পচে গলে যাওয়া লাশ। তার মধ্যে নানা রকমের পোকা থিক থিক করছে। এই দৃশ্য দেখলে সাধারণ লোকের বত্রিশ নাড়ি উলটে আসবে। অনেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। ফোরেনসিক বিজ্ঞানীরা কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। কোনও সুন্দরীর পচা লাশে কিছু পোকা ঘুরে বেড়াতে দেখলে তাঁদের চোখ জ্বল জ্বল করবে। কারণ, এই নীরব সাক্ষী বা সৈনিকরাই খুনিকে ধরিয়ে দিতে ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দারুণ ভাবে সাহায্য করে। বিশেষ করে, মাছির শূককীট বা ম্যাগটের বাহিনী।
কাউকে খুন করে আততায়ী ঘন জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়ে এল। কিংবা, যা হোক করে মাটি চাপা দিয়ে রেখে পালাল। ভাবল, ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। কিছু দিন বাদে মৃতদেহ পচে ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। গন্ধ বের হতে লাগল। কিন্তু গভীর বনের ভিতর সেই মৃতদেহ পড়ে থাকায় কেউ টেরও পেল না। যথাসময়ে পচে যাওয়া ত্বক, মাংসে পোকামাকড় জন্মাল। শরীরটাকে খেতে আরম্ভ করল। মানবদেহ যখন একেবারে কঙ্কাল, তখনও তাদের অনেকে হাড়ের ফাঁকফোকরে রয়ে গেল। পচা-গলা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা গেলে তো আর কথাই নেই। অজস্র ম্যাগট তাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফোরেনসিক গবেষকদের কাছে এর চাইতে সুখবর আর কিছু হতে পারে না।
ম্যাগটের থেকে অনেক খবর পান ফোরেনসিক বিজ্ঞানীরা। যেমন, যাকে খুন করা হয়েছে সে কখন খুন হয়েছে। খুনের আগে কতক্ষণ সে খোলা আবহাওয়ায় ছিল। এমনকী, কোথায় খুনটা হয়েছে সেটাও মাছির শূককীটগুলো বলে দিতে পারে।
ব্রিটেনের হোম অফিস বা পুলিশ বিভাগের প্যাথোলজিস্ট প্রফেসর কিথ সিম্পসন এক কিংবদন্তি। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে তিনি ম্যাগটে-ভরা একটি মৃতদেহ পেলেন। পচা গন্ধে নাড়ি উলটে আসে। দেখে চেনার উপায় নেই। কিন্তু, সেই লাশের মধ্যে মোটা সাদা সাদা যে শূককীটগুলো নড়ে বেড়াচ্ছে তা দেখে কিথ সিম্পসন উৎসাহ পেলেন। তাঁর কাছে এরা কাঙ্ক্ষিত অতিথি। খুনির হদিশ এরাই তাঁকে দেবে।
বার্কশায়ারের ১৩ বছরের দুটি কিশোর ব্র্যাকনেল বনের কাছে নদীতে প্রায়ই মাছ ধরতে যেত। পল ফে আর টনি কিং। মাছের চার খোঁজার জন্য তারা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকত। তারা জানত, বনের মধ্যে অনেক সময় খরগোশ, পায়রা কিংবা তেলে শালিকের (স্টার্লিং) মতো পাখি মরে পড়ে থাকে। সেগুলো পচে গেলে গায়ে ম্যাগট জন্মায়। সেই ম্যাগট বঁড়শিতে গেঁথে ছিপ ফেললে মাছ উঠবেই। ১৯৬৪ সালের ২৮ জুন নদীর পাড়ে বসার আগে তারা দু’জন ম্যাগটের সন্ধানেই ব্র্যাকনেল উডসে ঢোকে। বনের মধ্যে ছোট ছোট ঝোপঝাড় ঠেলে এগতে এগতে এক জায়গায় তারা এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখল। একটা ঘাসে ছাওয়া ঢিবির উপর ম্যাগট কিলবিল করছে। সাধারণত, মৃত পাখি, ছোট জন্তু ইত্যাদি খাওয়ার জন্য শূককীটগুলো শুকনো পাতা, ডালপালা সরিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে তারা তা করেনি।
