 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             রাখি পুরকায়স্থ
                                            
                                                
                                                রাখি পুরকায়স্থ
                                            
                                            
                                         
                                            বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। স্বল্প সংখ্যক ভারতীয় নারী ততদিনে উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন ও জৈব-রসায়ন গবেষণার ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে অগ্রণী হয়েছেন। ওদিকে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারে তখনও কেবল পুরুষদেরই নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ‘পদার্থবিজ্ঞানী’ আর ‘পুরুষ’ শব্দ দু’টি যেন সমার্থক। লিঙ্গবৈষম্য দোষে দুষ্ট ভারতীয় সমাজ তখনও ভেবে চলেছে, পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়ন ও গবেষণা নারীদের জন্য বড্ড বেমানান। তবু সমাজের কুটিল ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে সেই পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গেই এক অদম্য আবেগে জড়িয়ে পড়লেন এক তরুণী! শুধু তাই নয়, রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজ নির্মিত লিঙ্গ-প্রতিবন্ধকতাগুলিকে অযথা গুরুত্ব দিয়ে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করতেও রাজি ছিলেন না তিনি। তাই তো গবেষণার খাতিরে কলকাতার একটি অকিঞ্চিৎকর গলিতে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ভাঙাচোরা লোহালক্কর কুড়োতে!
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ির পেছন দিককার একটি গলি। সে-গলিপথের এক ধারে স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল সেনা সরঞ্জাম - বিক্রির অপেক্ষায়। তরুণীটি অতি দ্রুত হাত চালিয়ে সেই পরিত্যক্ত লোহালক্করের বিপুল স্তূপ থেকে তুলে আনছেন একের পর এক ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। এক্স-রে যন্ত্র তৈরি করতে প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশের সন্ধান করছেন তিনি। ডক্টরাল গবেষণার জন্য তাঁকে যে একখানা এক্স-রে যন্ত্র তৈরি করতেই হবে! এর পর অবশ্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি - কারণ, প্রচলিত সব ধ্যানধারণাকে ভেঙ্গেচুরে ১৯৫৬ সালে সেই মেধাবী তরুণীটিই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী প্রথম নারী হিসেবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অভূতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন। শুধু কি তাই? বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসুর এই শিষ্যাটি বিজ্ঞানের জগতে বিপুল অবদান রাখার পাশাপাশি, একজন শিল্পী, লেখক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবেও তাঁর প্রতিভার প্রাবল্য ও বহুমুখী সৃজনশীল ক্ষমতার সাক্ষ্য রেখেছিলেন। সেই তরুণীটি আর কেউ নন - তিনি বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ পূর্ণিমা সিংহ!
ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরে ১৯২৭ সালের ১২ অক্টোবর পূর্ণিমার জন্ম হয়। বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ ও পঞ্চম দশকে পূর্ণিমা যখন বেড়ে উঠছিলেন, ভারতীয় সমাজে তখনও নারীদের ভূমিকা ছিল কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত। সৌভাগ্যবশত পূর্ণিমার পরিবার ছিল অত্যন্ত উদারপন্থী ও আধুনিকমনস্ক। তাঁর পিতা ডঃ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবী। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন অধ্যাপক ও লেখক। স্বাধীন চিন্তাধারার অধিকারী নরেশ চন্দ্র ছিলেন নারী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী। বাংলা এবং ইংরাজিতে লিখেছিলেন ৬৫টিরও বেশি বই। প্রবন্ধও লিখেছিলেন অনেক, যার মধ্যে বেশ কিছু প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘নারী শিক্ষা’। তাঁর লেখা অধিকাংশ উপন্যাসেরও উপজীব্য বিষয় ছিল ‘নারীমুক্তি’। পরিবারের সকল সদস্য, বিশেষত তাঁর চার কন্যার ওপর, নরেশ চন্দ্রের জীবনদর্শনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তাঁরই কনিষ্ঠা কন্যা পূর্ণিমা সেনগুপ্ত (যিনি পরবর্তী জীবনে ডঃ পূর্ণিমা সিংহ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন) যে বিজ্ঞানের আকাশে একটি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী!
