 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             শৌভিক রায়
                                            
                                                
                                                শৌভিক রায়
                                            
                                            
                                         
                                            চা-বাগানের নিছক এক কোয়ার্টার। বাইরে থেকে দেখে বুঝবার উপায় নেই যে, বাড়ির ভেতর রয়েছে এত কিছু! অবশ্য সাধারণ চোখে সেসবের মূল্য হয়ত তেমন কিছু নেই, কিন্তু জহুরির চোখ ঠিক চিনে নেবে দুশো বছরের পুরোনো 'মাদানি' বা ঘি জমাবার কাঠের পাত্র, মানুষের হাড় দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরণের বাঁশি 'কাংলিং' বা তামাং গোষ্ঠীর লামাদের খাবারের বিশেষ পাত্র 'ফুরু'। রয়েছে অজস্র মুখোশ, প্রাচীন মুদ্রা, ডুয়ার্সের জনজাতি গোষ্ঠীর ব্যবহৃত বেশভূষা, বাদ্যযন্ত্র, পুঁথি, ছবি ইত্যাদি। এই বাড়ির একদা-মালিক একক প্রচেষ্টায় এইসব সংগ্রহ করেছিলেন। লোকমুখে 'কাজিমান গোলের সংগ্রহশালা' নামে পরিচিত এই বাড়িটি রয়েছে ১৩০ বছর প্রাচীন কালচিনি চা-বাগানে। তামাং সম্প্রদায়ের সামান্য শ্রমিক কাজিমান গোলে কালচিনির এক পরম বিস্ময়। ভুলতে বসা তামাং সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। জনপ্রিয় করেছেন তামাংদের বাকপা নৃত্যশৈলীকে। লিখেছেন কবিতা, গান। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কালচিনির উন্নয়নে কাজ করে গেছেন সমাজের তথাকথিত বিত্তশালীদের সঙ্গে।

ছবি - কাজিমান গোলের সংগ্রহশালা
কালচিনি আসলে এরকমই! ডুয়ার্সে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার দিনগুলি থেকে কালচিনি কোথায় যেন একটু হলেও আলাদা। শুধু অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নয়, কালচিনির চরিত্রেই রয়েছে ভিন্ন স্বাদ। একদা পশ্চিম ডুয়ার্সের অলিখিত রাজধানী এই ছোট্ট জনপদটি ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনন্য। তাকে দেখে ঈর্ষা করত অন্যেরা। চা-বাগান পত্তন করতে এসে ইউরোপিয়ানরাও বোধহয় কালচিনির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। তাই চেষ্টা করেছিলেন নিজেদের মতো চা-শহরটিকে সাজিয়ে তুলতে। তাই এখনও সন্ধানী চোখ কালচিনিতে খুঁজে ইউরোপিয়ান স্থাপত্য বা পরিবেশের ভগ্ন চিহ্ন। খুব কাছেই ভুটানের পাশাখা আর ফুন্টশেলিং থাকায়, ভুটানের প্রভাবও কমবেশি বোঝা যায়। এসব মিলেই কালচিনি অনন্য।

ছবি - কাজিমান গোলের সংগ্রহশালা