খোঁজাখুঁজি না-করেই এক জায়গায় এত মাছের চার মেলায় পল ফে আর টনি কিং খুশি হল। কিন্তু, তাদের আনন্দ খুব বেশিক্ষণ রইল না। বেশি করে মাছির শূককীট তোলার জন্য তারা ঢিবির উপর থেকে ঘাসের চাপড়া সরাতেই গর্ত থেকে তাদের সামনে হঠাৎ একটা হাত বেরিয়ে এল। হাতটা প্রায় পচে গিয়েছে। আতঙ্কে ছেলে দুটো দৌড়ে গিয়ে কাছের থানায় খবর দিল। ছিপ ফেলার কথা তখন মাথায় উঠেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাগট সাইট ঘিরে ফেলল পুলিশ। খুনের তদন্ত শুরু হল।
সেদিন ছিল রবিবার। বাড়িতে ছুটির দিনের লাঞ্চ খেয়ে ডিটেকটিভ চিফ সুপারিনটেনডেন্ট আর্থার লসন সবেমাত্র একটু আরাম করে বসেছেন, সেই সময়েই ব্র্যাকনেল উডসের খবর পেলেন। বার্কশায়ারের সিআইডি চিফ হিসাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ তুললেন। পূর্ণবয়স্ক পুরুষের লাশ। জামাকাপড় পরা। অগভীর গর্তে চিৎ করে শোয়ানো হয়েছে। মাথাটা তোয়ালে দিয়ে মোড়া।
অকুস্থলে যে পুলিশ অফিসাররা ছিলেন তাঁরা কবরের আশপাশ দেখে তেমন কোনও এভিডেন্স পেলেন না। এঁরা সিনস-অফ-ক্রাইম অফিসার্স। পুলিশের ভাষায় ‘সোকস’। নরম মাটিতে কোনও টায়ারের দাগ পাওয়া গেল না। লাশ সেখানে কোনও গাড়িতে চাপিয়ে আনা হয়েছে কি না, বোঝা গেল না। খুনির কোনও অস্ত্র, কাচ কিংবা কাপড়ের টুকরো কিছুই পাওয়া গেল না।
লাশ দেখে ডিটেকটিভ চিফ সুপারিনটেনডেন্ট লসনের মনে হল, মৃতদেহ বেশ কয়েক সপ্তাহ ওখানেই মাটি চাপা পড়ে ছিল। তিনি ব্র্যাকনেল উডসের খবর প্রফেসর কিথ সিম্পসনের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন।
রবিবার দুপুরে খেয়ে উঠে প্রফেসর সিম্পসন বাড়ির বাগানে একটু ঝিমাচ্ছিলেন। কিন্তু ফোন পেয়ে তাঁকেও অকুস্থলে ছুটতে হল। লাশ দেখে লসনকে তিনি বললেন, ১২ দিনের বেশি মাটি চাপা ছিল বলে মনে হয় না। সিআইডি চিফ অবাক হয়ে গেলেন। প্রফেসর ডিটেকটিভকে লাশ দেখিয়ে বললেন, “ম্যাগট খুব তাড়াতাড়ি পচে-যাওয়া মৃতদেহ খেয়ে ফেলে। দেখলে বিস্মিত হতে হয়। আমি দেখেছি দশ দিনে ক্ষুধার্ত ম্যাগট একটি মৃতদেহের এই হাল করে ছেড়েছে।”
২
পোকা কিলবিল-করা পচা লাশ থেকে খুনির পরিচয় বের করা যায়। সব ক্ষেত্রে আপাদমস্তক পরিচয় না মিললেও তার কোনও কোনও অঙ্গ শনাক্ত করা যায়। প্রফেসর সিম্পসনের আত্মজীবনী ‘ফর্টি ইয়ারস অফ মার্ডার’। মাছির শূককীট বা ম্যাগট কোনও খুনের তদন্তে কতটা সাহায্য করে সে কথা প্রফেসর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে প্রফেসর সিম্পসন ব্র্যাকনেল কেসেরও উল্লেখ করেছেন।
