× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105716.jpg
×
সংখ্যা: ডিসেম্বর, ২০২১
সম্পাদকের কলম
হিমেল রূপকথা
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
পর্যটনের ডুয়ার্স
তিস্তাবুড়ি খোয়াজপীর-এর দেশে
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
পর্যটনের ডুয়ার্স
রয়্যাল ইকো হাট। নিস্তব্ধতার রাজকীয় উদযাপন
শ্বেতা সরখেল
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
গ্রামীণ উত্তরণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ লিপিতে কী লেখা আছে কে জানে! পর্ব - ৬
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। পর্ব - ২
সব্যসাচী দত্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৪
সুজিত দাস
নিয়মিত কলম
মুর্শিদাবাদ মেইল। ড্যাডাং মহারাজ
জাহির রায়হান
নিয়মিত কলম
ল্যাব ডিটেকটিভ। পর্ব ৪। পচা লাশ থেকে খুনির খোঁজ মেলে কিলবিল করা পোকাদের সাহায্যেই
নিখিলেশ রায়চৌধুরী
নিয়মিত কলম
আমচরিত কথা। পর্ব – ১০। ক্ষ্যামা দে শ্যামা!
তনুশ্রী পাল
নিয়মিত কলম
এই ডুয়ার্স কি তোমার চেনা? কালচিনি, ও করোয়া জানি
শৌভিক রায়
বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ভারতীয় নারী
পূর্ণিমা সিংহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম পিএইচডি নারী
রাখি পুরকায়স্থ
পুরানের নারী
রানী বপুষ্টমার কথা
শাঁওলি দে
পাতাবাহার
বারান্দায় বাগানবাহার
পাতা মিত্র

তিস্তাবুড়ি খোয়াজপীর-এর দেশে

নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
TistaBuri_KhoyajPir

দুপুর নাগাদ হঠাৎ করেই আকাশটা অভিমানি হয়ে গেল। দখিনা বাতাস শন্ শন্ করে ছুটে এলো তার অভিমান কাটাতে। এদিকে তিস্তাবুড়ি আর খোয়াজপীরের হাতছানি পৌঁছে যায় আমার ড্রয়িংরুমে। স্নান খাওয়াদাওয়া করে ক্যামেরাটা পিঠব্যাগে ঢুকিয়ে ধান্যুকে নিয়ে দে ছুট।

তিস্তার বাঁধের উপর উঠতেই ডাংগুটি বালকদের সাথে দেখা। বাইক থামাতেই তারা অবাক। ওদের হাত থেকে খেলার লাঠিটা নিয়ে নিলাম। গর্ত থেকে কাঠের গুটি লাঠি মেরে উঠিয়েই দিলাম ডাং। এক ডাং-এ গুটি অনেকদূর। বহুদিন পর এই ডাং-গুটি বয়সটাকে নিমেষে পঁয়ত্রিশ কমিয়ে দিলো। সেলফি তোলা ভুলে গিয়ে বাইক এগোয় ধুলো উড়িয়ে। বাঁধের পাশের বড় বড় গাছের নীচে কত রঙের আড্ডাই না দেখা যাচ্ছে। বুড়োর দল খালি গায়ে গলায় গামছা দিয়ে তাস পেটাচ্ছে। মাঝবয়সীরা বট পাকুড়ের ছায়ায় ক্যারামে মজেছে। খানিক দূরে দূরেই বট-পাকুড়ে আলিঙ্গন। কেউবা মাঝবয়সে আবার কেউবা বার্ধক্যে। গোড়াগুলি তাদের লাল শালু দিয়ে বাঁধা। বৃক্ষতলে ত্রিশুল আর শিবলিঙ্গের সহাবস্থান সর্বত্রই। শিব মন্দির, কালী মন্দির, রাধাকৃষ্ণ আর মনসা মন্দিরগুলি জরাজীর্ণ হলেও সেজে ওঠে নির্দিষ্ট দিনেই। সাধু সমাগমের দু-একটি স্থান নজরে আসে পথ চলতে চলতেই।

