রয়্যাল ইকো হাটে থেকে এলাম দুটো দিন। রাতে বারবিকিউ-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধুরা মিলে কাড়াকাড়ি করে খেতে গিয়ে নিজেদের কেমন যেন অসভ্য মনে হচ্ছিল। কিংবা দীর্ঘদিন না খেতে পাওয়া একদল বন্য জন্তু। ছ’জন বন্ধু মিলে একসাথে বেড়াতে গিয়ে অপূর্ব এক স্বর্গীয় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দিয়ে পরে খুব খারাপ লেগেছিল বৈকি। তবে এত আনন্দ এর আগে কোথাও করেছি কিনা মনে নেই। উপরি পাওনা ছিল ওশান লেপচাকে সঙ্গে পাওয়া। ওশানের মত ভাল ছেলে এখন বড়ই বিরল। প্রায় চোখে পড়ে না বললেই চলে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সের একটা তাজা ছেলে যার মুখে সবসময় নির্মল একটা মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে। ওশানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এই হোমস্টেতে যাওয়ার সুবাদেই।
চালসা থেকে নাগরাকাটার দিকে যেতে যেতে নাগরাকাটা মোড় পেরিয়েই ডান দিকে নেমে গেল রাস্তাটা। গাড়ি যায়, কিন্তু অফ রোড। ভাঙ্গাচোরা এবড়ো খেবড়ো পথ। কিন্তু হলে কী হবে, ধুধু প্রান্তর যখন চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে দু’হাত প্রসারিত করে ডাকে তখন তাকে উপেক্ষা করা খুব কঠিন। আমাদেরও তাই জেনে বুঝেই এই পথে আসা। বেশ খানিকটা গিয়ে তারপর রিসর্টের গেট। পৌঁছতেই একজন আদিবাসী ছেলে গেটটা খুলে দিল। আমরা গাড়ি ঢুকিয়ে যে যার মত মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। ছেলেটি আমাদের জন্য রাখা নির্দিষ্ট ঘরগুলো দেখিয়ে দিল। তিনটে ঘরে আমরা ছ’জন। এক ঘরে আমরা দুই জোড়া স্বামী-স্ত্রী, আর একটিতে একজন ব্যাচেলার আর অন্যজন ম্যারেড ব্যাচেলার।
লাঞ্চ সারলাম গরম ভাত আর মুরগীর মাংস দিয়ে। ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা গেলে জলঢাকা নদী, তারপর গরুমারা অভয়ারণ্য। বিকেলে আমরা রওনা হলাম নদীর দিকে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেল। ওশান বলে দিয়েছিল “অন্ধকারে ওধারে যাবেন না”। আমরা অবশ্য অন্ধকার করেই ফেলেছিলাম। কিন্তু ফেরার সময় এত নির্জন আর নিস্তব্ধ চারদিক যে আমাদের গা ছমছম করছিল রীতিমত। কেবল নদীর জলের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। সারাটা সন্ধে জুড়ে চলল ড্রিংকস আর বারবিকিউ নিয়ে হৈ হুল্লোড়। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুম।
পরদিন ভোরবেলা, তা প্রায় ছ’টা নাগাদ ক্যামেরা আর বাইনোকুলার হাতে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম পাখি খোঁজার উদ্দেশ্যে। দেখা আর ক্যামেরাবন্দী করা, এই হল কাজ। পাখি দেখার নেশা একটা অদ্ভুত নেশা। যাকে একবার পেয়ে বসেছে সে জানে যে এ কী জিনিস। প্রায় ঘন্টা দু’এক কাটিয়ে প্রায় হতাশ হয়েই ফিরে আসছিলাম আমরা তিনজন, কিন্তু হঠাৎ কীসের একটা আওয়াজে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে এক ঝাঁক ময়ূর। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা আর বাইনোকুলারের সঠিক প্রয়োগ তৎপর করে তুলল আমাদের। একসঙ্গে এত ময়ূরের দেখা পাওয়া সৌভাগ্য বৈকি। আমি দৌড়তে দৌড়তে এসে আমাদের সঙ্গী-সাথীদের হাঁক দিলাম। তারাও প্রায় যে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই হাঁফাতে হাঁফাতে এসে উপস্থিত হল নদীর পারে। ময়ূরেরা বেশ খানিকক্ষণ তাদের নিজেদের মত ঘুরে বেড়াল আর ডাক ছাড়তে লাগল আপন খেয়ালে। আমরা শান্তি মত অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম ওদের চলাফেরা। ফিরে এলাম রিসর্টে। ব্রেকফাস্ট রেডিই ছিল। পুরি সবজি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে যে যার ঘরে চলে গিয়ে স্নান সেরে নিলাম।
বেলা দশটা নাগাদ আবার সবাই মিলে চললাম নদীর পাড়ে বসে একটু জলে পা ভেজাতে। এমনভাবে আমরা মজা করতে করতে এগোচ্ছিলাম যেন মনে হচ্ছিল সকলে যেন আবার সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি। আসলে এই রিসর্টের একটাই আকর্ষণ, সেটা হল এই নদী। বাকিটা ধূধূ মাঠ। চড়া রোদ্দুরের তাপ ক্রমশ বাড়তে লাগল। আমরা নদীতে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ব্যাঙ-নাচুনি খেলার কম্পিটিশন করতে লাগলাম। আচমকাই মনে হল নদীর জল যেন বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে স্রোতও। পা ডোবানো ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমরা। ঠিক তাই, একটু একটু করে জলের লেভেল বাড়তে আরম্ভ করল। বেশ খানিকটা বেড়ে গেলে আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম নদীর গর্জনও কেমন পালটে পালটে যাচ্ছে। এরকম দৃশ্য এর আগে আমি কখনও এত কাছ থেকে দেখিনি। বেশি দেরি না করে আমরা ধীরে ধীরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।
আজই বেরিয়ে পড়ব এমনটাই ঠিক হয়ে আছে। ফলে অকারণ দেরি না করে নিজেদের লাগেজ প্যাক করে ফেললাম। বেলা বারোটায় আমরা রিসর্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। একটা দিন আর একটা রাতে মন ভরেনি কারুরই। এত নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা এর আগে অন্য কোনও রিসর্টে এতটা উপভোগ করেছি বলে মনে পড়ল না আমাদের।
বুকিং-এর জন্য ফোন করতে হবে ওশান লেপচাকে ৯৯৩২৩৮৫৪৯৪ নম্বরে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team