বাংলায় যে সময় পাল ও সেন বংশ রাজ্যশাসন করছিল সেসময় তাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ ছিল। কিন্তু প্রান্তিক উত্তরবঙ্গ তথা সমগ্র অসম, উত্তর-পূর্ব ভারত সহ বর্মা অঞ্চলে অন্য এক রাজবংশের ইতিহাস ছিল। তাঁদের মধ্যে মল্লবর্মন, হর্জর বর্মন, ব্রহ্মপাল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ১১১৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রহ্মপাল প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের শেষ রাজা ধর্মপাল পুত্র জয়পালের সময় উত্তরবঙ্গের সমগ্র অঞ্চল পাল রাজবংশ ও পরবর্তীতে সেন রাজবংশের আক্রমণে বিশৃঙ্খল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ১১৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বল্লভদেব এ অঞ্চলের অর্থাৎ কামরূপের শক্তি সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত ১১৯৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনে আরূঢ় ছিলেন। এরপর পৃথু (১১৯৫ খ্রীঃ – ১২২৮ খ্রীঃ), তাঁর পুত্র সন্ধ্যা ও পৌত্র সিন্ধু রাজত্ব করেন।
১২০২ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্মণ সেনের আমলে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে বাংলা মুসলিম শাসনাধীন হয়ে পড়ে। বখতিয়ার নদিয়া ও গৌর বা লক্ষ্মণাবতী জয় করে উত্তরবঙ্গের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। কিন্তু প্রান্তিক উত্তরবঙ্গে সেসময় তিন তিন বার মুসলিম আক্রমণ প্রতিহত করেন কামরূপ রাজ পৃথু। ১২২৮ খ্রীষ্টাব্দে এই সাহসী রাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদের আক্রমণে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মৃত্যু বরণ করেন। পৃথুর পুত্র সন্ধ্যা রায় নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। নাসিরুদ্দিন সসৈন্যে ফিরে গেলেন গৌড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যাও স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। এও বুঝতে পারলেন দ্রুত আক্রমণের মুখে পড়তে হবে।
কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন ততটা তাড়াতাড়ি আক্রমণ হলো না। ইতিমধ্যে নাসিরুদ্দিন মারা গেলেন। সেটা ১২২৯ খ্রীষ্টাব্দ। এরপর গৌড় দখল করলেন গিয়াসউদ্দিন খিলজীর দলভুক্ত ইকতিয়ারউদ্দিন। তিনি মাত্র আঠারো মাস রাজত্ব করলেন। এরপর ১২৩০ খ্রীষ্টাব্দের শেষে ইলতুতমিস তাঁকে পরাজিত করেন এবং আলাউদ্দিন জানিকে গৌড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
এদিকে সন্ধ্যা রায় আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকলেন। পিতা পৃথু রাজ্যের সীমানা বরাবর দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। সন্ধ্যা রায় রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরিয়ে আনলেন বর্তমান কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গোসানিমারিতে। তখনকার কামতাপুরে। কারণ এখানকার ভৌগলিক অবস্থান এমন যে পশ্চিম, দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম যে দিক দিয়েই আক্রমণ হোক না কেন তাৎক্ষণিক, প্রত্যক্ষ ও সুনিয়ন্ত্রিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুব সহজ ছিল। একারণে পরবর্তী রাজাগণ সন্ধ্যার এই রাজনৈতিক ও সমরকৌশলের জন্য কৃতজ্ঞ। সন্ধ্যা তাঁর এই দূরদৃষ্টির জন্য ঐতিহাসিকদেরও বাহবা পেয়েছেন। তিনি ১২৫৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কামতাপুর থেকেই শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। এরপর তিনি প্রশাসনের প্রধানদের নিয়ে ফিরে গেলেন মূল রাজধানী কামরূপে।
