কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পুরাণের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছে। সেইসব চরিত্রের কথা হয়ত লোকের মুখে মুখে ফেরে না, কিন্তু তাদের কাজ, আত্মত্যাগ, চারিত্রিক দৃঢ়তা তাদেরকে এক বিশেষ স্থানে পৌঁছে দেয়। রানী বপুষ্টমা ছিলেন তাদেরই মধ্যে অন্যতম এক নাম। অর্জুন প্রপৌত্র জন্মেজয়ের স্ত্রী ছিলেন বপুষ্টমা।
অসাধারণ সুন্দরী, কোমল, আকর্ষক, মরালীর মতো উত্তাপ যার শরীর জুড়ে সেই বপুষ্টমার রূপে, স্বভাবে মুগ্ধ ছিলেন চন্দ্রবংশীয় সম্রাট জন্মেজয়। অন্য কোনো রমনীর দিকে তাকানোর কথা ভাবেনইনি তিনি কোনোদিন।
জন্মেজয় একবার অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যদিও বিনা যজ্ঞেই তাঁকে প্রজারা মেনে নিয়েছিল রাজচক্রবর্তী রূপে, তবু তিনি এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন, যজ্ঞাশ্বের নামের এক সুদর্শন অশ্বকে পাঠান জম্বুদ্বীপ প্রদক্ষিণ করতে। ঘোটকটি ফিরে এলেই বসবে বিরাট যজ্ঞ। এই পর্যন্ত সবই ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু যজ্ঞের আয়োজনের কোথায় যেন বাধার সৃষ্টি করছিল মহর্ষি ব্যাসদেবের উপদেশ। তিনি নিষেধ করেছিলেন এই যজ্ঞ করতে কিন্তু কোনো কারণ না বলায় জন্মেজয় তা মানেননি। রাণী বপুষ্টমা তাই কিছুতেই খুশি হতে পারছিলেন না, মনের ভেতর একটা খটকা সবসময় তাকে যেন বলে দিচ্ছিল সাবধান, বিপদ আসছে। কিন্তু রাজা রাণী বপুষ্টমার কথা গুরুত্ব দেন না এবং আয়োজন করেন অশ্বমেধ যজ্ঞের৷
যজ্ঞের ঘোটক রাজ্যে ফিরে এলে সারা রাজ্য মেতে ওঠে তার আয়োজনে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এসে উপস্থিত হন। সাধু থেকে শুরু করে রাজা, বাদ যান না স্বর্গের দেবতারাও। উপস্থিত হন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। রাজা জন্মেজয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন যজ্ঞের আয়োজনে। সময় পান না সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর।
এদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের আপ্যায়নে যাতে কোনো ত্রুটি না হয় সেসব দেখার জন্য রানী বপুষ্টমার প্রধানা দাসী চন্দ্রিকাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দাসী চন্দ্রিকা দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতেও পারেন না। ইন্দ্র চন্দ্রিকার চোখ দেখে ধরে ফেলেন তাঁর মনের কথা। কিন্তু কিছু বলেন না, কারণ তাঁর মনেও তখন চলছে কামনার ঝড়। এই রাজ্যে প্রবেশের দিনই এমন এক সুন্দরীকে তাঁর চোখে পড়েছিল যে তখন থেকেই তিনি কামাতুর হয়ে আছেন। সেই নারীকে অঙ্কসঙ্গিনী না করা পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? এমনিতে দেবরাজ ইন্দ্র চাইলে তাকে না করবে এমন নারী নেই, তবে সে যদি হয় স্বয়ং রাজা জন্মেজয় পত্নী বপুষ্টমা? রাজা জন্মেজয়ের কানে গেলে তিনি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সব লণ্ডভণ্ড করে দেবেন। ইন্দ্র অনেক ভেবে এক উপায় বের করলেন। ডেকে পাঠালেন চন্দ্রিকাকে।
দেবরাজ ইন্দ্র চন্দ্রিকার তাঁর প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে তাকে রতিদান করলেন তারপর তাকে তুষ্ট করে কথা আদায় করলেন যেভাবেই হোক রাণী বপুষ্টমাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে হবে। চন্দ্রিকা ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেবরাজ ইন্দ্রকে দেওয়া কথার খেলাপও করা যাবে না এই ভেবে চন্দ্রিকা ইন্দ্রকে জানালেন যে তিনি যেন মদনদেবকে আহ্বান করে রাণীকে কামাতুর করে দেন, রাণী যেহেতু বেশ কিছুদিন রাজার সংসর্গ ছাড়া আছেন তাই ঘোটক যজ্ঞাশ্বরকে দেখে যেন ওর মনে কামনার উদ্রেক হয়। চন্দ্রিকা রাণীকে ওই ঘোটকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন, এবং সেই সঙ্গে সেখানে যাতে কেউ না থাকে সে ব্যবস্থাও করবেন।