দু'পাশে ঝুপড়ি আর জঙ্গলের চাপে বাঁধপথ ছোট হয়ে যায় মাঝে মাঝেই। গলায় তুলসী আর কাঁধে পৈতে ঝোলানো শীর্ণ শরীরটি আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বিড়ির সুখটানে মগ্ন। বাঁধঘেষা ঘরগুলির পাশেই গোয়াল ঘর, পোয়ালের পুঞ্জি (খড়ের গাদা), বাঁশের চাংড়ি। গাছের ছায়ার প্রতিটি চাংড়ি বড্ড মায়াবীনি হয়ে শায়িত। চাংড়ির উপর বসে মা একমনে তার মেয়ের চুল থেকে মণিমুক্তা খুঁজে চলেছেন। মধ্যবয়সি কাকীমা-জেঠিমারা ঘুঁটে সাজাচ্ছেন কুটিরের দেওয়ালে। বাঁধ ঘেঁষে অনেক ছাউনির গোপন গোপন কথা শোনা যায় কান পাতলেই। ছাউনির নীচে পিল করে সাজানো জ্বালানি কাঠগুলি প্রতিনিয়ত ফুটিয়ে তুলছে তিস্তাপারের কঠিন সংগ্রাম। নানান নামের তিস্তাভাসা কাঠের লগগুলি বাঁধের উপরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। ক্লান্ত হয়ে পড়া থার্মোকলের ভুঁড়াগুলি (ভেলা) বাঁধের পাশেই পরে রয়েছে নতুন করে সেজে উঠার অপেক্ষায়। স্বর্ণলতার সাথে কুলগাছের মিথোজীবিতা ক্ষণে ক্ষণেই ভালোবাসার গল্প শুনিয়ে চলে। এ রাস্তায় বেড়াল কাটে না। তবে গরুর দড়ি, ছাগলের দড়ি গতি থামায়। গামছাকে শাড়ি বানিয়ে পরা খুচরো পয়সার দলও গতি থামিয়েছে বহুবার। কত সংসার তাদের। এ.পি.এল. না বি.পি.এল. বোঝা বড়ো দায়। শুধু রান্নাবাটি নয় বর-বউ সেজে বিয়ের অনুষ্ঠানও চলছে পুরোদমে। এসব দেখতে দেখতেই বাঁধের উপর নানা রঙের একখানি লাইটের গেট। ওখান থেকে ফুল ভলিয়ুমে কানে আঘাত করছে, 'মোর আঠারা সাল হুই গিলাক রে....রে বাবা সাধি করাই দে...'

রাখাল বালকেরা ঘরে ফিরছে দল বেঁধে। কৃষিশ্রমিকেরা মেঘ-হাওয়ার দৌলতে আজ ছুটি পেয়েছে তাড়াতাড়ি। গোয়ালারা দুধ নিয়ে ফিরছে বালি পথে। কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে পুরুষ আর মহিলারাও ঘরের পথে। কেউ বা সাইকেলে। তিস্তার জলে অস্তগামী সূর্য বার্তা পাঠিয়েছে একটু আগেই। আমি আর ধান্যু লালে মাখামাখি হয়ে প্রবেশ করছি সেপথেই। যে পথ তাঁরা ছেড়ে এসেছে। ওই পলিচর আর বালিচরের দিকেই।

দিনে দিনে বদলে যায় তিস্তাবক্ষ। সপ্তাহখানেক আগের রুক্ষ দৃশ্যপটে আজ প্রাণের পরশ। বাঁধের পাশ কেটে অনেক রাস্তা নেমে গেছে তিস্তার ভেতর। এ-রাস্তা ট্রাক্টরের, এ-রাস্তা ডাম্পারের। উনাদের দাপটে পাখিরা তাদের সংসার নিয়ে ঘর বেঁধেছে অনেক দূরে। ওরাও শান্তি চায়। স্বাধীনতা চায়; চায় অবাধ বিচরণ। বোল্ডার-তারজালির শক্তপোক্ত বাঁধটি অনেক কথাই বলতে চাইছে। কিন্তু সে ভাষা পৌঁছায় না-  কৃষক, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার কান পর্যন্ত। তার সাবধান বাণী বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না তাঁদের। এমনই এক রাস্তা দিয়ে পাথরে হোঁচট খেতে খেতে ঢুকে গেলাম তিস্তাচরে। আমূল পরিবর্তন। দিন সাতেক আগের বালুচরকে পলিচরে সাজিয়ে দিয়েছে পাহাড়ে আসা আকস্মিক বৃষ্টি। গজলডোবার লকগেট ছাড়ায় এক রাতেই বালুকারাশি ভিজেছে নতুন জলে। এ জল নতুন হলেও বড্ড ঘোলাটে। কিছু কিছু পশু-পাখির কাছে তা বিষাক্ত জলও বটে। 