ঠিকই চলছিল সব। কিন্তু জীবনের শেষভাগে ১২৫৭ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধে না জড়িয়ে উপায় থাকলো না। কারণ ১২৫৭ খ্রীষ্টাব্দে কামরূপ আক্রমণ করেন ইক্তারউদ্দিন উজবেক। ১২২৯ থেকে ১২৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে গৌড়ে মোট আটজন রাজত্ব করেন। রাজ্যবিস্তারের কোনও চেষ্টা এসময় হয়নি। ১২৫১ খ্রীষ্টাব্দে ইক্তারিউদ্দিন উজবেক ক্ষমতায় এলে স্থিতাবস্থা আসে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান শাসক। সমরনৈতিক কার্যকলাপও তাঁর পোক্ত ছিল। তাই রাজ্যবিস্তারেও মন দিলেন। তিনি রাঢ় অঞ্চল অযোধ্যা দখল করেন। বিহারও তাঁর শাসনাধীন ছিল। এরপর ১২৫৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কামরূপ আক্রমণ করেন। শক্তিশালী সৈন্যবাহিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কামরূপের ওপর। সন্ধ্যা রায় পরিবার, সৈন্য-সামন্ত ও রাজকর্মচারীদের নিয়ে রাজধানী পরিত্যাগ করলেন। করদানের প্রতিশ্রুতিতে রাজ্য ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব পাঠালে উজবেক তা প্রত্যাখ্যান করলেন। এসময় প্রান্তিক উত্তরবঙ্গ ও অসমে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসে।
সন্ধ্যা রায়ের সৈন্যব্যবস্থা তুলনায় ছিল দুর্বল। তাই তিনি জনসাধারণের শক্তিতে বিশ্বাস রাখলেন। সংগঠিত করলেন তাদের। মুসলিমদের অসহযোগিতা করার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজার হাত শক্ত করতে বললেন। এ সময়ের ঘটনা সম্পর্কে সুকুমার দাস তাঁর ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস’-এ লিখেছেন, “জনসাধারণের সব শস্য রাজভান্ডারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হ’ল। যাতে বাজার থেকে কোনও শস্যের যোগান উজবেক না পান। গৃহস্থের উদবৃত্ত শস্য তিনি কিনে নেন বেশি দামে –যাতে লুন্ঠন করেও গ্রামেগঞ্জে খাদ্য না পায় বিদেশি দখলদার। পশু খাদ্য যা ছিল— সব পুড়িয়ে ফেলতে আদেশ দিলেন সন্ধ্যা, যাতে বিজয়ীদের ঘোড়া-হাতি-খচ্চর কোনও পশুখাদ্য না পায়। ইতিহাস রচনাকারী জনপ্রিয় রাজা পৃথুর পুত্র সন্ধ্যা রায়ের দাবির অনুরূপ সহযোগিতা দান করেন জনগণ। নিজেদের অন্ন সংস্থান রাজার হাতে তুলে দিলেন তাঁরা। নিজেদের পশুখাদ্য পুড়িয়ে দিলেন — সিংহাসনচ্যুত রাজার কথায়। দেশের স্বাধীনতা ও মঙ্গলের জন্য জনসাধারণের এই আত্মস্বার্থ ত্যাগ ও ক্ষতিস্বীকার রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সন্ধ্যা রায় এবং জনসাধারণ কামরূপে মুসলিম বাহিনির জীবন যাপন কঠিন করে তুললেন। ওদিকে উজবেক নতুন রাজ্যজয়ের আনন্দে মশগুল। খাদ্যশস্যের অপ্রতুলতা তৈরি করে, পশুখাদ্য পুড়িয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে মৃত্যুব্যুহ তৈরি করলেন জনগণ। এর পাশাপাশি রাজ্যব্যপী নদীবাঁধ কেটে ফেললেন। উজবেকদের জন্য আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হলো বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে। চারপাশ থেকে এই মৃত্যুব্যুহে পর্যুদস্ত হয়ে গেল তারা। আর এই মোক্ষম মুহূর্তে আঘাত হানলেন সন্ধ্যা রায় ও জনগণের শক্তি। পরাস্ত মুসলিম বাহিনি পালাবার পথ পেল না। ইক্তিরউদ্দিন উজবেক বন্দি হলেন এবং মারা গেলেন”।
উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে শুধু নয়, বাংলার ইতিহাসেই এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা রাজা সন্ধ্যার বড় কৃতিত্ব। এ অঞ্চলের মানুষ রাজার কথায় নির্দ্বিধায় নিজেদের সম্পদ যুদ্ধের প্রয়োজনে তুলে দিলেন। প্রাণও। এ তাঁদের গভীর দেশপ্রেমের পরিচয়। আবার রাজা তাঁর উচ্চাসন থেকে নেমে এলেন সাধারণ প্রজার কাছাকাছি। প্রজাদের কাছের লোক হয়ে উঠেছেন তিনি। অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তিনি। প্রজারাও তাঁকে নিজের লোক, নিকট আত্মীয় মনে করেছেন। রাজাও তাঁদের করে তুলতে পেরেছিলেন নিজের, আপনার সম্পর্কের। নিজের অংশের করে নিতে পেরেছিলেন। প্রজাদের মনেও হয়তো সে ধারণা তৈরি হয়েছিল। এই ভাবনার আবহ আর বাংলার আর কোনও অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। নিজেদের রাজবংশী ভাবার বীজ হয়তো বা এই ঘটনাতেই নিহিত ছিল। পরবর্তীতে কোচবিহারের পাঁচশো বছরের ইতিহাসে আমরা লক্ষ্য করি এখানে রাজা প্রজা এক হয়ে যাচ্ছেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে রাজা ও প্রজা একই জনজাতির। ফলে দুজনের মধ্যে গভীর আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। তাই নিজেদের রাজবংশী ভাবতে আর অসুবিধে কোথায়। তবে এই জনজাতিকে রাজবংশী বলার প্রবণতা প্রথমেই এতটা প্রসার পায়নি। কেননা এই বিশাল জনগোষ্ঠী রাজবংশী কিনা, তা নিয়ে মত পালটা মতের বিবাদ দীর্ঘকাল চলেছে। ১৯০১ ও ১৯১১ সালের আদমসুমারিতে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। অবশেষে ইংরেজরা স্বীকার করে নেয় এই জনগোষ্ঠী ‘রাজবংশী’। আবার এমতেরও প্রচলন আছে যে একটি নির্দিষ্ট কথ্যরীতিতে কথা বলেন যাঁরা তাঁরা রাজবংশী। মত পালটা মতের আবহে রাজবংশীরা রয়ে গেছেন প্রাচীন কাল থেকেই নিজের সাংস্কৃতিক ধারাকে অবলম্বন করে। বয়ে নিয়ে চলেছেন ঐতিহ্যকে।
ছবি - রায়সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা
উত্তরবঙ্গে রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিই প্রধান। এই সংস্কৃতিতে অনার্য-আর্য দুইয়েরই মিশ্রণ রয়েছে। সংস্কৃতিই হোক বা রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনই হোক আলোচনা করা যাবে না উত্তরবঙ্গের প্রবাদ পুরুষ রায়সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবন ও কাজকে উহ্য রেখে। রাজবংশী সংস্কৃতি ও সমাজকে উন্নততর করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনেক।
১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি পঞ্চানন বর্মা জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন করদ-মিত্র রাজ্য কোচবিহারের অন্তর্গত মাথাভাঙা মহকুমার খলিসামারি গ্রামে। অত্যন্ত অনগ্রসর একটি জনপদ। প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করে তিনি লেখাপড়ায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই পঞ্চানন এমই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সেসময় কোচবিহার, দিনাজপুর, রঙপুর ও মালদহ ছিল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত। এমই পরীক্ষার ফল সম্পর্কে কোচবিহার গেজেটের ১৮৮৫-১৮৮৬ সালের শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টে লেখা হয়েছেঃ Panchanan Sarkar a native of Coochbehar who passed the M.E. Examination in First Division from Mathavanga School succeeded to secure the first place in the general list of Rajsahi Division.
