বৈদ্যুতিক শীতাতপ যন্ত্রের প্রবল চাহিদা এখন কলকাতার মতই উত্তরবঙ্গেও, কারণ এখানেও গরমের তীব্রতা ইদানীং সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে। উষ্ণায়নের সৌজন্যে অন্তত মাস কয়েকের জন্যও হলেও বাংলার উত্তরে এসি আর লাক্সারি নয়, এখন তা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তবু কোচবিহার তথা উত্তরপূর্ব ভারতের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোচবিহারের শীতল পাটি, শত আধুনিকতা সত্ত্বেও দিব্যি বেঁচে আছে এই সাবেকি হস্তশিল্পটি। তার সবচেয়ে প্রমাণ হল, আজও কোচবিহার জেলার ৩৫-৩৬টি গ্রাম জুড়ে পাটি শিল্পীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। নাম তাদের পাটিয়াল, পাটি বানানোই তাদের পেশা। সেই কোন যুগে পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইল সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এপারে চলে এসেছিলেন তারা। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বাপ ঠাকুর্দার পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবে পাটি শিল্পকে।
এই অঞ্চলগুলিতে প্রায় প্রতিটি পরিবারের আয়ের উৎস পাটি শিল্প। বাড়ির প্রত্যেক সদস্য ঘরের কাজ সামলে হাত লাগায় পাটি তৈরিতে। পাটিয়ালরা বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত পাল্টি ঘর অর্থাৎ পাটিয়ালদের ঘর থেকেই মেয়ে আনতে আগ্রহী থাকে। যাতে পারিবারিক পেশাতে নতুন বৌ এসে হাত লাগাতে পারে। বেত কাটা, বটিতে চাটাই তোলা, এই কাজগুলো সাধারণত বাড়ির পুরুষ মানুষেরাই করে থাকে। মেয়েরা চাটাই রোদে দিয়ে শুকিয়ে তা দিয়ে পাটি বোনে। বর্তমানে সরকারি সাহায্য ও দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও এই শীতলপাটির কদর বাড়ায় শিল্পীদেরও দিন ফিরেছে। দুটো পয়সার মুখ দেখছে তারা।
মোত্রা বা মূর্তা বেত জাতীয় এক ধরনের গাছের ডাল থেকে তৈরি হয় পাটি। এটির প্রোসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণে যেমন দক্ষতা লাগে, তেমনি লাগে ধৈর্য। বেতকে ভাতের মাড়ে ২-৩ দিন ভিজিয়ে রাখার পর তা সিদ্ধ করে শুকিয়ে নিতে হয়, তা থেকেই তৈরি তন্তু দিয়েই বোনা হয় শীতল পাটি, ডালা পাটি, পাটির ব্যাগ, চপ্পল ইত্যাদি। পাটি শিল্পকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগও উল্লেখযোগ্য। এক্সপার্টদের নিয়ে পাটি বা পাটিজাত বিভিন্ন জিনিস কত সুন্দর করে তৈরি করা যায়, সেই দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডিজাইনিং ডেভলপমেন্টের প্র্যাক্টিকাল কোর্স করানো হচ্ছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা পাটিশিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারি ভাবে রেজিস্টার্ড শীতল পাটি শিল্পী সংখ্যা ছিল ৩৩৩৯ জন। অ্যাকটিভ আর্টিস্টের তালিকায় ছিল ৪৫০০ জন। এদের মধ্যে কিছু কিছু আর্টিস্ট সরকারি পেনশন পায়, এদের রেজিস্টার্ড আইকার্ডও রয়েছে। বর্তমানে রেল স্টেশনগুলিতে ‘ওয়ান স্টেশন ওয়ান প্রোডাক্ট’ স্টলে বিক্রি হচ্ছে পাটিজাত নানা পণ্য। গত বছর কোচবিহারের শীতলপাটির জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন বা জি আই ট্যাগের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
পাটিয়ালদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও ছোটবেলা থেকেই এই কাজ শিখে যায়। আগে তেমন লেখাপড়ার চল না থাকলেও বর্তমানে এদের নতুন প্রজন্ম সকলেই স্কুল কলেজে পড়ে। তারা লেখাপড়ার ফাঁকে পাটি বোনে। আশার কথা হল, শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নতুন প্রজন্ম সানন্দে এই জীবিকার সাথে নিজেদের যুক্ত করে নিচ্ছে। তাদের হাত ধরেই ডিজাইনের আধুনিকতা আসছে, তারাই দেশে বিদেশের প্রদর্শনীতে হাজির করছে এই অপূর্ব শিল্পকে। ডিজিটাল যুগের এই ছেলেমেয়েরাই সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন শপিং-এর সাহায্য নিয়ে এই হস্তশিল্পকে বিশ্বের দরবারে আরও আকর্ষণীয় পণ্য রূপে হাজির করছে। পারিবারিক সাবেকি হস্তশিল্পে নতুন প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণই এই সিন্থেটিক জমানাতেও শীতল পাটির এই রমরমার আসল রহস্য। আর পাঁচটা হস্তশিল্পের মতই সরকারি উৎসাহ বা সহযোগিতা তাদের প্রেরণা যোগায় নিঃসন্দেহে, কিন্তু স্বয়ংক্রিয়তার যুগে আধুনিকতার হাতছানি যখন একের পর এক প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত হস্তশিল্পকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে তখন পাটি শিল্পে নতুন প্রজন্মের এই বিপুল অংশগ্রহণ আত্মনির্ভরতার পথে সমগ্র দেশের কাছে অনুকরণীয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team