প্রকৃতির বিউটি পার্লারে আজ তিস্তাবুড়ি। ঘোলাজলের পলির প্রলেপ মেখে সে আকাশ আয়নায় মুখ দেখে চলেছে। বুড়ির বুকে ট্র্যাক্টরের তৈরি করা দণ্ডীর গভীরতা অনেকটাই বেশি। এতো শুধু দণ্ডী নয়। বেদনাদায়ক ক্ষতও বটে। সামনের বর্ষায় এই পথ ধরেই তিস্তা এসে ধাক্কা দেবে বাঁধে। গতি বদলে বইবে অন্য পথে। খানিকটা এগোতেই তিস্তার সোঁত। এ সোঁত যেন পা ধুইয়ে দেবার এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। যে নৌকাগুলি সোঁতের মাঝে কিছুদিন আগেই হঠাৎ করে দুলে উঠেছিল আজ তারা আবার প্রাণ হারিয়ে একে অপরের গা ঘেঁষে পড়ে রয়েছে কাদাবালির উপর। ওদের গায়ে পলির আল্পনায় অনেক কিছু লেখা রয়েছে। শুধু পড়ে নেওয়ার ক্ষমতাটুকু থাকা চাই। চাতক পাখির মত ওরাও হাঁ করে আকাশপানে চেয়ে। কবে বৃষ্টি এসে ভরবে তার বুক? বুকের জল ছেঁকে মাঝি ভাইয়েরা সাজিয়ে তুলবে তাদের। মধ্যতিস্তার ঢেউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলা হয়নি যে অনেকদিন।

ডান দিকের হোগলা বনে মৈষাল ও রাখালেরা আগুন লাগিয়েছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। পুরনো হোগলা পুড়ে গিয়ে সেখানেই শিশু হোগলারা মাথা তুলেছে। জন্ম নিয়েছে নানা প্রজাতির ঘাস। সবুজ হয়েছে চর। হাজার কীটপতঙ্গ, সাপ, খরগোশ আর পাখির ডিম সেদিন পুড়ে ছারখার হচ্ছিল চোখের সামনেই। স্বার্থপরের মত ছবি তোলা আর ভিডিও করা বাদ যায়নি আমার। একদিকে অনিচ্ছাকৃত অকাল-মৃত্যু আরেক দিকে বেঁচে থাকার রসদের সংস্থান। এ রসদ তিস্তাচরের মহিষের, এ রসদ গরু-বাছুর আর ছাগলের। আগুনকে সাক্ষী রেখেই মৈষাল বন্ধুর সাথে গল্পে মজেছিলাম । জঙ্গল জ্বলবার ফটফট আওয়াজ, সাদা কালো ধোঁয়ার মাঝ থেকে বেড়িয়ে আসা লাল আগুন উত্তাপ ছড়ায় । উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে তার সেই ব্যাঙ্গাত্মক উক্তি, ‘এটাই বাস্তুতন্ত্র, এটাই বায়োডাইভার্সিটি’।

কে বলেছে তিস্তা রাক্ষুসী? কে বলে তিস্তা ভয়ংকরী? যে মানুষগুলির ভিটেমাটি বছরের পর বছর ভাসে তিস্তার জলে, বিঘার পর বিঘা জমি নষ্ট করে তিস্তার উদ্দাম যৌবন, তারা কখনই তিস্তা শব্দটির আগে এই শহুরে বিশেষণগুলি প্রয়োগ করেন না। তাদের কাছে তিস্তা মাতৃসম পূজ্য। কাজী-কার্তিক, গাজী-গণেশ, সত্যপীর-সত্যনারায়ণের এই মাটিতে তিস্তা হলেন তাঁদের আরাধ্য 'তিস্তাবুড়ি’; তিস্তা হলেন তাদের আরাধ্য 'খোয়াজপীর'। তিস্তার জল-হাওয়ার মায়ায়, তিস্তার দূন-পানির আবহে বারোমাস স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। তিস্তা মায়ের প্রতি তাঁদের নেই বিন্দুমাত্র ক্ষোভ, নেই কোনও অভিমান। তাঁরা বিশ্বাস করেন তিস্তা-মা আজ সবকিছু কেড়ে নিলেও ফিরিয়ে দেবেন সুদ সমে’ই। এটাই তিস্তাপারের আবেগ, এটাই তিস্তাচরের অনুভূতি। চার মাসের কষ্ট আর আট মাসের সুখ-শান্তি, এই নিয়েই তো বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা।