১৮৬৬ থেকে ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্তর বছরের জীবন তাঁর। সে সময়ও মানুষের সামাজিক স্থান নির্ধারণে গুরুত্ব পেত কতগুলি কুসংস্কার। জাত-পাত। উচ্চ-নিচ। শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে কতটা উন্নত করতে পারে তা বোঝার মত মানুষ ছিল কম। মানুষে মানুষে ভেদ জাঁকিয়ে বসেছিল সমাজের ওপর। এ অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী রাজবংশীরা ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থদের মত তথাকথিত বর্ণহিন্দু সমাজের কাছে ছিলেন ব্রাত্য। এই ভেদাভেদ মোচন করাই ছিল ঠাকুর পঞ্চাননের প্রথম কাজ। এবিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ (বর্তমান এবিএন শীল কলেজ) থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে এমএ এবং আইনে স্নাতক (রাজবংশীদের মধ্যে প্রথম) এই স্বাধীনচেতা পুরুষ বিভিন্ন শাস্ত্র পুরাণ ঘেঁটে প্রমাণ করলেন রাজবংশী নামে পরিচিত জনগোষ্ঠী আসলে ক্ষত্রিয়। সামাজিক সংকট ও অবস্থার বিপাকে তাঁরা তাঁদের আচার-অনুষ্ঠান ভুলে ব্রাত্য হয়ে রয়েছেন। এই বিষয়টি শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে পশ্চিমঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৮১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিধানসভার লবিতে পঞ্চানন বর্মার প্রতিকৃতির আবরণ উন্মোচন করবার সময় বলেন, “ক্ষত্রিয় সমাজভুক্ত তিনি, সমাজের পূর্বতন গৌরব ও অধঃপতন, সামাজিক শোষণ এবং অত্যাচারের থেকে নিজ সমাজকে রক্ষা করার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। তাই এই কাজ ধীরে ধীরে তাঁকে উত্তরবাংলার বৃহত্তম জনগোষ্ঠী রাজবংশী সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।” তিনি আরও বলেন, “উত্তরবাংলা, অসম, বিহার এবং নেপালের সন্নিহিত এলাকার রাজবংশী সম্প্রদায়কে নতুনভাবে ক্ষত্রিয় সমাজভুক্ত করার আন্দোলন তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে কোনও ধর্মীয় আন্দোলন নয়। বরং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের পুরোধা পঞ্চানন বর্মা।”
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য দীনেশ ডাকুয়া লিখেছেন, “রাজবংশী জাতিটাকে ‘মানুষ’ করার জন্য পঞ্চানন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু অন্য কোনও জাতি বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর কোনও হিংসা বিবাদ ছিল না। বরং নিজেদের উন্নতি বিধানে তিনি সর্ব সম্প্রদায়ের সাহায্য ও সহানুভূতি আদায় করেছিলেন।” রায়সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা নিজের ক্ষাত্রগণ প্রকাশের জন্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য সংগ্রহ করে দেন। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইংরেজ সরকার ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘রায়সাহেব’ এবং এমবিই উপাধি প্রদান করে। তিনি ১৯২০, ১৯২৩, ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বর্ণ হিন্দুরা যেহেতু রাজবংশী সম্প্রদায়কে নিচু নজরে দেখত সে কারণে রাজবংশীগণ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন হরমোহন রায় ও পরে পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে। রাজবংশীদের ব্রাত্যত্ব মোচন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার সংস্কৃত সাহিত্যের প্রখ্যাত পন্ডিত তথা শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাক্ষ্মণ্যবর্গের উপস্থিতিতে ১৯১২ সালে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত দেবীগঞ্জ থানার পেরলবাড়ি গ্রামে (অধুনা বাংলাদেশে) করতোয়া নদীর তীরে একটি যজ্ঞ করা হয়। সেদিনই গণ-উপনয়নের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ রাজবংশী পবিত্র যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন। এই মহামিলন ক্ষেত্রের অনুষ্ঠান শেষ করে পঞ্চানন বর্মা তাঁর পৈত্রিক পদবি সরকার বর্জন করে বর্মা গ্রহন করেন। পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশের লক্ষ্যে নানাবিধ জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
সমগ্র উত্তরবঙ্গে রাজবংশী ছাড়াও আরও কিছু জনজাতি ও আদিবাসী মানুষ রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালী, যাঁরা এ অঞ্চলে ভাটিয়া নামে পরিচিত। রয়েছেন নেপালী, বিহারী, মারোয়ারী, তামাঙ, ওরাঁও, মেচ, রাভা, সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, টোটো, ধীমাল, দেশি, পলি সহ আরও অনেকে। তাঁরা প্রত্যেকে প্রভাব ফেলেছেন এ অঞ্চলের সংস্কৃতিকে।
উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, কালিম্পং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ। আমার আলোচনার বিষয় এই অঞ্চলের লোকনাট্য, লোকনৃত্য। উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম। অনেক অঞ্চলের লোকনাট্য নিজেকে যাত্রারূপে বদলে ফেললেও এখানকার লোকনাট্য নিজস্বতায় অনন্য। বৈচিত্রপূর্ণ এই ধারা বিষয় ও দর্শনে গভীর কথা বলে।
(চলবে)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team