ক্লাসরুমে নানা বয়সের পুরুষ-মহিলা বসে আছি সারিবদ্ধ। স্কুল-কলেজের কতিপয় চেনামুখ পেয়ে ভারি স্বস্তি আর তাদের সঙ্গেই এক বেঞ্চে। চলছে সব্বার খোঁজখবর দেয়ানেয়ার পালা। কে কোথায় আছে; কে চাকরি পেয়ে নিশ্চিন্ত, কে শ্বশুরগৃহে বিরাজমানা, কেইবা মিটিং-মিছিল করে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে শাদা পোষাক একেবারে ধূলিধূসর করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছে। আর কোন কোন লায়লা মজনু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জমানা থেকে প্রেমের জোয়ারে ভেসেই চলেছে, চাকরি না পেলে তরী আর কূলে ভেড়ে কীসের ভরসায়?
দশমাসের কোর্স। আমরা ফ্রেশার হিসেবে ভর্তি হয়েছি। বিএড ডিগ্রিধারীদের স্কুলচাকরিতে অগ্রাধিকার। সকল বিষয়ে মধ্যমানের, মধ্যমেধার যারা তাদের সোজা রাস্তায় চলা ছাড়া গতি কী? না তেমন বলিয়ে কইয়ে, না মিটিং মিছিল, না তেমন দরের নেতানেত্রী দাদাদিদির সঙ্গে ওঠবোস! না আর কোনও গুণ! এক ওই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটগুলোই ভরসা। কাগজের চাকরি চাই বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়ি, আবেদনপত্র পাঠাতে থাকি। অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি আর ভাবি, স্বপ্ন দেখি আর পাঁচটা বাঙালির মতোই! ইন্টারভিউয়ের ডাক এল বলে, চাকরি পেলাম বলে, মাসের শেষে লক্ষ্মীর ঝাঁপি উপুড় হল বলে আর আহা কী সুখ! কী সুখ! চেষ্টা চালিয়ে যাই, হতাশ হই না মোটে, হয়তো তারুণ্যের জোশ! স্কুলের চাকরিতে বিএড ডিগ্রিধারীরা অগ্রগণ্য তাই আরেকটি দরকারি সার্টিফিকেট সংগ্রহের চেষ্টা। সুতরাং মহানন্দে বিএড কলেজে ভর্তি আর পুনরায় ছাত্রাবস্থা প্রাপ্ত হলাম। সরকারি বিএড কলেজ তখন সত্যিই সর্ব অর্থে চমৎকার, স্টাইপেন্ড পাওয়া যায়, কী আনন্দ!
তো আবার ফিরি চলুন বিএড কলেজের প্রথমদিনের ক্লাসরুমটিতে। মাঝবয়সী এমআরসি স্যার সবার সঙ্গে আপনি সম্বোধনে কথা বলছেন। সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন, নামধাম জিজ্ঞাসা করলেন। সাবজেক্ট ও রুটিন বিষয়ে আলোচনা হল। খুব হাল্কাচালে কথা বলেন স্যার, তিনি জানান আগামীকাল থেকেই পরীক্ষা। আমরা আকাশ থেকে পড়ি, সমস্বরে চিল্লানো শুরু ‘সে কী স্যার, না বই, না পড়া কী লিখব স্যার?’ যথেষ্ট সুরসিক মানুষটি গম্ভীরমুখে জানান, ‘ইন্টারনাল মার্কস, দয়া করে এই শব্দবন্ধটি মাথায় রাখবেন। আজকের এই মুহূর্ত থেকেই আপনাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে বলা যায়।’ মুচকি হেসে যোগ করেন, ‘এইযে স্কুলছাত্রের মতো সবাই একসঙ্গে চিৎকার করলেন, এতেও নাম্বার কাটা যেতে পারে। মনে রাখবেন, বেঞ্চে বসে থাকলেও আপনারা সে অর্থে ছাত্র নন। আপনারা ভালো শিক্ষক হবার সূত্রগুলো জানতে বা ট্রেনিং নিতে এসেছেন। আপনাদের প্রতিটি আচরণের এসেসমেন্ট চলতে থাকবে।’ স্যারের এই কথায় মুহূর্তে সব হাল্লাগুল্লা বন্ধ, সবাই শান্ত সুশীল ভঙ্গীতে স্যারের দিকে চেয়ে রই। প্রতিটি আচরণের এসেসমেন্ট হবে! কী জ্বালা! স্তব্ধ ক্লাসে এবারে রোলকল শুরু, প্রত্যেকের নাম আলাদা করে উচ্চারণ করছেন এমআরসি স্যার।