সম্প্রীতির হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে এগিয়ে চলেছি আমার পরবাসের দিকে। এই ‘পরবাস’ নিজ হাতে তৈরি করে দিয়েছেন আমির ভাই আর মংলু ভাই। তাঁদের মাঝে কোনও ভেদাভেদ নেই। তিস্তাবুড়ির পূজা আর বেরাভাসানি উৎসব পালন করেন একই সাথে। ‘অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন’- চাঁদা তুলে আয়োজন করেন মিলিত হয়েই। একজন বিপদে পড়লে সবাই মিলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। কে হিন্দু আর কে মুসলমান এ প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর এই অল্পশিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া মানুষগুলির কাছে।

বন্যার জল ঘরের চাল পর্যন্ত উঠে গেলে তাঁরা থার্মোকলের ভুরায় (ভেলা) থালা-বাটি-কম্বল আর মুরগী ছাগল নিয়ে ভাসেন। ভুরার দড়ি বাঁধেন হরিদাসবাবু বা দেবারু ভাইয়ের শক্ত চালের খুঁটিতে। এক হাঁড়িতেই রান্না চলে দিন দুই-তিন। জল কমে গেলে পলি মাখে তাঁদের ভিটেমাটি। এই পলি কোনও অভিশাপ নয়, এ পলি যে তিস্তা মায়ের আশীর্বাদ। তিস্তাবুড়িকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার প্রতিদান। আজ আমিরদার সেই উক্তি খুব মনে পড়ছে? 'যতই জল বাড়ুক না কেন আমরা তিস্তা মাকে ছেড়ে যাইনা দাদা। মরলে সবাই একসাথেই মরবো। বাঁচলে সবাই একসাথেই বাঁচবো। আর ভয় কীসের? তিস্তায় ডুবলে খোয়াজপীর আমাদের টেনে তুলবেই’।

বাইক এগিয়ে চলে। কত ঝাউগাছ এখন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে তিস্তাবক্ষের। ভাবনির জীর্ণ বুকে সবুজ ছিটিয়েছে। দখিনা হাওয়ায় ঝাউগাছেরা আজ নৃত্যরত। পাশেই প্রায় শুয়ে থাকা ভাবনির দল তা উপভোগ করে চলে। ছন্দে আনন্দে বেদনা ক্লিষ্ট  বুক নিয়ে তারাও দুলে উঠছে। আর তো মাত্র কিছুদিন । তারপর তাদের একসাথেই ডুবতে হবে তিস্তার জলে। একসাথেই হারিয়ে যাবে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্নে। পাহাড়ের ঝাউ আর সমতলের কাশের এই অদৃশ্য প্রেম, বার্তা দেয় সম্প্রীতির। এ বার্তা সৌভ্রাতৃত্ববোধ ও মৈত্রীর।

দণ্ডী শেষ হয়েছে। এবার পলিবালির ঘন ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে ধান্যুর দুই চাকা। ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে নয়, দূরে ওই পরবাসের টানে ফার্ষ্ট গিয়ারে ফুল এক্সিলেটর। বালির বাঁধনকে আলগা করে প্রবেশ করলাম তিস্তার দ্বিতীয় সোঁতের মাঝে।

দ্বিতীয় সোঁতের মাঝে পৌঁছে বাইক থামাতে বাধ্য হলাম। দু'দিন আগের বৃষ্টিতে জল বেড়েছে অনেকটাই। জলে নেমেই বাইক ঘুরিয়ে অন্য পথ ধরলাম। সোঁতের ধার বরাবর কিলোমিটার দু'য়েক চলবার পর অল্প জল নজরে এলো। বাইকের চাকা পলিবালির মাঝে অনেকটা ডুবে গেলেও ধান্যুর ইঞ্জিনের সাথে তারা আর পেরে উঠলো না। গো-গো আওয়াজ ছেড়ে এবার আমরা বালুচরে। চরের মাঝে চাকার আঁকিবুঁকি করতে করতে ট্রাক্টর চলবার দণ্ডী মিলে যায়। এ দণ্ডী নিয়ে যাবে পরবাসের দিকেই।