“লাশে ম্যাগট দেখে ধরে নিলাম—এগুলো ব্লু-বটল মাছি ক্যালিফোরা ক্রাইথোসিফেলাসেরই লার্ভা। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্যাম্পেল তুলে নিলাম। খালি চোখে ক্যালিফোরাইন টাইপের অন্যান্য মাছির লার্ভার সঙ্গে ব্লু-বটল লার্ভার পার্থক্য ধরা পড়ে না। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতের মাছির ডিম পাড়ার সময় আলাদা আলাদা। ব্লু-বটল ডিম পাড়ে সূর্যালোকে। গরম আবহাওয়ায় তারা প্রথম দিনেই ডিম পাড়ে।
“(মৃতদেহে ব্লু-বটলের) ছোট্ট শূককীট বা ম্যাগট ‘প্রথম ধাপে’ আট থেকে ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোলস পালটায়। দ্বিতীয় ধাপে তারা খোলস পালটায় দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। তৃতীয় ধাপে তারা মৎস্যশিকারীদের টোপের উপযোগী হয়। তার পর গুটিপোকা হওয়ার আগে টানা পাঁচ-ছ’ দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে খেতে থাকে। আমি এই তৃতীয় পর্যায়ের পরিণত লার্ভা খুঁজছিলাম। খেয়েদেয়ে মোটা হয়ে উঠেছে, অথচ গুটিপোকা হয়নি। এদের পাওয়ার পর, আমি হিসাব করে দেখলাম, নয় থেকে ১০ দিন আগে ডিম পাড়া হয়েছে। সঙ্গে আরও বেশি সময় জুড়ে দিলাম ব্লু-বটল মাছির লাশ খুঁজে পাওয়ার জন্য। এই ভাবে হিসাব করে দেখলাম, খুনটা হয়েছে ১৬ কিংবা ১৭ জুন।” ব্র্যাকনেল উডসে লাশ মিলেছিল ১৯৬৪ সালের ২৮ জুন।নীরব সাক্ষীর মাধ্যমে খুনের তারিখ জানতে পারলেন সিম্পসন। ম্যাগট এই কেসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল।
লাশের যা অবস্থা তাতে প্রফেসর সিম্পসন ঠিক করলেন, কিছু অটোপ্সি বা শব ব্যবচ্ছেদের কাজ তিনি ঘটনাস্থলেই সেরে নেবেন। মৃত্যুর কারণ জানতে শব কেটে পরীক্ষা করতে হয়। সেই কাজ ফোরেনসিক প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবেই সব থেকে ভালো ভাবে করা যায়। কিন্তু ব্র্যাকনেল উডসে মেলা লাশের তখন যা হাল তাতে প্রফেসরের ভয় হল, ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে না-যেতেই হাত-পা, মাথা খসে না পড়ে। কিংবা পথে বডিটা হয়তো মাঝখান থেকে খসে গেল। সব তদন্ত পণ্ড! অকুস্থলেই প্রফেসর সিম্পসন তাঁর কাজ শুরু করে দিলেন।
প্রফেসর দেখলেন, মৃতের মাথার দুই ধারে রক্ত পড়ে জমে আছে। যেন একটা ছোটখাট পুকুর। স্বরনালীর ভিতরেও একই অবস্থা। ল্যারিংক্সের হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছে। শ্বাসনালীতে কেউ প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। হয়তো একাধিক বার।