বিএড ডিগ্রিটি না থাকায় ইনক্রিমেন্টে কোপ পড়া বহুসংখ্যক বয়স্ক শিক্ষকেরা ব্যাজার মুখে বসে আছেন বেঞ্চে। সুখি গৃহকোণ(?) এবং বহুকালের পরিচিত স্কুলপ্রাঙ্গন ছেড়ে এখন আবার নতুন করে ছাত্রাবস্থা প্রাপ্তি! আবার পড়াশুনো, পরীক্ষা, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, প্র্যাকটিকাল ক্লাস, প্রতিটি সাবজেক্টের জন্যে লেসেন প্ল্যান ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার ঝঞ্ঝাটের সমুদ্রে ঝাঁপ! একজন যিনি শিক্ষকতার বৃত্তিতে অভ্যস্ত বহুবছর যাবৎ তার পক্ষে ফের ছাত্র হয়ে ওঠা, বিষয়টি ততই কি সহজসাধ্য! যাইহোক আমরা ফ্রেশাররা খুশি, বাড়িতে বসে বসে দিবাস্বপ্ন দেখার চাইতে এ অনেক ভালো হল। নতুন কিছু শিখনের মধ্যে একটা আলাদা আশা আর আনন্দ তো আছেই!
রোলকল চলছে, নতুন মুখগুলো সাগ্রহে দেখছি। স্যারের ভরাট গলায়, রোল নাম্বার থার্টিফাইভ উচ্চারণ হতেই ‘প্রেজেন্ট স্যার’ – পেছনের সারি থেকে একটি সুতীব্র, তীক্ষ্ণ শব্দবাণ যেন স্তব্ধ ক্লাসরুমটির এমাথা ওমাথা ফুঁড়ে বেড়িয়ে গেল! প্রত্যেকেই কেমন নড়েচড়ে বসে। স্যারও খানিক বিরতি নিয়ে এদিক পানে তাকিয়ে থেকে নিজকর্মে মনোনিবেশ করলেন। ওই বিচিত্রকন্ঠীটিকে সে মুহূর্তে দেখতে পেলাম না বটে, কিন্তু তিনি যে বিশেষ কেউ সেটা কয়েকমাস পরে হাড়েহাড়ে টের পাওয়া গেল। যাইহোক ক্লাস ছাড়ার আগে স্যার জানিয়ে গেলেন আগামীকালের পরীক্ষা বলতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক ছাত্রের বিবিধপ্রকার গুণের পরীক্ষা অর্থাৎ কিনা কো-কারিকুলার এক্টিভিটিসের মান যাচাই হবে, এতে নাম্বারও আছে। কলেজের সব শিক্ষকেরা উপস্থিত থাকবেন, তাঁদের সকলের সামনেই নিজ নিজ পারঙ্গমতা প্রমাণ করতে হবে। একজন প্রকৃতশিক্ষক শুধু শ্রেণীকক্ষের একটি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রম পড়িয়ে শেষ করে দেবেন, পরীক্ষা নেবেন, খাতার মূল্যায়ন করবেন, নাম্বার দেবেন, তাতেই কি সব হল? শ্রেণীকক্ষের পাঠদান ও গ্রহণের জন্যে আনন্দময় পরিবেশ চাই। পাঠ্যবিষয়টি ছাত্র যেন সহজ আনন্দে গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষককে। হাসিখুশি, মিশুকে, আনন্দময়, আত্মবিশ্বাসী শিক্ষক ছাত্রদের পছন্দের মানুষ হন। মুখচোরা, লাজুক, গম্ভীর, অমিশুকে, কর্কশভাষী শিক্ষক ছাত্রের মনের কাছে যাবেন কিভাবে। পঠন প্রক্রিয়ায় মন আর মননের বড় ভূমিকা রয়েছে। ছাত্রের হৃদয়টিকে প্রস্ফুটিত ও আলোকিত করার দায়িত্ব শিক্ষকেরই। ভালো ছাত্রই ভালো শিক্ষক হবেন এমনটি নাও হতে পারে; শিক্ষকের আরও কিছু অলিখিত গুণাবলি থাকা চাই। সুতরাং ...।