কিছুদূর যেতেই দণ্ডী উধাও। এবার সবুজে ঢাকা বিস্তৃত সমতল ভূমি। গোটা বিশেক ফুটবল মাঠ তৈরি হতে পারে নিমেষেই। সবুজ ঘাসের উপর চরে বেরাচ্ছে গরু-মহিষের দল। কষ্টের কয়েক মাস কাটিয়ে আজ তারা ভীষণ খুশি। দক্ষিণা বাতাস ফাঁকা মাঠ পেয়ে শন শন করে বইছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে সুর সৃষ্টি করে মহিষের গলার ঘন্টির টুংটাং। শন-শন, টুংটাং এর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পরে পাখিদের কলকাকলি। ওরাও যেন আজ খুশিতে আত্মহারা।

ইতিমধ্যে ঈশান কোণের কালো মেঘ ছেয়ে যায় মাথার উপর। মেঘের ভেতর থেকে কোন এক অজানা ফটোগ্রাফার ক্রমাগত ফ্ল্যাশ মারতে শুরু করে। হাওয়ার গতি বাড়ে কয়েক গুণ। বুঝতে বাকি রইলো না দুনবাবা (কালবৈশাখী) আসতে চলেছে। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। তিস্তাবক্ষের মাঝে থেকে এই দুনের অভিজ্ঞতাই তো আমি নিতে চেয়েছিলাম। সে কারণেই তো আজ এই অসময়ে বেরিয়ে পড়া। এই ভয়াল পরিবেশে পরবাসে থাকবো। হোগলার বেড়া ফাঁকা করে দুনের হৃদয় কাঁপানো রূপ স্বচক্ষে দেখবো, প্লাষ্টিক আর ভাবনির চালে দুমদাম পাথর পড়বে, ঝপঝপ বৃষ্টি শুরু হলে ছাতা মাথায় তিস্তাবক্ষ চষে বেরাবো, আরো অনেক কিছু......

আল্লার ষাঁড়টি লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে শুরু করে ডানদিকেই। গরু-মহিষেরা বিপদের সংকেত পেয়ে যে যার ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করে। আমি আর ধান্যুও তাদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলি। ঠিক কোন দিকে বাঁক নিলে পরবাস পৌঁছাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আকাশ ইতিমধ্যে কালো থেকে ঘন কালো হয়ে উঠেছে। বিদ্যুতের চমকানি-ধমকানি আর মেঘের গর্জনে আবার ফুল এক্সিলেটর। তীব্র গতির দক্ষিণার সাথে এবার আমার অসম লড়াই শুরু হয়েছে। বড় বড় বালিকণা চোখে মুখে এসে ধাক্কা মারছে। যেন ওরা আজ আমায় ফিরিয়ে দিতে চাইছে।

সামনেই নজরে এল কুলগাছ দুটির। এ গাছদুটি আমার ভীষণ চেনা। চারচরের মানুষেরা বলেন এই গাছে তিস্তাডোবা ও তিস্তাভাসা মৃত মানুষের আত্মারা থাকে। রাতের বেলায় তারা চরে চরে ঘুরে বেরায়। ওনারা মাঝে মাঝেই নাকি চলমান আত্মাদের দলবদ্ধভাবে দেখতে পান। দু-একবার মাঝরাতে আমিও পরবাস থেকে পাঁচব্যাটারির টর্চ মেরেছিলাম ওদিকে তাক করেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য নজরে কিছু আসে নি। ভুতের ভয় আমার বিন্দুমাত্রও নেই। ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাসও করি না। তাই সেই কুলগাছ দুটির মাঝ দিয়েই এগিয়ে চললাম। আর খানিকটা এগোলেই যে আমার পরবাস।