ল্যাবরেটরিতে দেহের টুকরোগুলো নিয়ে যাওয়ার পর আরও তথ্য মিলল। কম বয়সেই মৃতের বাঁহাত ভেঙে গিয়েছিল। সেই হাত আর ভালো করে জোড়া লাগেনি। কঙ্কাল মেপে দেখা গেল, মানুষটার হাইট ছিল পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি।
এখানে প্রফেসর কিথ সিম্পসনের কাজ তখনকার মতো শেষ হল। মৃতের পরিচয় জানতে শুরু হল পুলিশি তদন্ত।
সব খুনের ক্ষেত্রেই যা হয়, এই খুনের মামলাও সে ভাবেই শুরু হল। প্রথমে নিরুদ্দিষ্টদের খোঁজ নিতে থাকল পুলিশ। চিফ সুপারিনটেনডেন্ট লসন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সেন্ট্রাল অফিসে মিসিং পার্সনদের খোঁজ নিলেন। মিসিং পার্সনস ব্যুরো জানাল, ১৬ জুন গ্লসেস্টারশায়ারের লিডনি-র বাসিন্দা পিটার টমাস তাঁর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। প্রফেসর সিম্পসন বলেছিলেন, খুনের তারিখ ১৬ কিংবা ১৭ জুন।
পিটার টমাস-কে খুঁজে না-পেয়ে লিডনি-র স্থানীয় পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে খবর দিল। নিরুদ্দিষ্টকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পেলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ‘হেভিওয়েট’ গোয়েন্দা, সুপারিনটেনডেন্ট হোরেস ফেবার। যখন ফেবার জানতে পারলেন, লিডনি-র নিরুদ্দিষ্ট পিটার টমাস আর ১০০ মাইল দূরে ব্র্যাকনেল উডসে মেলা লাশের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, তিনি নিজে থেকে তদন্তে যোগ দিলেন।
নিরুদ্দিষ্ট টমাসের বর্ণনার সঙ্গে মৃতদেহের বৈশিষ্ট্যগুলি মিলে গেল। লাশের যা হাইট, নিরুদ্দিষ্ট পিটার টমাসেরও একই হাইট। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। ছোটবেলায় পিটার টমাসের হাত ভেঙেছিল। লাশেরও বাঁহাত ভাঙা। আরও যেটা ইন্টারেস্টিং, পিটার টমাসের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। প্রফেসর সিম্পসনকে টেলিগ্রাম পাঠানো হল। লাশের আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্য। হাতের আঙুল থেকে তখন মাংস পচে-গলে খসে পড়ছে। তা সত্ত্বেও আঙুলের ছাপ নিলেন কিথ সিম্পসন। ফোরেনসিক বিজ্ঞানে তিনি এক জন জিনিয়াস। প্রমাণিত হল, ম্যাগটের খাদ্য যে, সে-ই পিটার টমাস। ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে টমাসের আঙুলের ছাপ তোলা ছিল। মৃতদেহের আঙুলের ছাপের সঙ্গে সেই ছাপ মিলে গেল।
পুলিশের কাজ হল মৃতের পরিচয় জানা এবং মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা। এত বীভৎস ভাবে খুন। সেই খুনের মোটিভ জানতে হবে। খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে।