সবই তো বুঝলাম কিন্তু নতুন কলেজে নতুন শিক্ষক, নতুন সহপাঠীদের সামনে নৃত্য, গীত, অভিনয়, আবৃত্তি বা ভাষণদান সবই বড় কঠিন মনে হতে লাগল। তাতে আবার ইন্টারনাল এসেসমেন্ট, হায় রে! আগামীকাল নিজগুণাবলী প্রদর্শনের আনন্দে কতিপয় সহপাঠী উৎফুল্ল হলেন, বেশিরভাগই আতংকিত ও বিমর্ষ। আমিও দ্বিতীয় দলেই। কী করি কী করি ভাবনায় অস্থির! পরের দিনেটি কিন্তু সর্ব অর্থেই সার্থক হয়েছিল। পরিচয়পর্বে, নাচে, গানে, কথায়, আলাপে আলোচনায় সবভীতি কেটে গিয়ে একদিনেই ছাত্র শিক্ষক সবাই যেন খুব কাছাকাছি এসে গেলাম। বহুকালের অনভ্যাসের পরেও সকলের চেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। পাঠ নিতে আসা বয়স্ক এক শিক্ষিকা ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’ নেচে মঞ্চ কাঁপালেন। ওনার এই ধেইধেই নৃত্য দর্শনে আমার কেমন অস্বস্তি হয়! কবিতা আবৃত্তি করলেই তো বেশ শোভন হত, তা না। কিন্তু এরকম ভাবলে হবে? আমাদের কলেজের প্রতিটি শিক্ষক নৃত্যশিল্পীর প্রবল এনার্জির প্রভূত প্রশংসা করলেন! তেল চকচকে চুলে মোটা বিনুনি, গোলগাল ফর্সাচেহারার, বিচিত্রকন্ঠী রোল নম্বর থার্টিফাইভ সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে কাজি নজরুলের ‘খুকু ও কাঠবিড়ালি’ কবিতাটির কয়েকটি চরণ আবৃত্তি শুরু করে, হঠাৎ মাঝপথে বিরতি দেয়, আঙুলে মটকায় এবং হঠাৎ দুহাত জুড়ে নমস্কার জানিয়ে, দর্শকাসনের মৃদু গুঞ্জন ও মৃদুহাস্যরোল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তরতরিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে চলে যায়। জানা গেল তার নাম মৃন্ময়ী রায়চৌধুরি। কলেজবেলার বন্ধু শুভ্রা আর অনিকেত পাঠ করে ‘কর্ণ কুন্তি সংবাদ’। নিজে গিয়ে ক্ষীণকন্ঠে গেয়ে আসি মীরার ভজন, ‘মেরে তো গিরিধারি গোপাল/ দুসরা না কোই।’ বন্ধুরা খ্যাপায়, বললেই হল ‘দুসরা না কোই... এ কি ব্যাপার তোর শুধুই গিরিধারি গোপাল, আর কেউ নেই রে? আহা রে! তা কবে বৃন্দাবন যাত্রা তোমার। টিকিট পেয়েছ? আর এ সি নাকি কনফার্ম টিকিট বাছা? ওখানকার স্কুলেই জয়েন করবে তো। বেশ বেশ!’
তবে উদাত্ত কণ্ঠে কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে পুরো কলেজের হৃদয়টি মুহূর্তে জয় করে নিলেন শুভজিতদা। শুভজিত চক্রবর্তী, বেশ আকর্ষক চলনবলন, হাট্টাকাট্টা চেহারা, অনেকটা সঞ্জীবকুমার স্টাইল! জানলাম ভালো ফুটবলার, তায় শাসকদলের ঘনিষ্ট, তায় বেশ মিশুকে। চমৎকার ভাষণ দিতে পারে, কন্ঠস্বরের মডিলিউশন প্রশংসনীয়! প্রতিটি ছেলে-মেয়ে তার ফ্যান বনে গেল সেই শুভদিনটি থেকে! সেই সেশনের জি.এস. নির্বাচিত হলেন অবলীলায়। জানলাম চাকরি করেন ডুয়ার্সের কোনও স্কুলে। পরবর্তীতে সহপাঠিনীদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সুন্দরী অর্পিতাদিকে তিনি ‘জীবনসাথী’ নির্বাচন করলেন। কলেজ পিকনিকে ঝালং বেড়াতে গিয়ে একটি বুনো অর্কিড হাতে দিয়ে প্রপোজ করেন, আর সেই হাল্কা গোলাপি অর্কিড দুদিন ধরে তার অপূর্ব দেহকান্ডের পৃষ্ঠদেশে দোলায়িত সুদীর্ঘ বিনুনিটিতে জড়িয়ে রেখেছিল অর্পিতাদি। কী রোমান্টিক সে সব দিন!