কুলগাছ দুটি পেরিয়ে মিটার পঞ্চাশ এগোতেই বাইকের ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। দূরে কৃষ্ণকালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে হলদে পরবাস যেন দুম মেরে রয়েছে। ঈশারায় তার বার্তা, 'ভয় নেই আমিতো এখানেই, চলে আসো'। পরবাস দেখতে পেয়ে বাইককে পুনরায় সচল করার কথা ভুলেই গেলাম। প্রাণভরে দু'হাত দু'পাশে ছড়িয়ে গোলগোল ঘুরে প্রকৃতির এহেন রূপের আনন্দ নিয়ে চললাম। বিদ্যুতের সুতীব্র এক ঝলকানি হৃৎকম্প বাড়িয়ে দেওয়ায় ধান্যুর কাছে পৌঁছে যাই। এক কিকেই ধান্যু সচল। বুঝতেই পারছেন ভূত বাবাজীরা এখানে কোনো কেরামতি করেনি। আপন মনে উল্লাস করতে করতেই একেবারে পরবাসের উঠোনে।

বাইকের হর্ণের আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে আমিরদা দরজা খুলে মুখ বের করেন। আমাকে এই অসময়ে দেখে আকাশ থেকে পড়েছেন আমিরদা। চারচরের বাকি ঘরগুলি নতুন কাপড় চোপড় পরে নতুনভাবে সেজে উঠেছে। আসলে এই সময়ে চরের ঘরগুলির খুঁটি বদল করে মেরামত করা হয়। দেওয়া হয় নতুন ছাউনি। চরের মানুষেরা জানেন এটা দুনপানি বা ঝড়বৃষ্টির সময়। নতুন খুঁটি না লাগালে কালবৈশাখি তার তাণ্ডবে কুঁড়েঘরগুলি ঘুড়ির মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমার পরবাস অপেক্ষাকৃত নতুন। শক্তপোক্ত রয়েছে অনেকটাই। প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে চাল দু'টিও অনেক নীচে বাধা হয়েছে। আমিরদার কাছ থেকে চাবি নিয়ে প্রবেশ করি আমার স্বপ্ননীরে। বিছানা, বালিশ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ধুলো আর বালিতে ঢেকে গেছে। হাওয়া না থামলে এ ধুলোবালি পরিষ্কার করে কোনও লাভ নেই। তাই ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। দূরে  খোলা আকাশের নীচে ডোরবাঁধা মহিষের পাল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। বাথানের ঘরটি হেলে গেছে অনেকটাই। সরে যাওয়া চাল ঠিক করার চেষ্টা করে চলেছে পূরণ ভাই আর ভগলুদা। তাকিয়ে রইলাম সেদিকেই।

আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ করেই ঝড় থেমে যায়। হাওয়ার গতি শ্লথ হয়ে আসে। কালো মেঘ সরে গিয়ে দৃশ্যমান এখন চারচরের চারপাশ। তিন চারজন মহিলা পিঠে বস্তা নিয়ে বেরিয়ে আসছে মধ্যতিস্তা থেকে। হয়তো ঝড়ের সময় ধাধিনাতে মুখ লুকিয়ে ছিল সবাই। আমি আজ যে আশায় পরবাসে এসেছিলাম তার খানিকটা পেলেও বাকি থেকে গেল অনেক কিছুই। এটা নিতান্তই স্বার্থপরতা। চারচরের কেউ-ই মনে প্রাণে চান না হঠাৎ আসা এই দুনপানি বা ঝড়বৃষ্টি তাণ্ডব চালাক তাদের ঘরবাড়ির উপর। মেঘ সরে গিয়ে সূর্য উঠে গেল নিমেষেই। ঘরের মানুষেরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলেন। গরু ছাগল ছেড়ে দেওয়া হল। হাতে আর কিছুটা সময় এখনও রয়েছে। তারপরেই অন্ধকার ঘনাবে মাথার উপর; যে অন্ধকারে ভয় থাকবে না, থাকবে এক নতুন ভোরের স্বপ্ন।

আজ সেভাবে লণ্ডভণ্ড হয়নি কিছুই। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফিরতে হবে ঘরে। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ছাড়তে হল চারচর। অস্তগামী সূর্যের হাতছানি লক্ষ্য করে জল, মাটি, কাদা, বালি, পাথর কাটিয়ে হোগলা, ভাবনি, ঝাউ মাড়িয়ে উঠে পরলাম বাঁধে। অন্ধকার হয়েছে চারপাশ। ধান্যুর হেডলাইট জ্বালিয়ে অবশেষে যখন দুই কিটো (জুতা) তিস্তার বালি নিয়ে শহরের গৃহে প্রবেশ করলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা।

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team