তদন্তে জানা গেল, পিটার টমাস একটা কাঠের বাংলো টাইপের বাড়িতে বাস করত। দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। বাড়িতে সে একাই থাকত। ব্যাচেলার লাইফ। ঘরের চারি দিকে ছড়ানো আধখাওয়া মিল, এঁটো প্লেট, সুপের খালি টিন। বেকার ভাতা পেত। তবে, কয়েক বছর আগে সে উত্তরাধিকার বাবদ ৫ হাজার পাউন্ড পেয়েছিল। তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ জানতে পারল, তিন বছর আগে পিটার টমাসের বাবা মারা যান। তিনি উইলে এই অর্থ ছেলের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। ঘর গরম করার হিটিং রেডিয়েটর বেচত টমাস ব্রিটল নামে হ্যাম্পশায়ারের হুক এলাকার এক সেলসম্যান। ৫ হাজার পাউন্ড তাকে ধার দিয়েছিল পিটার টমাস।
ঋণের শর্ত ছিল, “১৯৬৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে টাকা শোধ করতে হবে।” অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা তাঁদের ইনস্টিংকট দিয়ে বুঝতে পারলেন, যে মাসে ঋণ শোধ করার কথা সেই মাসেই খুনের ঘটনা ঘটেছে। মানে, ব্র্যাকনেল উডসে যার বডি পাওয়া গিয়েছে তার পিটার টমাস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সন্দেহ স্বাভাবিক ভাবেই টমাস ব্রিটলের উপর গিয়ে পড়ল। পুলিশ জানতে পারল, পিটার টমাস তার আইনজীবীর পরামর্শ না শুনে ব্রিটল-কে লোন দিয়েছিল। আইনজীবী বলেছিলেন, ব্রিটল-কে ধার দিলে টমাস ভুল করবে।
তদন্ত চালাতে গিয়ে গোয়েন্দারা আরও তথ্য পেলেন। ব্রিটল খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কৃষি প্রকল্পের জন্য তার ঋণ চাই। যিনি নগদে টাকা ধার দেবেন ছয় মাসে সাড়ে ১২ শতাংশ সুদে তাঁকে সেই ধার শোধ করা হবে। পিটার টমাস সেই টোপ গিলেছিল। পরিণামে তার জীবন গেল। তেমন এভিডেন্স না-থাকা সত্ত্বেও পুলিশ টমাস ব্রিটল-কে প্রশ্ন করল। সতর্ক করল। তারপর তাকে গ্রেফতার করল।
৩
হাজতে থাকার সময় ব্রিটল স্বীকার করল, ১৬ জুন সে লিডনিতে গিয়েছিল। নিহতের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার দিন। পুলিশকে বলল, টাকাটা সে শোধ করে দিয়েছে। যদিও সেই টাকা টমাসের বাংলোয় পুলিশ পায়নি। ব্র্যাকনেল উডসের কবরেও তা মেলেনি। অত টাকা ব্রিটল পেল কী করে? এপসমে রেস খেলে। ইংল্যান্ডের সারেতে এপসম ডাউনসের রেসকোর্স জগদ্বিখ্যাত। সেখানে রেস খেলে জুয়ায় জিতে সে ঋণ শোধ করার টাকা পেয়েছে। সেই টাকাই লিডনিতে গিয়ে দিয়ে এসেছে। যদিও ডিটেকটিভদের জেরায় সে রেসে জেতা ঘোড়াদের নামই বলতে পারল না।
ফোরেনসিক পরীক্ষায় ব্রিটলের জামাকাপড়ে, গাড়িতে কিংবা তার জিনিসপত্রে এমন কোনও নমুনা মিলল না, যার থেকে প্রমাণ হয় খুনের সঙ্গে তার কোনও যোগ আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে সে এক জন সাক্ষীও জোগাড় করল। হিচ হাইকার। লিডনিতে টাকা দিতে যাওয়ার পথে ব্রিটল তাকে গাড়িতে তুলেছিল। ডিটেকটিভদের দিকে নিপাট ভালোমানুষের মতো চেয়ে সে পালটা জানতে চাইল, “আমি যদি খুন করতেই যেতাম, তাহলে গাড়িতে কি লিফট দিতাম?”