যদি বলেন এতসব ব্যক্তিগত দৃশ্যাবলী দর্শন করলেন কীরূপে? উত্তর হল কিছু কিছু দৃশ্য শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারাই প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমরা আর কী! তা এমন মাধুর্যমন্ডিত ঘটনা প্রতিটি সেশনেই একটা দুটো ঘটে উঠত। আমাদের কলেজের একাধিক অধ্যাপকও পড়তে আসা ছাত্রীদের মধ্যেই জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনকি এমআরসি স্যারও একইভাবে দেখা পেয়েছিলেন সুদেষ্ণাদির, যিনি ছিলেন আবার আমার স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। সহপাঠীদের মধ্যে দুই নব্যতরুণ ছিল আমাদের বিশ্বস্ত শ্রবণেন্দ্রিয়। ছোটোখাটো চেহারার কারণে তাদের দুটিকে আমরা ভাই ডাকতাম। কী করে তারা এতকিছু জেনে ফেলে তা যথেষ্ট বিস্ময় উদ্রেককারী ঘটনা তো বটেই। কলেজের বিবিধ সিলেবাস নানা উপায়ে সম্পন্ন করে প্রায় প্রতিটি শিক্ষক ও ছাত্রের গতিবিধি নাড়িভুঁড়ির খবর সংগ্রহে ওই দুই নন্টে-ফন্টের ছিল প্রবল আগ্রহ। তবে বিনামূল্যে খবর হাতবদল হত না একেবারে; প্রতিটি খবরের জন্যে ক্যান্টিনে তাদের পছন্দের খাবার খাইয়ে তবে গিয়ে খবর।
দিনগুলো এককথায় যথেষ্ট ভালো কাটছিল। চমৎকার একটা ক্যানটিন আছে, অফ পিরিয়ডে দেদার আড্ডা চলে। সেকালের হিসেবে চা, নোনতা বিস্কিট, দেশি কেক, নিমকি, ডালপুরি, ঘুগনি-লুচি, সিঙ্গারা ইত্যাকার মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। ভালো লাইব্রেরী আছে। ব্যাডমিন্টনের কোর্ট আছে। আর আমার অনেকদিনের সাধ অঙ্কন শেখা, তারও একটা ছোট্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। সবমিলিয়ে বেশ ভালোলাগার অনুভূতি। সবার সঙ্গেই মোটামুটি বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দ্রুত।
হস্টেলে সিট নেই, খুব লিমিটেড সিট। ধরাকরা, চেনাজানা ইত্যাকার ব্যাপার আছে শুনলাম। সেকারণে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আমাদের ছ’জনের মেস তৈরি হল। এমন মেস শহরে আরও কয়েকটি আছে। সবাই ফ্রেশার, আমরা তিনজন স্কুল আর কলেজের এক-দুবছরের সিনিয়র জুনিয়র বাকি তিনজনের সঙ্গে কলেজে পরিচয়। ছোট্ট এক নালার ওধারে বয়েজ হস্টেল, সুপার সেই এমআরসি। হস্টেলের সংলগ্ন দুটি ঘর নিয়ে সপরিবারে থাকেন। ওনার স্ত্রী আমার স্কুলবেলার সেই আদুরে চেহারার শিক্ষিকা। সে যাহোক ওই হস্টেল থেকেই আমাদের দুবেলার খাবার ব্যবস্থা হল। এদিকে সবাই চাঁদা দিয়ে মেসে নতুন স্টোভ এবং আরও কিছু বাসন