পূর্ণিমার প্রথাগত শিক্ষারম্ভ হয় কলকাতার লেক বালিকা বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠা ভগ্নী সুষমা সেনগুপ্ত। তবে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও পূর্ণিমা ও তাঁর তিন দিদি নানাবিধ বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলেন। বাড়ির উদার পরিবেশে নিজেদের পছন্দমতো বিষয়ে পাঠনপাঠনের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির এমন পরিবেশ পূর্ণিমার চিন্তাধারাকে বিকশিত করতে সহায়ক হয়েছিল। তাই দিদিরা অর্থনীতি, অঙ্ক, রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করলেও, পূর্ণিমা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে আকৃষ্ট হলেন পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি। আর সে-স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আশুতোষ কলেজ, স্কটিশ চার্চ কলেজ হয়ে সর্বশেষে তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ মর্যাদাপূর্ণ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে।
এরই মাঝে দেখতে-দেখতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট চলে এল। দেশ স্বাধীন হল। স্বাধীনতা উত্তর চূড়ান্ত রাজনৈতিক-সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ১৯৫১ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অসামান্য ফল করলেন পূর্ণিমা। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা অধ্যাপক। জহুরির চোখ তাঁর। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি মেধাবী পূর্ণিমার অস্বাভাবিক আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাঁর চোখ এড়াল না। শীঘ্রই পূর্ণিমাকে তাঁর গবেষণা-দলের সদস্য করে নিলেন তিনি। এভাবেই কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা গবেষণাগারে পূর্ণিমার গবেষক জীবনের যাত্রারম্ভ হল।
তবে বিজ্ঞানের ওই বিশেষ শাখার গবেষণা-ক্ষেত্রে তখন পুরুষদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। বলাই বাহুল্য, পূর্ণিমাকে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার পরিসরে দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল। অনেকেই তুললেন গেল-গেল রব! কেউ-কেউ আবার অবজ্ঞা ভরে বললেন - একটা মেয়ে কিনা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করবে, তবেই হয়েছে! তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে স্বভাবতই প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। কিন্তু পূর্ণিমা অত সহজে হার মেনে পিছিয়ে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। তীব্র মানসিক শক্তিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিযেছিলেন সমাজ নির্মিত লিঙ্গ-প্রাচীর। বিজ্ঞানী হয়ে উঠবার পথে কোনো বাধাই তাঁকে ঈপ্সিত লক্ষ্য থেকে টলাতে পারেনি। অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তাঁর এই অসামান্য মেধাবী ছাত্রীটির ওপর গভীর আস্থা রেখেছিলেন।
পূর্ণিমার গবেষণার বিষয় ছিল- ‘X-ray crystallography of clay minerals’। অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসু ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে, তাপীয় ও রাসায়নিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি এক্স-রে বিক্ষেপ প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে, গবেষণা করবার পরামর্শ দিয়েছিলেন পূর্ণিমাকে। তাই গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ণিমার বিশেষ প্রয়োজন ছিল একখানা এক্স-রে যন্ত্রের। কিন্তু সে-আমলে এক্স-রে যন্ত্র সহজলভ্য ছিল না। তাই অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসুর পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিলেন, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিজেই তৈরি করবেন। খবর পেলেন, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ির পেছনের রাস্তাতে বিক্রি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল যুদ্ধ সরঞ্জাম। সেখানে গিয়ে নিজের হাতে কিছু যন্ত্রাংশ কুড়িয়ে, কিনে নিলেন তিনি। সেগুলো জুড়েই তৈরি করে ফেললেন এক শক্তিশালী এক্স-রে যন্ত্র ও অন্যান্য দরকারি যন্ত্রপাতি। ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক প্রকাশিত Lilavati’s Daughters: The Women Scientists of India বইতে ডঃ পূর্ণিমা সিংহ স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘সে-সময় আমরা প্রায় দশজন খয়রা গবেষণাগারে পরীক্ষামূলক গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলাম। আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে নিজ নিজ যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিতাম। আমাদের গবেষণাগারে সেটাই ছিল অলিখিত নিয়ম।… এক্স-রে ল্যাবরেটরিতে আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় শেষমেশ প্রায় পঞ্চাশটি মাটির নমুনার সম্পূর্ণ শ্রেণীবিন্যাস করা সম্ভব হয়, যেমন - Kaolinite, Montmorillonite, Illite, Vermiculite, Chlorite ইত্যাদি।’ অবাক হতে হয়, আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও নিজের প্রয়োজন অনুসারে গবেষণাগার তৈরি করে নেওয়া একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই গবেষণার জন্য আর্থিক সাহায্য করেছিল আসাম অয়েল কোম্পানি। সে-যুগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য শিল্পোদ্যোগ সংস্থার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বিশেষ শোনা যেত না।
নিরলস গবেষণা শেষে ১৯৫৫ সালে পূর্ণিমা ‘X-ray & differential thermal analysis of Indian clays’ শীর্ষক গবেষণা সন্দর্ভটি জমা দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। তিনিই প্রথম নারী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। সে-বছরই অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতে সেই গবেষণা থেমে থাকেনি। পূর্ণিমাদের গবেষক দলটি অধ্যাপক কমলাক্ষ দাশগুপ্তের অধীনে মাটির নমুনার কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যগুলির ওপর আরও বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সাল নাগাদ পৃথিবীর অপর প্রান্তের বিজ্ঞানীরা ডিএনএ-এর গঠনতন্ত্র জানতে একই এক্স-রে প্রয়োগ পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। তাই কলকাতায় গবেষণার কাজ শেষ করে ডঃ পূর্ণিমা সিংহ বায়োফিজিক্সে উচ্চতর গবেষণার জন্য পাড়ি দিলেন মার্কিন মুলুকে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪ সাল অবধি সময়কালে তিনি স্ট্যানফর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োফিজিক্স বিভাগে ডঃ হাওয়ার্ড হান্ট প্যাটির তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেন এবং ‘Origin of life’ নামক একটি বিশেষ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তাঁর সে-গবেষণা ক্ষেত্রটি এমন ছিল যেখানে জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান মিলেমিশে গিয়েছে। সেখানে মাটির এক্স-রে কাঠামোকে ডিএনএ-এর গঠনতন্ত্রের সঙ্গে তিনি জ্যামিতিকভাবে তুলনা করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন।
দেশে ফিরে পরবর্তী দু’দশক জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এবং বোস ইনস্টিটিউটে গবেষণা করেন ডঃ সিংহ। তার পরে তিনি সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যাণ্ড সেরামিক ইনস্টিটিউটে ডেপুটি ডিরেক্টরের পদ অলঙ্কৃত করেন। সেখানে সেরামিক কালারের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্মে নিযুক্ত থেকেছেন তিনি। এ সময় তাঁর অধীত জ্ঞানকে শৈল্পিক উপায়ে ব্যবহার করে ক্লে মডেলিং শিখেছিলেন। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’। সেই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গেও সর্বতোভাবে যুক্ত থেকেছেন ডঃ সিংহ।

ছবি - মেলামেশার পাঠশালা
বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ডঃ সুরজিৎ সিংহের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন ডঃ পূর্ণিমা সিংহ। ডঃ সুরজিৎ সিংহ পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রক্রিয়া অনুধাবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। জীবনসঙ্গীর গবেষণা কর্মের সংস্পর্শে এসে নৃতত্ত্ববিদ্যার প্রতিও আকৃষ্ট হন ডঃ পূর্ণিমা সিংহ। উপজাতীয় সমাজের কল্যাণেও ব্রতী হন তিনি। সে-উদ্দেশ্যেই এই বিজ্ঞানী দম্পতি শান্তিনিকেতন ও তার আশেপাশের গ্রামগুলির অনগ্রসর পরিবারের আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্যে এক অন্যধারার বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। সে-বিদ্যালয়ের নামখানা ছিল বড়ই অনন্য - ‘মেলামেশার পাঠশালা’। সেখানে খেলাধুলো আর শিল্পচর্চার মধ্য দিয়েই ছোটোদের শিক্ষা দান করা হত।
বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ডঃ পূর্ণিমা সিংহ। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ নামক বিজ্ঞান পত্রিকাটিতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। বিজ্ঞানকে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় করে তুলবার যে স্বপ্ন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে প্রভূত অবদান রেখেছিলেন তিনি, আর তাঁর সে-কাজকে স্বীকৃতি জানাতে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০০১ সালে তাঁকে ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস মেমোরিয়াল এওয়ার্ড’ দিয়ে সম্মানিত করে। তাঁর শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও শুভাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন ডঃ সিংহ। তার মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- ১) বিজ্ঞান সাধনার ধারায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু (প্রকাশক- বিশ্ব বিদ্যা সংগ্রহ), ২) অমর কথা (১৯৭৩ সালে তাঁর নেওয়া সত্যন্দ্রনাথের কয়েকটি সাক্ষাৎকারের সংকলন, প্রকাশক- বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ), ৩) সত্যেন বসুর ব্যক্তিত্ব ও মননের ধারা (দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ)। তাঁর একাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিভাগে এবং ইকোনোমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে। তা ছাড়া পদার্থবিদ এরউইন শ্রোডিংগারের 'Mind and Matter' এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ম্যাক্সিম ডেভিডোভিচ ফ্র্যাঙ্ক-কামেনেতস্কির 'Unravelling DNA: The Most Important Molecule of Life' বই দু’টি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন।
বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি শিল্পকলা ও সঙ্গীতেও ডঃ পূর্ণিমা সিংহের অসামান্য পারদর্শিতা ছিল। যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি হিন্দুস্তানী ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নেন। ১৯৭০ সালে ভারতীয় সঙ্গীতের উপর বই লেখেন - 'An Approach to the Study of Indian Music', প্রকাশকঃ Indian Publications। এমনকি ডঃ সুরজিৎ সিংহ যখন পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করছিলেন, তখন পূর্ণিমাও তাঁর সঙ্গে থেকে সে-অঞ্চলের নানাবিধ লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই লোকসঙ্গীতের ওপরে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন ডঃ পূর্ণিমা সিংহ। ১৯৮৮ সালে জারোয়াদের গানে বৈদিক মন্ত্রের প্রভাব অনুসন্ধান করতে আন্দামান পর্যন্ত ছুটে গিয়েছেন তিনি। ফিরে এসে লিখেছিলেন এক গবেষণামূলক প্রবন্ধ - 'Jarawa Songs and Vedic Chant: A Comparison of Melodic Pattern'। ২০০৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে সেই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। মেয়েরা যে তবলচি হতে পারে, এই ব্যাপারটা সে-আমলে ছিল কল্পনারও অতীত। সেই প্রচলিত ধ্যানধারণাকে ভেঙেচুরে দিয়ে পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের কাছে তিনি তবলার তালিম নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত শিল্পী গোপাল ঘোষ ছিলেন তাঁর চিত্রশিল্পের গুরু। ভাস্কর্য-নির্মাণেরও পূর্ণিমা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অবসর গ্রহণের পরে তিনি শান্তিনিকেতনে পাকাপাকি বসবাস করতে শুরু করেন। সে-সময় ডঃ সিংহ সঙ্গীত ভবনে ‘ফিজিক্স অব মিউজিক’ কোর্স চালু করেন এবং স্থানীয় কুমোরদের সহযোগিতায় মৃৎশিল্পের উন্নয়নকল্পে নিয়জিত হন। তাঁর তৈরি মাটি ও সেরামিকের ভাস্কর্য শ্রীনিকেতনে বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় সজ্জিত রয়েছে। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি একখানি ম্যুরাল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলোর দেয়ালের শোভা বর্ধন করে চলেছে আজও।