পুলিশ ব্রিটলের গাড়িতে এভিডেন্সের সামান্য চিহ্ন খুঁজে বের করতে পারবে বলে আশা করেছিল। হিংসাত্মক অপরাধ যেখানে ঘটে, সেখানে আততায়ী আর আক্রান্তের মধ্যে লড়াইয়ের কোনও না কোনও চিহ্ন থেকে যায়। যত ছোটই হোক, মাইক্রোস্কোপে দেখার মতো, চিহ্ন থাকবেই। লালা, রক্ত কিংবা ত্বকের কোষ। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তাঁর ‘ভ্যালি অফ ফিয়ার’ (১৯১৪-১৫) উপন্যাসে লিখেছিলেন, খুনিরা যতই শক্তিশালী হোক তারা সবচাইতে বেশি ভয় পায় আক্রান্তকে। কারণ, মরার আগে সে শেষবারের মতো রুখে দাঁড়ায়। তখন তাকে দাগি খুনিরাও ভয় পায়। শেষবারের সেই মরণপণ লড়াইতে খুনির শরীরেও আক্রান্তের প্রতিরোধের কিছু দাগ থাকে। ঘটনাস্থলেও তার নিশানা রয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটলের গাড়িতে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। ব্রিটলের শরীরেও মেলেনি। আবার টমাসের মৃতদেহেও ব্রিটলের কোনও নমুনা পাওয়া যায়নি। ব্র্যাকনেল উডসের কবরেও পাওয়া যায়নি। ডিটেকটিভরা ধন্ধে পড়লেন। কয়েক মাস ধরে মামলা গড়াল। তারপর একটা ঘটনা ঘটল।
স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে এলেন গ্লসেস্টারের এক নাগরিক। নাম, ডেনিস রবার্টস। তিনি জানালেন, ২০ জুন গ্লসেস্টারের বাস গুমটিতে তিনি পিটার টমাসকে দেখেছেন। তারিখটা তাঁর মনে আছে। কারণ, সেই বার জীবনে প্রথম তিনি তাঁর কর্মস্থল বস্ত্র কারখানার ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন। ডেনিসের এই সাক্ষ্যে মনে হল, ব্রিটল ছাড়া পেয়ে যাবে। এর আগে হিচ হাইকারের দেওয়া জবানবন্দি অনুসারে ১৬ জুন ব্রিটল লিডনিতে গিয়েছিল। ডেনিসের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মোতাবেক ওই তারিখের চার দিন বাদেও নিহত ব্যক্তি জীবিত ছিল। চার দিন পরেও পিটার টমাস যখন জীবিত তখন ব্রিটল আর দোষী হয় কী করে?
শেষ পর্যন্ত সেই ম্যাগটদেরই শরণাপন্ন হতে হল। নীরবে মৃতদেহে ভোজ সেরে যারা গোয়েন্দাদের ক্লু দেয়। বলে দিতে পারে কে খুনি, কে নয়।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সুপারিনটেনডেন্ট হোরেস ফেবার ফোরেনসিক ল্যাবরেটরিতে গিয়ে প্রফেসর কিথ সিম্পসনের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রফেসর সিম্পসনকে তিনি ডেনিস রবার্টসের জবানবন্দির কথা জানালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি হতে পারে যে, খুনটা হয়েছে বিশে জুন? তার মানে মাত্র আট দিন মৃতদেহ চাপা পড়েছিল?” ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞর স্পষ্ট উত্তর, “না, তা হতে পারে না। এর জন্য যদি আমাকে আদালতে দাঁড়িয়ে আইনজীবীদের কড়া প্রশ্ন-পালটা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়, তাতেও আমি রাজি।”
ডিটেকটিভকে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রফেসর সরকারি আইনজীবীদের ডিরেক্টরকে (ডিরেক্টর অফ পাবলিক প্রসিকিউশন, সংক্ষেপে ডিপিপি) একটা নোট পাঠালেন। তাতে তিনি লিখলেন, “আমাকে ডেনিস জন রবার্টসের বিবৃতির একটি কপি দেখানো হয়েছে। রবার্টসের বক্তব্য, সে ২০ জুন শনিবার বাস স্টেশনে পিটার টমাসকে দেখে চিনতে পেরেছে।