কেনা হল; চা-টিফিন ইত্যাদির জন্যে। নালার জলে কাপড় কাচে সীতানাথ ভাই, কিছু টাকার বিনিময়ে তার এপয়েন্টমেন্ট হল। সে প্রতিদিন দুবেলা বয়েজ হস্টেল থেকে ছয়টি টিফিন ক্যারিয়ারে আমাদের খাবার এনে দেয়। নিজেরা নানান দ্রব্য রান্না করে খাই, রাত জেগে পড়া, প্রজেক্ট তৈরি ইত্যাদি চলে, চলে প্রবল আড্ডাও। দুচারদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল পাড়ার ছেলেপুলেরা মেসটি সর্ম্পকে অত্যন্ত কুতূহলী! সীতানাথ ভাইয়ের পথরোধ করে টিফিন ক্যারিয়ারের মেনু জানতে চায় তারা! মেসের দিদিদের আরও নাম ধাম ইত্যাকার খবরাখবর চায়! কী মুস্কিল! আমরা সীতানাথভাইকে পই পই করে বারণ করি ‘খবরদার না। হমারে বারে মে কুছ মাত বোলো ভাইয়া। খানা মাত দিখাও ও লোগোকো। সমঝা। বিলকুল নেহি।’
কদিনের মধ্যেই চেহারা অনুসারে আমাদের নামকরণ করে তারা। হিন্দী গান গায় ‘এক লেড়কি কো দ্যাখা তো এয়সা লাগা’ ‘দিল হ্যায় কি মানতা নেহি’ ‘নজর কি সামনে’ একজন নিত্যই রোম্যান্টিক বাংলা গান গায় ’চল না দিঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনে ছায়ায় ছায়ায়’...সাইকেল নিয়ে পিছুপিছু কলেজ অব্দি ধাওয়া করে। কী মুস্কিল! আরে আমরা তোদের টিচার হতে যাচ্ছি রে বাছারা, আমরা কি আর স্কুলবালিকা নাকি কলেজের ফার্স্ট ইয়ার! যাইহোক আমাদের উদাসীন হাবভাব, সোমাদি আর কল্পনাদির রাগীচোখে পলকহীন দৃষ্টিপাত, বয়েজ হস্টেলের সঙ্গে সখ্য ইত্যাদি দেখে দেখে মাসখানেকের মধ্যে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল।
তবে কীভাবে মদনের বাণে বিদ্ধ হয়ে ল’কলেজের ফাইনাল ইয়ার সেই বাংলা রোমান্টিক গাইয়েটির সঙ্গে আমাদের সুচন্দ্রার একপ্রকার ভাব বিনিময় হতে লাগলো এবং যৎপরোনাস্তি বিস্ময়কর ঘটনা হল গলির মাথার বড়গেটওয়ালা, হৃদকম্প উৎপাদনকারী এলসেশিয়ান ডাকা বাড়িটি থেকে একদিন আমন্ত্রণ এল সান্ধ্যচায়ের আসরে যোগদানের জন্যে! আমরা গেলাম চা সঙ্গে বহুপ্রকার টা খেয়ে বড্ড খুশি হলাম। গহনাসমৃদ্ধ বাড়ির মহিলারা হাসিমাখা মুখে নানা বিষয়ে গল্প জুড়লেন। পারিবারিক খোঁজখবরও খুঁটিয়ে নিতে লাগলেন কিন্তু আমাদের সাম্প্রতিক পড়াশুনো বা ক্যারিয়ার বিষয়ে একটি শব্দও জিজ্ঞেস করলেন না। পরে ওই আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য-বিধেয় অবগত হওয়া গেল। ওবাড়ির বড়গিন্নীর আমাদের তানিয়াকে খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর কানাডা প্রবাসী ডাক্তারপুত্রের জন্যে!