পূর্ণিমার দুই কন্যা সুপর্ণা ও সুকন্যা মায়ের দেখানো পথে বিজ্ঞান সাধনা করে সফল পদার্থবিদ হয়েছেন। ডঃ সুপর্ণা সিংহ তাঁর মায়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন - ‘তাঁর জীবনের শেষের দিকে, আমার মনে তাঁর যে ছবিটি রয়ে গিয়েছে তা হল - তিনি একটি ডেস্কের সামনে বসে রয়েছেন এবং মনেপ্রাণে (ম্যাক্সিম) কামেনেতস্কির বই ‘Unraveling DNA: The Most Important Molecule of Life’ অনুবাদ করে চলেছেন। সে-সময় তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তাই শব্দগুলি পড়বার জন্য তাঁকে একটি আতশ কাঁচ ব্যবহার করতে হত। আমার সঙ্গে আধুনিককালের ডিএনএ-এর মলিকুলার বায়োফিজিক্স নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন, কারণ সে-সময় আমি সেই সংক্রান্ত কিছু তাত্ত্বিক কাজকর্মে নিয়োজিত ছিলাম। সত্যিকার অর্থে তাঁর উপস্থিতি সকলকেই অনুপ্রেরণা যোগাত। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রকৃত সংমিশ্রণ।’
২০১৫ সালের ১১ জুলাই ডঃ পূর্ণিমা সিংহ পরলোক গমন করেন। তবে ভারতীয় নারী বিজ্ঞানীদের উত্তরণের পথে তাঁর জীবন ও কর্মকান্ড শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে। বিজ্ঞানের জগতে সুদীর্ঘকাল সফলভাবে বিচরণ করলেও সম্মান বা খ্যাতির পেছনে কোনোকালেই ছোটেননি ডঃ সিংহ। এমনকি তাঁর গবেষক জীবনে এগিয়ে চলার পথে যাঁরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কখনওই কোনো অভিযোগ আনেননি। আজীবন নিজের মনকে কলুষতা মুক্ত রাখবার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। লক্ষ্য স্থির রেখে মেতে থেকেছেন সৃষ্টির আনন্দে। সৃজনশীল ও শৈল্পিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ ব্যবহার এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করবার মধ্যেই জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িতে কবি, থিয়েটার ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, কিংবা প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের ছিল নিত্য যাতায়াত। নিজ উদ্যোগে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ও বিজ্ঞান সাময়িকীর এক বিরাট গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন বাড়িতে। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা, সঙ্গীত-শিল্পকলা চর্চা, লেখালেখি, সমাজের প্রতি কর্তব্য-- সবেতেই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন এই অদ্বিতীয় প্রতিভাময়ী। তাঁকে প্রায়শই বলতে শোনা যেত - ‘সারা জীবন সৃজনশীল থাকুন।’ বিজ্ঞান সাধনার পথে তিনি যে অসামান্য কীর্তি রেখে গিয়েছেন, তা আজও অগণিত নারীকে বিজ্ঞানের নানান ধারায় গবেষণা করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। পুরুষতান্ত্রিকতার শৃঙ্খল ভেঙে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের নিজস্ব স্বাধীন পরিসর গড়ে তোলার লড়াইয়ে ডঃ পূর্ণিমা সিংহের মতো সত্যনিষ্ঠ, কর্মবীর ও বিদূষী নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
পরিশেষে বলতেই হয়, লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিজ্ঞানের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা জরুরি। কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টির অভাবে তা লিঙ্গ বৈষম্য দোষে দুষ্ট। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে নারী বিজ্ঞানীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও, দুর্ভাগ্যবশত পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী ইতিহাসবিদদের অবমূল্যায়নের কারণে বিজ্ঞানের ইতিহাসে নারীদের অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপনয় করা হয়েছে। স্বভাবতই ঊনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের গোড়ার দশকগুলিতে আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির কালে যে ভারতীয় বিজ্ঞান সাধিকারা প্রথম বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণা-পথে আলোকবর্তিকা হাতে একাকী হেঁটে এ দেশের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান প্রিয় নারীদের জন্য সে-পথ আলোকোজ্জ্বল করেছিলেন - তাঁরা কিন্তু থেকে গিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেই। স্রোতের বিপরীতে অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলা সেই নারী বিজ্ঞানীদের জীবন, লড়াই ও অবদানকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাসের মূলস্রোতে নিয়ে আসা আশু প্রয়োজন। তবেই ভারতীয় বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও জয়যাত্রার প্রকৃত ইতিহাস আমাদের সামনে সর্বতোরূপে উন্মোচিত হবে।
------------------------------ x -------------------------------
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