ডুয়ার্স সম্পর্কে একটু আধটু জানেন এরকম কোনও মানুষ ঝটপট বলে দেবেন, কালজানি নদী থেকে এই জনপদটির নাম। সাদ্রী শব্দযুগল 'করোয়া' আর 'জানি' থেকে কালজানির সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। সাদ্রী ভাষায় 'করোয়া` মানে কালো আর 'জানি' মানে বউ। দুইয়ে মিলে কালজানি মানে মিষ্টি কালো বধূ আর তার থেকে লোকমুখে কালচিনি। আবার কালজানি বলতে দুষ্প্রাপ্য ভেষজ গাছকেও বোঝায়। তাই অনেকের মতে কালচিনি নামটি এসেছে ভেষজ গাছ কল্যাণী থেকে। তরাই-ডুয়ার্সের প্রকৃতির দিকে নজর রেখে কালচিনি নামের পেছনে এই কারণটিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হয়। নাম বিবাদে না থেকে অবশ্য কালজানি নামে বয়ে চলেছে বিখ্যাত নদী! ডুয়ার্সের ঘন অরণ্যে ছায়া ঘনিয়ে সেই নদীর জল যেন সত্যিই কৃষ্ণকালো। আর তাতেই ডুব দিয়ে গা ধোয় ডুয়ার্সের কালো মেয়ে, যার কাজল কালো চোখে লেগে থাকে অদ্ভুত মায়া! চারদিকের চা-বাগান, দূরের নীল ভুটান পাহাড়, নিমতিঝোরা-বাসরা-ডিমা-আলাইকুড়ির মতো ছোট ছোট প্রবাহের ঘেরাটোপ, অরণ্যচারী পশুদের যখন তখন লোকালয়ে আগমন, জনজাতি মানুষের সরল হাসি মুখ ইত্যাদি সব কিছু মিলে কালচিনি ডুয়ার্সের সেই জায়গা যাকে না জানলে ডুয়ার্স চেনা হয় না।

ছবি - কালচিনি কিশোরী
ইতিহাস বলছে, ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেও বেশ কিছু সময় কালচিনি ও তার সন্নিহিত অঞ্চল ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। ডুয়ার্সের গজলডোবায় ব্রাউহাম সাহেব ১৮৭৪ সালে সফলভাবে চা-বাগান পত্তন করলে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে, এই অঞ্চল চা-চাষের পক্ষে অনুকূল। ফলে শুরু হয় অরণ্য নিধন করে চা-চাষের প্রচেষ্টা। তার ফলে ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় উনিশটি জনপদ গড়ে ওঠে। কালচিনিতে ১৮৯০ সালে আসে আর জি. শ. এন্ড কোম্পানি। তারা এই অঞ্চলে ৩০০০ একর জমি লিজ হিসেবে নিয়েছিলেন। সে সময়েই চায়ের ব্যবসার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বক্সা ডুয়ার্স টি কোম্পানি। সেই কোম্পানির এক শাখা অফিস খোলা হয় কালচিনিতে। শুরু হয় চা-বাগান প্রতিষ্ঠা। জন্ম নেয় কালজানি, রায়মাটাং ও চিনচুলা নামের তিনটি চা-বাগান। প্রাবন্ধিক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, 'বক্সা ডুয়ার্স টি কোম্পানি লিমিটেডের পরিধি বিস্তৃত ছিল পশ্চিমে কালজানি নদী পর্যন্ত, পূর্বে গাঙ্গুটিয়া ফরেস্ট রেঞ্জ, উত্তরে মেচপাড়া ও ভাটপাড়ার চা-বাগিচার সীমানা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নিমতি ফরেস্ট রেঞ্জ পর্যন্ত।`
এই সীমানা বিন্যাস থেকেই কিন্তু পরিষ্কার যে, কালচিনি ছিল সেই সময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা। চা-বাগানকে কেন্দ্র করেই সেখানে জনসমাগম হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ও নানা বর্ণের ভারতীয় মিলে কালচিনি সেই অতীতেই নিয়েছিল কসমোপলিটান চেহারা, যা আজও বিদ্যমান। তবে কালচিনির গুরুত্ব বাড়ে ১৯১৪ সালের পর। কেননা ইস্টার্ন রেলের মিটার গেজ লাইন এই সময় রাজাভাতখাওয়া থেকে সম্প্রসারিত হয় দলসিংপাড়া অবধি। তখন কালচিনির স্টেশনটি কালচিনি হল্ট স্টেশন নাম পরিচিতি পেলেও, পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার হ্যামিল্টনের নামানুসারে হ্যামিল্টনগঞ্জ রাখা হয়।