“প্রথমে বনের ভিতর ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করে মনে হয়েছিল— দেহ সেখানে ‘নয় কিংবা ১০দিন বা হয়তো তার বেশি সময় ধরে’ মাটি চাপা থেকেছে। এটা খুব কম সময়ের হিসাবে। পোস্টমর্টেমে এমন কিছু বের হয় নি যা থেকে বিশেষভাবে প্রমাণ হয়, ম্যাগট সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে তার চাইতেও কম সময়ে মৃতদেহটা খেয়েছে। মৃত্যুর সময় বের করার ক্ষেত্রে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমার পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে ডেনিস রবার্টসের বিবৃতি মিলছে না।”
আদালতে শপথ নিয়ে অভিযুক্তের আইনজীবীর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর বিরুদ্ধে ব্লু-বটল মাছির শূককীট সম্পর্কিত রিপোর্ট পেশ করতে তিনি প্রস্তুত, এই আশ্বাসও প্রফেসর সিম্পসন দিলেন।
সরকারি আইনজীবীদের ডিরেক্টর প্রফেসর সিম্পসনের নোট টমাস ব্রিটল মামলার সরকারি আইনজীবীকে পাঠালেন। তাঁর মতে, ব্রিটলকে অপরাধী প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু, বিচারবিভাগীয় অনুসন্ধান বা ইনকোয়েস্টের সময় এক জন জুরি এক ব্যতিক্রমী রায় দিলেন। “টমাস ১৭ জুনের আশপাশে এক ব্যক্তির দ্বারা নিহত হয়েছেন।” অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণে তাঁরা জানালেন হত্যাকারী টমাস ব্রিটল। ইনকোয়েস্টের করোনার বা মৃত্যু সমীক্ষক ব্রিটলকে হাজতে পাঠালেন। ডিপিপি সরকারি আইনজীবীকে মামলা চালিয়ে যেতে বললেন। প্রফেসর সিম্পসনের রিপোর্টই তখন তাঁর একমাত্র ভরসা। শূককীট স্টার উইটনেস হিসাবে গণ্য হল!
অভিষুক্তের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী কুইনটিন হগ। পরবর্তী কালে তিনি রানির বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহা অধ্যক্ষ বা লর্ড চ্যান্সেলর হন। লর্ড চ্যান্সেলর হাউস অফ লর্ডসেরও প্রধান। লর্ড চ্যান্সেলর হিসাবে কুইনটিন হগ লর্ড হ্যালিশ্যাম নামে পরিচিত হন। প্রফেসর সিম্পসন জানতেন, এই কুইনটিন হগের সামনে সাক্ষ্য দেওয়া অগ্নিপরীক্ষার মতো। কিন্তু তিনি ম্যাগটের নীরব সাক্ষ্যের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, কুইনটিন হগের নাম শুনেও ঘাবড়ালেন না। তিনি নিশ্চিত, ডেনিস রবার্টস যাকে বাস গুমটিতে দেখেছে সে পিটার টমাস নয়। আদালতে হলফ করে বললেও নয়।
৪
দমবন্ধ অবস্থায় শুনানি শেষ হল। কুইনটিন হগের মতো দাপুটে উকিলকেও প্রফেসরের এভিডেন্সের সামনে মাথা নত করতে হল।
আত্মজীবনীতে সেই স্মৃতির কথা লিখেছেন কিথ সিম্পসন।
“সরকারি কৌঁসুলি বা ক্রাউন কাউন্সেল র্যালফ কিউসাক যখন আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি শূককীটের তৃতীয় দশার কথা বললাম। ডিম পাড়া থেকে গুটিপোকা হওয়ার ঠিক আগের পর্যায়। এর পর, ডিম পাড়া থেকে ম্যাগটের তিন বার খোলস ছাড়ার পর্বটা ক’দিন ধরে চলে, সে বিবরণও প্রমাণ সহ পেশ করলাম।
“মৃতের শরীরে ম্যাগট সর্বসাকুল্যে কত দিন থাকতে পারে সেটা ব্যাখ্যা করে আদালতে বললাম, ‘নিহতের মৃতদেহ যে দিন দশেক মাটি চাপা ছিল, এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।’ কমপক্ষে নয় থেকে ১০ দিন।”
ম্যাগটের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়ার পর প্রফেসর সিম্পসন আদালতে মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করলেন।