চন্দ্রিকা এরপর রাণীর কাছে উপস্থিত হলেন। রাণী জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তার সামনে যজ্ঞ ঘোটক যজ্ঞাশ্বর দাঁড়িয়ে ছিল। প্রবল পুরুষালী, আকর্ষক বিরাটাকার ঘোটকটিকে রাণীমা মুগ্ধ চোখে দেখছিলেন। টেরই পাননি পেছনে চন্দ্রিকা এসে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্রিকা এই সুযোগে যজ্ঞাশ্বরের রূপের প্রশংসা করতে লাগলেন যাতে রাণীমা আরও আকর্ষণ অনুভব করেন। চন্দ্রিকা রাণীমাকে যজ্ঞাশ্বরকে ছুঁয়ে দেখার কথা বলতে মদনদেবের বানে কামাতুর হয়ে ওঠা রাণী এক কথায় রাজি হয়ে যান। যজ্ঞাশ্বরের প্রতি এক বিকৃত কামনায় তার মন দ্রবীভূত হতে থাকে।
আস্তাবলে নির্জনে যজ্ঞাশ্বরকে দেখে ছুঁয়ে রাণীমা আরও বেশি কামাতুর হয়ে পড়লেন। নিজেকেই প্রায় ভুলে যাচ্ছিলেন তিনি। যজ্ঞাশ্বরের রূপ, সাজসজ্জা আর সুবিশাল পুরুষাঙ্গ দেখে তিনি নিজের শরীরের বস্ত্র একে একে খুলে ফেলতে লাগলেন। ঠিক এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। হুঁশ ফিরল রাণীমার। তিনি নিজেকে ঢাকার জন্য বস্ত্রও পেলেন না। ইন্দ্র সহাস্যে নিজের কাম উদ্রেকের কথা জানালেন রাণী বপুষ্টমাকে। কিন্তু রাণীমা রাজি হলেন না, তিনি বললেন রাজা জন্মেজয় যদি জানতে পারেন এই কথা তবে রেহাই পাবেন না স্বয়ং ইন্দ্রও। কিন্তু ইন্দ্র কিছুতেই মানলেন না, এগিয়ে যেতে যেতে একেবারে কাছে চলে গেলেন রাণীমার। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি চিৎকারও করতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি ধর্ষিতা হলেন দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে।
ধর্ষণ শেষে উঠে দাঁড়ালেন দেবরাজ ইন্দ্র। মুখে জয়ের হাসি, কিন্তু মনের ভেতর কীসের এক কাঁটা খচখচ করতে লাগল ওঁর। হঠাৎই দেবরাজের মনে পড়ে গেল রম্ভার কথা। সব কাঁটা মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল ইন্দ্রের।
অন্যদিকে রাণী বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে রইলেন আস্তাবলে। চোখে জল, মনের ভেতর আগুন ধিকধিক করে জ্বলছে। যদিও এই কথা কেউ জানতে পারবে না তবু নিজের কাছে কী জবাব দেবেন তিনি? কেমন করে রাজার সামনে যাবেন? এই অশুচি শরীর নিয়ে সেবাই বা করবেন কেমন করে? রাগে তিনি দেবরাজকে অভিশাপ দিলেন সেদিন থেকে দেবরাজ যত ভালো কাজই করুক না কেন, পরিচিত হবেন লম্পট ইন্দ্র হিসেবেই৷
ইন্দ্র হেসে তখন জানালেন দুঃখের কিছু নেই। পূর্বজন্মে রাণী বপুষ্টমা ছিলেন রম্ভা। একবার রম্ভা ও কুবের নন্দন নলকুবর মিলন শেষে ক্লান্ত হয়ে শয়ন করছিলেন স্বর্গের নন্দন কাননে, ঋষি দেবল সেখানে উপস্থিত হলেও তারা কিছু টের পাননি৷ তখন ঋষি দেবল অপমানে অভিশাপ দেন রম্ভা ও নলকুবরকে। নলকুবর জন্ম নেন গোকুলে এক বৃক্ষরূপে আর রম্ভার জন্ম হয় রাজা সুচন্দ্রের ঘরে। যে হবে পরবর্তী সময়ে রাজা জন্মেজয় পত্নী। দেবরাজের ধর্ষর্ণেই তাঁর মুক্তি ঘটবে।
একথা শুনেও খুশি হতে পারলেন না রাণীমা। শুধুমাত্র দেবরাজ ইন্দ্রের মতো পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি কিছুতেই স্বর্গে ফিরে যাবেন না। তাঁর ওই মানজন্মই প্রিয়। রাণী ইন্দ্রকে চিরকাল চরিত্রহীন লম্পট হিসেবে চিহ্নিত করার অভিশাপ দিলেন ও চন্দ্রিকাকে ওর অসহায়তার কথা ভেবে মাফ করে দিলেন।
এরপর তিনি চন্দ্রিকাকে বললেন, এই শরীর নিয়ে মহারাজের পাশে সম্রাজ্ঞী হিসেবে আর বসা হবে না, দেখাও হবে না অশ্বমেধ যজ্ঞ। মহারাজের কষ্ট হবে তবু তিনি নিজের দেহত্যাগ করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। এরপর ধ্যানযোগে নিজের দেহত্যাগ করলেন রানী বপুষ্টমারূপী রম্ভা।
রাণী এই আত্মত্যাগের কথা কেউ জানতেও পারল না। রাজা জন্মেজয় শোকসন্তপ্ত হলেন। রাণী বপুষ্টমা এক দৃঢ়চেতা নারী হিসেবে পুরাণে জায়গা করে নিলেন।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team