রেলপথে যোগাযোগ শুরু হলে, কালচিনির গুরুত্ব সব দিক দিয়েই বেড়ে গিয়েছিল। দ্রুত বেড়ে ওঠে ছোট্ট এই জনপদটি। কলকাতার সঙ্গেও রেলপথে কালচিনির সরাসরি যোগাযোগ হয়। ফলে কালচিনিকে ঘিরে একের পর এক চা-বাগান গড়ে উঠতে শুরু করে। রাজাভাত, গারোপাড়া, মথুরা, আটিয়াবাড়ি, ভাটপাড়া, চুয়াপাড়া, মেচপাড়া, নিমতিঝোরা, সেন্ট্রাল ডুয়ার্স, পাটকাপাড়া ইত্যাদি চা-বাগানগুলির জন্ম মূলত এই সময়। ১৯২০ সালে কালচিনিতে স্থাপিত হয় প্ল্যান্টার্স ক্লাব। নাম পাল্টে পরবর্তীতে কালচিনি চুয়াপাড়া জিমখানা ক্লাব হলেও লোকে কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্লাব নামেই চিনত এই সুপ্রাচীন ক্লাবটিকে। গল্ফ থেকে শুরু করে বিলিয়ার্ডস, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, পোলো, রাগবি ইত্যাদি খেলার সুবন্দোবস্ত ছিল এই ক্লাবে। নীল আকাশের ক্যানভাসে সবুজ অরণ্য আর চা-বাগান ঘেরা বিরাট মাঠে ভুটান পাহাড়কে সঙ্গী করে এখানে খেলছেন তখনকার দিনের প্রখ্যাত মানুষেরা- এরকম চিত্রকল্প খুব একটা কঠিন না। ইতিহাস বলছে যে, এই মাঠে খেলতে আসতেন কোচবিহার রাজপরিবারের সদস্যরাও। দুর্ভাগ্য, আজকের কালচিনিতে সেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কালচিনি তথা ডুয়ার্সের এক গৌরবময় ইতিহাস ঢেকে ফেলেছে জঙ্গল। হয়ত কান পাতলে সেখানে শোনা যেতে পারে অতীতের দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

ছবি - কালচিনি পথে
অনেকটা একই দশা কালচিনির ডাকবাংলোর। তবু মন্দের ভাল যে, প. ব. সরকারের একটি অফিস সেখানে আছে। কিন্তু শালকাঠ নির্মিত দোতালা ডাকবাংলোটির আক্ষরিক অর্থেই ভগ্নদশা। অথচ গত শতকের তিরিশের দশকে নির্মিত এই ডাকবাংলো ছিল কালচিনির গর্ব। সত্যি বলতে, ডুয়ার্সের ছোট ছোট জনপদগুলিতে একটা সময় কাঠ নির্মিত ডাকবাংলোগুলি ছিল সেই জনপদের মুকুটে উজ্জ্বল পালকের মতো। কিন্তু কালের যাত্রায় আর আমাদের চরম উদাসীনতায় সেগুলির সৌন্দর্য্যের আর আভিজাত্যের মৃত্যু হয়েছে। কাঠের তৈরি সুরম্য ডাকবাংলোগুলির স্থান নিয়েছে দেশলাইয়ের খোপের মতো আধুনিক পাকা বাড়ি। কালচিনির আর একটি গর্ব সার্জেন্ট কুঠিও হারিয়ে যাওয়ার মুখে। সামরিক দিক থেকে ইংরেজ আমলে এই সার্জেন্ট কুঠির গুরুত্ব ছিল প্রবল। এখানে নর্থ বেঙ্গল মাউন্টেড রাইফেলসের অফিস স্থাপন করা হয় সেই সময়। উদ্দেশ্য ছিল, ভুটান সীমান্ত রক্ষা করা। বক্সা ফোর্টে এই সেনাবাহিনীর মূল কার্যালয় হলেও, জরুরি প্রয়োজনে সার্জেন্ট কুঠির ওপর দায়িত্ব এসে পড়ত। ফলে সীমান্ত রক্ষার মতো গুরুদায়িত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সার্জেন্ট কুঠির নাম।