প্রফেসরের মতে, নিহতের গলায় বারংবার ক্যারাটের কোপ পড়েছে। যে মেরেছে সে খালি হাতে লড়তে দক্ষ। শুনানি চলাকালীন জানা গেল, অভিযুক্ত এক সময় ব্রিটিশ আর্মিতে কমান্ডো ট্রেনিং পেয়েছে এবং এই ধরনের মার্শাল আর্ট তার জানা আছে...। ঠিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ব্যোমকেশ বক্সির ‘অচিন পাখি’ গল্পের অবসরপ্রাপ্ত দারোগা নীলমণিবাবুর মতো।
বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রফেসর সিম্পসনের জ্ঞানের গভীরতা ও অভিজ্ঞতা এতটাই ছিল যে, কুটনটিন হগের মতো দুর্ধর্ষ আইনজীবীও তাঁর তথ্য ও যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। তাও, সরকারি আইনজীবীর পেশ-করা ম্যাগট এভিডেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য তিনি প্রফেসর ম্যাককেনি-হিউজেস নামে এক কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞকে আদালতে আসতে বললেন। এনটেমোলজিস্ট হিসাবে প্রফেসর ম্যাককেনি-হিউজেস প্যাথোলজিস্ট সিম্পসনের ম্যাগট-সম্পর্কিত বয়ান খারিজ করবেন, এটাই ছিল কুইনটিন হগের শেষ আশা। কিন্তু, প্রফেসর ম্যাককেনি-হিউজেস সিম্পসনের মতেই মত দিলেন। এনটেমোলজিস্টকে যখন প্রশ্ন করা হল, দুপুরে ডিম না-পেড়ে মাছি যদি মাঝরাতে ডিম পাড়ে? প্রফেসর উত্তর দিলেন, “হা ঈশ্বর, তা কী করে সম্ভব? কোনও আত্মমর্ষাদা সম্পন্ন ব্লু-বটল মাঝরাতে ডিম পাড়ে না। ভরদুপুরে হয়তো পাড়তে পাড়ে, কিন্তু মাঝরাতে কদাচ নয়।”
ব্রিটল গ্রেফতার হওয়ার পর, ন’ মাস ধরে মামলা চলল। মৃতকে বাস গুমটিতে দেখেছেন বলে দাবি করেছিলেন ডেনিস জন রবার্টস। তাঁর স্মৃতি তত দিনে ফিকে হয়ে এসেছে। আবার তাঁকে আদালতে ডাকা হল। ডেনিস কিন্তু তাঁর প্রাথমিক বক্তব্য থেকে নড়লেন না। টানা পাঁচ দিন জুরিদের সামনে প্রশ্ন-পালটা প্রশ্ন চলল। পাঁচ দিন ধরে ডেনিসের বয়ান শোনার পর জুরিরা রায়দানের জন্য তৈরি হলেন। ভিত্তিহীন সাক্ষ্য, না প্রফেসর সিম্পসনের প্রমাণ? কোন দিকটা আদালত দেখবে? জুরিরা সিদ্ধান্তে এলেন, ‘সাইলেন্ট উইটনেস’ ম্যাগটরাই অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য সাক্ষী। খুনের অপরাধে টমাস ব্রিটলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল।
৫
প্রফেসর সিম্পসন তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, “এই কেস আমাকে বিশেষ ভাবে সন্তুষ্ট করেছিল। মৃত্যুর সময় নিয়ে আমার প্রত্যয়ের কথা সকলেই জেনে গিয়েছিল। পুলিশ, ডিরেক্টর অফ পাবলিক প্রসিকিউশন (ডিপিপি), আইনজীবী মহল এবং প্রেস। আমি যদি ভুল প্রমাণিত হতাম, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে আমি ছোট হয়ে যেতাম।”
আইন বিশেষজ্ঞ জেমস স্ট্যানিফোর্ড এই কেস সম্পর্কে লিখেছিলেন, “ফোরেনসিক পারদর্শিতার ক্ষেত্রে এটা ছিল এক চমকপ্রদ জয়। সত্যিই মনে রাখার মতো। এমন ভাবে তা জুরিদের সামনে পেশ করা হয়েছিল, সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে তাঁদের অসুবিধা হয়নি। খুনি যে একেবারে পাকা খুনি, ঠাণ্ডা মাথার খুনি— বুঝতে তাঁদের খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি।”
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team