তা এরকম নানা ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের ওই দশমাসের কোর্সটি সত্যি সবদিক থেকেই অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। নতুন বান্ধবী জোগাড় করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালদার রতিকান্তদার কাছে প্রবল আব্দার করে একহাঁড়ি রসকদম্ব আনয়ন এবং ভক্ষণ। প্রাণপণ খেটে কলেজ সোস্যালের অপূর্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন বিভাগের অসাধারণ এক্সিবিশনের আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট পদাধিকারী আর শহরের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রতিবছরই বিএড কলেজের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন। রমরম করে অনুষ্ঠান হল। একমাসের ‘প্র্যাকটিস টিচিং’ পর্বে আমরা নানা স্কুলে ছড়িয়ে গেলাম। দারুণ অভিজ্ঞতা, এই প্রথম সরাসরি ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ। খুব খুব খুশি হয়েছিলাম এই পর্বে।
সত্যি কথা বলতে এই আমচরিতের পর্ব থেকে পর্বান্তরের লেখাগুলো আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের সঙ্গে একটা ফেলে আসা কালের কথাও বটে! সহজতার রেনুমাখা যে সময় আর কখনও ফিরবে না। যাইহোক আমাদের নন্টে-ফন্টে আর রোলনাম্বার থার্টিফাইভ অর্থাৎ সে মৃন্ময়ী রায়চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে আজকের লেখাটির সমাপ্তি টানবো।
কলেজে কদিন হঠাৎ অনুপস্থিত আমাদের নন্টে তথা বাসুদেব! ফন্টে তথা মুকুলের কাছেও কোনও সদুত্তর পেলাম না! ও জানায় ‘বাসুদেবের বাড়ি সেইই শিরীষতলা ছাড়িয়ে আরও দূরে, ওর খবর তো জানিনা। শরীর টরীর খারাপ হইতে পারে।’ দিনদুয়েক পরে শুকনো মুখে হাজির সে, কেমন যেন স্বভাববিরুদ্ধভাবে চুপচাপ! লাস্ট পিরিয়ডে আর্টস এন্ড ক্রাফটসের ক্লাস। কলেজ তখন প্রায় ফাঁকা, দেখি ও সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। ‘কীরে আসিসনি কেন দুদিন? কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’ হাল্কা হেসে ও বলতে থাকে সে অভাবিত কাহিনি। আমি হেসে কুটিপাটি হই।
‘জানিস তনুদি মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগ দিয়ে আমাদের পাড়ায় একটা পুলিশের জীপ ঢুকে আমার খোঁজ শুরু করে। সবাইকে জিজ্ঞাসা করতেছিল বাসুদেব চক্রবর্তীর বাড়ি কোনটা। আমি তখন গরু আনতে গেছিলাম মাঠে। বাড়িতে ঢুকব আরকী। এইসময় ভাই আইসে বলল, দাদা তোকে পুলিশে খুঁজতেছে। বাড়ির সামনে দিয়া যাইস না। পুলিশের গাড়ি দাঁড়ায় আছে। বাবা বলল কোথাও লুকায় থাকগা। এখন ঢুকিস না বাড়িতে। গরুগুলা নিয়া ভাই বাড়িতে ঢুকল আর আমি ওইখানে একটা নারকেল গাছে উইঠা বইসা থাকলাম। গাড়িটা আধাঘন্টা বাদে চইলা গেল। ততক্ষণ গাছের উপরে বইসা ছিলাম কষ্ট কইরে জানিস। কত পিঁপড়া কামড়াইছে রে। তুই হাসতেছিস! আমার কী হাল হইচিল জানিস না তো।’
‘তা তুই লুকালি কেন? গাছেই বা উঠলি কেন? জিজ্ঞেস করবি না কী চায় তারা? কেন খুঁজছিল তোকে? তারপর?’
‘তারপরের দিন ভোরবেলায় গাড়ি নিয়া আবার একটা পুলিশ আইসা আমাকে ধইরা ফেলাইল। ব্যাপার কীছুই না। ওই ব্যাটা রোল নাম্বার থার্টিফাইভের কারবার। এতগুলা ছাত্র থাকতে সাইকোলজির ক্লাসনোটের খাতাটার জন্য আমার কাছে লোক পাঠাইচে। ওর বাবা বলে এখানকার পুলিশের বড় অফিসার। আমার তো জ্বর আইসা পড়চিল বুঝচিস! তাই দুইদিন কলেজ কামাই গেল। আমার মা তো মানত কইরে ফ্যালচে।’
‘সত্যি তুইও পারিস রে। কোনও দোষ না করেও এত ভয়? তোকে মনে হয় থার্টিফাইভের খুব পছন্দ রে। আর চিন্তা নাই, অফিসারের জামাই হবি।‘
‘শোন তনুদি ঘটনাটা কাউক্কে বলিস না কিন্তু। দিব্যি দিলাম।’
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team