কালচিনি থেকে উত্তরদিকে চুয়াপাড়া চা-বাগানের দিকে যেতে প্রশস্ত রাজপথটিও ইংরেজ আমলে তৈরি। একথা ঠিক যে, মুনাফা লাভ মূল উদ্দেশ্য হলেও ব্রিটিশদের কিন্তু নান্দনিক বিষয়েও যথেষ্ট নজর ছিল। আর তার ফলস্বরূপ ছায়াবীথি ঘেরা এই রাস্তাটি আজও ডুয়ার্সের অন্যতম সেরা সেরা পথ। দুর্ভাগ্য যে, রাস্তার দুই ধার থেকে শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহের সংখ্যা দিনদিন কমে আসছে। গগনচুম্বী কিছু বৃক্ষ ইতিমধ্যে কেটে ফেলাও হয়েছে। তবু, ডুয়ার্স দর্শনে দুই ধারে চা-বাগান শোভিত এই পথটি যে কোনও পর্যটকের মনে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ে রইবে। এই পথে সামান্য এগিয়ে ডান হাতে চা-বাগান চিরে পথ চলে গেছে রায়মাটাং। খানিক পর এসএসবি ক্যাম্প আর তারপর বিরাট নদী পার হলেই সামান্য উচ্চতায় রূপসী রায়মাটাং। বর্ষাকালে সে পথ অত্যন্ত দুর্গম হলেও, অন্যান্য সময়ে রায়মাটাং-এর টানে ছুটে চলেন পর্যটকেরা। ইদানিং হোম স্টের ছড়াছড়ি এখানেও, ডুয়ার্সের অন্য জনপদগুলোর মতো।
রাজপথে ডান হাতে না গিয়ে যদি সোজা চলে যাওয়া যায়, তবে চুয়াপাড়া চা-বাগান পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা-বাগানে। পানা নদীর ধারে কিছুটা উচ্চতায় এই চা-বাগান সৌন্দর্যে হার মানাতে পারে ডুয়ার্স-সহ উত্তরের বহু চা-বাগানকে। এই চা-বাগানের নাম শোনা মাত্র অনেকের হয়ত সুখানি দেবী আর সুমিত্রা দেবীর কথা মনে পড়ে যাবে। ডাইনি সন্দেহে একসময় এদের হত্যা করা হয়েছিল এই চা-বাগানে। এখানে বোধহয় একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলিতে কিন্তু আজও দারিদ্র, অপুষ্টি, অশিক্ষার পাশাপাশি অন্ধ কুসংস্কার বহু মাত্রায় রয়ে গেছে। ফলে, একবিংশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকে এসে ডাইনি ইত্যাদি কথাগুলি আমাদের আজব মনে হলেও, চা-বাগানের সবুজ গালিচায় কান পাতলে মাঝেমাঝে শোনা যায় তাদের ফিসফিসানি। যাহোক, সেই অবস্থা বহুলাংশে কেটে গেছে। পানা নদীর তীরে ছিপছিপি সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা-বাগানের আর একটি অসাধারণ জায়গা। নদীর ওপারে অদূরে ভুটান পাহাড়ের সবুজ সৌন্দর্য সম্মোহিত যেমন সম্মোহিত করে, তেমনি ছিপছিপির নির্জনতা মনে করায় ইংল্যান্ডের ওয়েলস বা লেক ডিস্ট্রিক্টকে। আবার বাগানের অন্য এক প্রান্ত থেকে দেখা যায় ভুটানের পাশাখার শিল্পকেন্দ্রের ঝলক।

ছবি - চুয়াপাড়া চা-বাগান
সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা-বাগানের পাশাপাশি কিন্তু চুয়াপাড়া চা-বাগানকে ভুলে চলবে না। এই চা-বাগানেই রয়েছে চুয়াপাড়া ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাব, যা ডুয়ার্সের প্রাচীনতম ক্লাব বলে পরিচিত। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৯ সালে। সবুজ চা-বাগান ঘেরা কালচিনির আর এক গর্ব ডিমা চা-বাগান। ডিমা নদীর নিকটস্থ এই চা-বাগানে ১৯৩৩ থেকে দুর্গাপূজা শুরু হয়। এই পূজা বিশেষ উল্লেখের কারণ রাখে, কেননা তখনও পর্যন্ত ডুয়ার্সের চা-বলয়ে কোনরকম পূজা হত না। সুন্দর সাজানো ডিমা চা-বাগানের সেই পূজা আজও দর্শনীয়। সত্যি বলতে কালচিনিকে ঘিরে যে বিভিন্ন দুর্গাপূজা হয়, তাদের প্রতিটি অর্ধ-শতাব্দী পার করেছে। এই পূজাগুলিতে কর্পোরেট দুনিয়ার বিত্ত বৈভবের স্পর্শ না থাকলেও রয়েছে আন্তরিকতার ছোঁওয়া, যা অত্যন্ত মানানসই ডুয়ার্সের চরিত্রের সঙ্গে। ডিমা নদী কিন্তু একসময় এই এলাকার ত্রাস ছিল। শুকনো নদীতে হঠাৎ হঠাৎ প্রবল জলস্ফীতি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করত। এই কিছুদিন আগেও ব্রিজ না থাকায়, রাজাভাতখাওয়া যেতে নদীর শুকনো খাত ছিল একমাত্র ভরসা। শোনা যায় যে, নদী শুকনো দেখে গাড়ি এপার থেকে ওপারে যেতে গিয়ে হঠাৎ জল চলে আসায় বিপদে পড়েছে বহুবার। আজ অবশ্য সেসব দিন অতীত। ঝকঝকে ডিমা ব্রিজে দাঁড়ালে উত্তরে দেখা যায় ভুটান পাহাড়ের নীল রেখা। ব্রিজের একধারে ঘন অরণ্য, অন্যদিকে চা-বাগান। আর একদিকে রয়েছে রেল ব্রিজ। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত না হয়ে উপায় নেই।

ছবি - ডিমা
ডিমা ব্রিজ পার করে একটু এগোলে রাজাভাতখাওয়া। কালচিনি থেকে তেরো কিমি দূরের এই ছোট্ট জনপদটি বক্সা ও জয়ন্তীর গেটওয়ে। রাজাভাতখাওয়া নামটির পেছনে যে ইতিহাসটি প্রচলিত সেটি হল কোচবিহারের মহারাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ ভূটান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে যে জায়গায় প্রথম অন্নাহার করেন সেটিই রাজাভাতখাওয়া। খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমেদ রচিত A HISTORY OF COOCHBEHAR (IN BENGALI), PART 1 থেকে উদ্ধৃত করছি- 'রাজাভাতখাওয়ার অদূরে চেকাখাতা অবস্থিত ছিল। চেকাখাতায় কোচবিহার ও ভূটান রাজের যে বার্ষিক ভোজের অনুষ্ঠান হইত, সেই ভোজের স্থান হইতে রাজাভাতখাওয়া নাম সৃষ্ট হইয়া থাকিবে।' আজকের রাজাভাতখাওয়া পাম্পু বস্তি-সহ কিছু বাড়িঘর ও আদিম অরণ্য নিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। এখানে রয়েছে 'নেচার ইনটারপ্রিটেশন সেন্টার' এবং ছোট্ট মিউজিয়াম যা উদ্বোধন করেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার। রয়েছে নার্সারি। এখান থেকে বনবিভাগের চেকপোস্ট পার করে যাওয়া যায় বক্সার দিকে। বক্সা আসবার খানিক আগে ডানদিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোলে পাওয়া যাবে জয়ন্তীকে। সোজা পথে সান্তালাবাড়ি হয়ে বক্সা ও আরও ওপরে লেপচাখা। জানা-অজানা গাছে ভর্তি রাজাভাতখাওয়া সত্যিই আদিম যেন এখনও।
চা-বাগান ঘেরা কালচিনি কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাতৃভূমি। ১৯৪৬ সালে রেশনের খারাপ চালের বিরুদ্ধে চা-বাগানের শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখান কালচিনিতে। সেই আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল ডুয়ার্সের অন্যান্য চা-বাগানে। আক্রান্ত হন চা-বাগানের বাবু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পরবর্তীতে এই আক্রান্ত সমাজ টি গার্ডেন এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন গঠন করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। কালচিনিকে মূল অফিস করে ট্রেড আন্দোলন ছড়িয়ে পরে ডুয়ার্সের প্রায় সর্বত্র। বাম ও দক্ষিণ পন্থী দুই দলেরই মূল অফিস তৈরি হয় কালচিনি ও হ্যামিল্টনগঞ্জে। ১৯৫৫ সালে কালচিনিতে ঘটে যাওয়া বামপন্থী শ্রমিক-আন্দোলন খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছিল। আজ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অনেক বেনোজল ঢুকলেও সেদিনের ইতিহাস কালচিনির রাজনৈতিক সচেতনতার কথাই বলে।
আজকের কালচিনির জনসংখ্যা ২৭৯৬৮৪। তপশিলি জাতি ও উপজাতির সংখ্যা হল যথাক্রমে ৩৬৩৫৪ ও ১৯২৯৬০। রয়েছে ৩৩৬২৯ বৌদ্ধ ও ক্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে যে, কালচিনির মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ জনজাতি অধ্যূষিত। অবশ্য ইদানিং হিন্দি সংস্কৃতির দাপটে দেশের অন্য জায়গার মতোই কালচিনিও প্রভাবিত। তবু তার মধ্যে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কালচিনির ইউনিয়ন একাডেমি-সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এই অঞ্চলে শিক্ষাবিস্তারে তাদের অবিরাম প্রচেষ্টা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ইউনিয়ন একাডেমির প্রথম প্রধানশিক্ষক ছিলেন শিক্ষাব্রতী শ্রদ্ধেয় হেরম্ব চন্দ্র নন্দী। এই বিদ্যালয় ডিমা চা-বাগানের প্রতিষ্ঠাতা হরকুমার সান্যাল, তদানীন্তন সাংসদ এস পি রায়, নিমতিঝোরা চা-বাগানের ম্যানেজার সুধীর কুমার গুহ প্রমুখের সাহায্য পেয়েছিল। ১৯৬০ সালে কালচিনিতে হিন্দি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কাজিমান গোলে তামাং ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারে তাঁর জীবদ্দশায় একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই বিদ্যালয়ের অবস্থা আজ সঙ্গীন।
কালচিনির অতীতের আর এক গর্ব ছিল বক্সা ডুয়ার্স স্টাফ ক্লাব। তিনটি বাগানের বাবুদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে গঠিত এই ক্লাব কালচিনির বুকে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিল। পাশাপাশি ক্লাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে ডুয়ার্সের বুকে এই ক্লাবে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হত নানা ধরণের সংস্কৃতিক কর্মকান্ড। আর তাতে যোগ দিতেন প্রথিতযশা মানুষেরা। আর জি শ এন্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার স্যার চার্লস স্পাইলস, অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী, ঔপন্যাসিক গজেন্দ্রনাথ মিত্র, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অধ্যপক কবি বেনু দত্ত রায়, সাহিত্যিক জগন্নাথ বিশ্বাস প্রমুখেরা এই ক্লাবের নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন একসময়। (সূত্র: কালচিনি- সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়) কিন্তু সেসব আজ সবই ইতিহাস।

