্গারাম হালুইকর। এই তথ্য চমকপ্রদই বটে! তবে,পুরোনো মিষ্টির দোকান বলতে মনে পড়বেই সৃষ্টিধর ঘোষ অ্যাণ্ড সন্স এর কথা। সৃষ্টিধর ঘোষের দোকানটি শিলিগুড়ি থানা সংলগ্ন। দোকানের বয়সও অনেক।। বাঙালি বাড়ির পালা পার্বণ, অনুষ্ঠানের এই দোকানের দই মিষ্টির কথা আজও লোকের মুখে ফেরে। হিলকার্ট রোডের পুরোনো দোকান ‘সব ভালো’ আর ‘জলযোগ’। দুটি দোকানের সূত্রপাত মোটামুটি সত্তরের দশক। জলযোগের ক্ষীরের সিঙারার জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্টই। কোর্টের পিছনে ছিল বনোয়ারীলালের মিষ্টির দোকান ষাট ও সত্তরের দশকে। সেখানে মিষ্টি খেতে আসতো বালক বৃদ্ধ সকলেই। শহরের মাঝখানে হওয়ার কারণে (শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল সংলগ্ন এলাকা) এবং দামে সস্তা বলে বনোয়ারি লালের মিষ্টি আস্বাদন করতে পারতেন চলতা ফিরতা সকলেই। তবে, বহু পুরোনো সে দোকান আজ আর নেই। নতুন নতুন মিষ্টির দোকানের পাশাপাশি টিকে আছে পুরোনো মিষ্টির দোকান। বিধান মার্কেটের সব্জিহাটায় ক্যালকাটা সুইটস, কলেজ পাড়ার গঙ্গা সুইটস, হাকিম পাড়ার সানন্দা, দেশবন্ধু পাড়ার গীতা সুইটস -- এমনই আরও কত!
আশির দশকে একটি ঝকঝকে আইসক্রিম পার্লার গড়ে উঠেছিল হিলকার্ট রোডে, তার নাম ছিল ‘কাওয়ালিটি’। আইসক্রিমের বৈচিত্র্য, আর চমৎকার স্বাদ তো ছিলই সেই সঙ্গে ছিল দুর্দান্ত অন্দরসজ্জা। আজকের আধুনিক অন্দরসজ্জার সঙ্গে সে অক্লেশে পাল্লা দিতে পারতো। নব্বইয়ের দশকে সে দোকান বিভক্ত হয়ে যায়। মূল দোকানটি পাল্টে যায়। তার নাম হয় তখন 'বম্বে স্টোর্স'। পাও ভাজি, আর অন্যন্য চটপটা খানাতে তখন বেজায় নামডাক হয় তার। দুঃখের বিষয় গত বছর তিনেক হলো, সে দোকানও অবলুপ্ত হয়েছে। আর গড়ে উঠেছিল সত্তরের শেষদিকে হিলকির্ট রোডের ওপর মঙ্গলদীপ বিল্ডিং এর নীচে ভারি সাজানো গোছানো একটি মিষ্টির দোকান, তার নাম ‘মনপসন্দ’। উল্টোদিকে ছিল নোনতা সম্ভারে ঠাসা ‘আপনি পসন্দ’ দোকানটি।
শুধু কী অতীত! বর্তমানের আয়োজনও কম কিছু না। শিলিগুড়ি শহরের অলিগলি জুড়ে ছোট বড় কতোই খাবারের দোকান। মোমোগলি তো স্বনামধন্য। শেঠ শ্রীলাল মার্কেটে ঢোকার মুখেই এই মোমোগলি। আর আছে, হিলকার্ট রোডের উপরেই পুরোনো বিল্ডিং এর উপরে বিখ্যাত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ‘তাই ওয়া’। নব্বইয়ের দশক থেকে এর যাত্রা শুরু। পুরোনো রেস্টুরেন্টের মধ্যে আছে ‘আম্বার’, এদের নিজস্ব ‘আম্বার ধাবা’ অবশ্য চালু হয়েছে বছর কয়েক আগে। নব্বই দশকের শেষ দিকে এখানে গড়ে উঠেছে কলকাতার অন্যতম, পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানার মোড়া ‘ভজহরি মান্না’ র শাখা। ভেনাস মোড়ের ক্রসিং পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে ভজহরি মান্না-য় উৎসবের দিনগুলিতে রীতিমতো লাইন পড়ে যায়। বিখ্যাত শেফ সঞ্জীব কাপুরের ইয়েলো চিলি, শাহী পাঞ্জাব, পাঞ্জাবি কড়াই, বার-বি-কিউ-নেশন শহরের শোভা বৃদ্ধি করেছে। আছে আধুনিকতায় মোড়া বাঙালী রেস্টুরেন্ট - মিত্র ক্যাফে, পাঁচফোড়ন, ভূতের রাজা দিল বর প্রভৃতি নতুন রেস্টুরেন্ট। তেমনি আছে হাকিম পাড়ার গলিরাস্তায় পুরোনো ‘দাদাভাই হোটেল’। এসবের সৌরভে গৌরবে আমোদিত শহর শিলিগুড়ি এগিয়ে চলেছে তার নিজস্ব আঙ্গিকে। কোথায়? কীভাবে? তার সব খবর কেউ হয়তো দিতে পারেন। সেসব দিতে পারি না, আমি কেবল সময়ের কিছু খতিয়ান লিখে রাখি!
(ঋণ: গৌতমেন্দু রায়, পার্থপ্রতিম মিত্র, গীতাংশু কর)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team