ছবি - রায়মাটাং
অতীতের সেই কালচিনি আজ আর নেই। একথা মানতেই হয়। কিন্তু কষ্ট হলেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল অনিবার্য। কিন্তু মুশকিল তখনই হয়, যখন সে বদল অতীতকে ভুলে যায়। কালচিনির ইতিহাস এই জনপদের সমৃদ্ধিকেই তুলে ধরে। সেজন্যই দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে আসা বহু মানুষ কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার বা শিলিগুড়ির মতো শহরে না থেকে বেছে নিয়েছিলেন কালচিনিকে। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, সংস্কৃতিতে কালচিনি তখন পথ দেখাচ্ছে সমগ্র ডুয়ার্সকে। প্রখ্যাত মানুষদের পায়ের ধুলো পড়ছে এই ছোট্ট জনপদে। কিন্তু আজ নিছকই এক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে কালচিনি। জবরদখলে রাস্তা ক্রমশ ছোট হচ্ছে। বাড়ছে দূষণ। চা-বাগানগুলিতে দারিদ্র, অশিক্ষা এমন থাবা বসিয়েছে যে, সক্রিয় হয়ে উঠছে সমাজবিরোধীরা। আড়কাঠিদের হাতে পড়ে চা-বাগানের কিশোরী-নারীদের স্থান হচ্ছে মহানগরের অন্ধকার গলিতে। যে সংস্কৃতির জন্য একসময় কালচিনিকে সবাই সমীহ করত, সেখান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে আজকের কালচিনি। কালচিনির অতীত আর বর্তমান বোধহয় কাজিমান গোলের এই কবিতাতেই ফুটে উঠেছে-
বিশ্বায়ন কো হুরিলে ইয়ো কসতো ভয়ো/ জুরাবা কো সর্পিনা জাতি মলৈ স্বপ্ন রহো/ ১৮৬৫ কুলী ভই আয়ো/ ঝার ডঙ্গল সবেই ফাড়ী চিয়া বোট লায়ে/ মধেস বাটা বঙ্গ সন্তান নুবা খোলি ঘর থে / বরখা ঝরি ইয়োলে জরো মলেরিয়া কো খানি/ দুঃখ কষ্ট সহি বাঁচনে লাগায়া হামরো বাগী / ১৮ দিন কো হরতাল ১৯৫৫ সাল/ লড়াই লড়াই ভয়ো চিয়া বাগানমা/ ফন্ড পৈসা গ্রেচুটি পৈসা বোনস বগান মা/ লাঠি চলয়ো গোলি চলয়ো এক মাগদা খেরি/ অবো চুপ লাগি বসে য়স তৈ হুনছা ফেরি/ শোষক র সামন্তী কো হল্লা কুনৈ রং/ গোরা গয়ে কাল আয়ে সবকো এউতে ঢং/ নয়া উদ্যোগ নয়া শিল্প কো কুয়া সধৈ হুনছ/ ডেড় সয় বর্ষ পুরানো চিয়া শিল্প/ খুরু খুরু রুনছ।
(বিশ্বায়নের ঝড়ে সব বয়ে গেল। পূর্বজদের ধন মনে রয়ে গেল। ১৮৫৫তে কুলী হয়ে আসি। গভীর অরণ্য কেটে চা পত্তন করি। ঢাকা ময়মনসিং থেকে বঙ্গ সন্তান, নোয়াখালী থেকে রাঁচি, বৃষ্টি কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়া থেকে লড়াই লড়াই করে বাঁচি। ১৪ দিনের হরতাল ১৯৫৫ সাল, তীব্রতার আন্দোলন হল চা-বাগানে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বোনাস, মজুরি লড়াই করে আদায় হল চা-বাগানে। লাঠি ও গুলি খেতে হল দাবি আদায়ে। শাসক আর সামন্তদের হয় না কোনো রং/ গোরা কালা সবার একই ঢং/ নতুন উদ্যোগ আর শিল্পের কথা সবাই বলে/ ১৫০ বছরের পুরোনো শিল্প রুগ্ন হয়ে গেল।)
রুগ্ন হয়ে গেছে কালচিনিও। তবু আশা নিয়ে বেঁচে থাকে সে, মিষ্টি কালো বধুর মতোই স্বপ্ন দেখে সুন্দর দিনের।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
