দীর্ঘ প্রায় সাত দশকের পরিচয়হীনতা, অনস্তিত্ব, অসহায়তা, স্তব্ধতা, দীর্ঘশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতা ও তথাকথিত সভ্যতার সম্পূর্ণ বিপরীত যাপনের পর ২০১৫তে এসে ছিটমহলবাসীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাঁদের কাছে ছিটমহল বিনিময় যেন ছিল ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’। ৩১ জুলাই সূর্যাস্তের পর থেকেই অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিটমহলগুলি জেনারেটর ও মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। দেশভাগের পর ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির আনন্দে সামিল হন জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই। সীমান্তের এপারে সব ছিটমহল জাতীয় পতাকায় ও আলোর রোশনাইয়ে ভেসে গিয়েছিল। ১লা আগস্ট সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে পোয়াতুর কুঠি, মশালডাঙা, বাকালির ছড়া, শিবপ্রসাদ মুস্তফি, নলগ্রাম, ফলনাপুর প্রভৃতি বাংলাদেশের সাবেক ছিটমহলে সকাল ৯টায় মহাসমারোহে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকার উত্তোলন করেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। একে অপরকে আলিঙ্গন করেন। মঞ্চ বাঁধা হয়। নেতারা আসেন। ছিটমহল বিনিময়ে তাঁদের ঐতিহাসিক অবদানের কথা দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন। সঙ্গে দিয়ে যান একাধিক প্রতিশ্রুতিও। দশকের পর দশক ধরে বঞ্চনা ও অবহেলায় থাকা হতদরিদ্র মানুষগুলি দিন পাল্টানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
কিন্তু অচিরেই ফানুসের মত উবে যায় সে’সব স্বপ্ন। এই স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেই প্রায় হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে সপরিবারে সীমান্তের ওপার থেকে ‘অপশন’ দিয়ে চলে আসেন এপারে। তাঁদেরও চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। এসে ওঠেন ‘এনক্লেভ ক্যাম্পে’। ফিরে আসে সাতচল্লিশ ও একাত্তরে শরণার্থীদের ক্যাম্প যাপনের স্মৃতি। পার্থক্য একটাই এই ক্যাম্পের আশ্রিতরা হলেন ভারতীয়। এঁরাও ছিলেন দীর্ঘ অনুন্নয়নের অংশীদার এবং ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিলেন। প্রায় সাত দশকের বঞ্চনা ও অনুন্নয়ন কোন যাদুদণ্ড দিয়ে এক লহমায় পরিবর্তিত করা কার্যত ছিল অসম্ভব। তাঁদের প্রত্যাশার পারদ এতই ঊর্ধ্বমুখী ছিল যে তা অচিরেই প্রথম স্বাধীনতার মত স্বপ্নভঙ্গের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
উন্নয়ন
সদ্য ভারতভুক্ত এই অতি প্রান্তিক ও অনুন্নত সাবেক ছিটমহলগুলিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির সমপর্যায় ভুক্ত করতে প্রয়োজন ছিল পাহাড় প্রমাণ কাজের। এর জন্যে সময় ও বিপুল অর্থের যে প্রয়োজন, সেকথা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সম্যক জানতেন। বিনিময়ের পর কেন্দ্র সরকার সাবেক ছিটমহলের উন্নয়নের জন্য ৩০০৮ কোটি টাকার কথা ঘোষণা করে। এই বিপুল অর্থ বরাদ্দের কথা শুনে অসহায় মানুষগুলি দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র ৫০ কোটি টাকা। সীমিত অর্থের মধ্যেও প্রশাসনের তরফে শুরু হয় উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ, বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিকরণ, কমিউনিটি হল স্থাপন প্রভৃতি অগ্রাধিকার পায়। এছাড়াও ‘জব কার্ড’, ‘রেশন কার্ড’, ‘আধার কার্ড’ করার বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছিল।
ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তর্গত যে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল এদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়, অধিকাংশই কুচবিহারের আর দশটা সীমান্তবর্তী চির অবহেলিত গ্রামের মতই। কোনও গ্রাম হিন্দু রাজবংশী অধ্যুষিত, কোনটি মুসলমান অধ্যুষিত। আবার কোন গ্রাম হিন্দু-মুসলমান মিশ্রিত। অভিযোগ ওঠে, কোনও কোনও ছিটমহলে উন্নয়নে চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এই ‘উন্নয়ন’ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-প্রতর্ক চলতেই থাকে। শুধু অনুন্নয়নের তরজাই নয়, এই প্রান্তিক গ্রামগুলির রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে নেমে পড়ে সব দল। শুধু জেলা স্তরেই নয়, বিভিন্ন দলের রাজ্য স্তরের নেতা-নেত্রীরা সদ্য ভারতভুক্ত গ্রামগুলিতে এসে সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে জোর দেন। এদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ছিটমহলের পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। ছিটমহলের রাস্তাঘাট, পানীয় জলের ব্যবস্থা, অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র, প্রাথমিক স্কুল, কমিউনিটি হল প্রভৃতির কাজ দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হলেও সমালোচনা পিছু ছাড়ে নি। ছিটমহলবাসীদের একাংশের অভিযোগ ছিল, তাঁদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থ অন্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। কুচবিহার জেলার ‘সাব ডিভিশনাল হসপিটালে’র উন্নয়ন, ৪২৪ কোটি টাকার মেখলিগঞ্জ-হলদিবাড়ির সংযোগকারী ব্রিজ নির্মাণ প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ সাবেক ছিটমহলবাসীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
সাবেক ছিটমহলগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই একবাক্যে মেনে নিলেও, এর মধ্যে নিহিত ছিল বহু জটিলতা। কারণ কেন্দ্র সরকার যে অর্থ মঞ্জুর করেছে তার সিংহভাগ বরাদ্দ হয় ভারতীয় ছিটমহল থেকে আসা বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্যে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় যে ৩০০০ কোটি টাকার মধ্যে ২৪২৫ কোটি টাকাই বরাদ্দ হবে তাঁদের পুনর্বাসনের জন্যে। ফলে সংযুক্ত হওয়া ৫১ টি ছিটমহলের প্রায় ১৬ হাজার অসহায় মানুষের উন্নয়নের পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে আসা মাত্র হাজার জনের জন্য সিংহভাগ অর্থবরাদ্দের বিষয়টি ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। এদিকে বিনিময়ের পর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও,অর্থ বরাদ্দ নিয়েও উভয় সরকারের মধ্যে তরজা চলতেই থাকে। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠে আসে যে, কেন্দ্র সরকার বরাদ্দ অর্থ অনুমোদন করেনি। ২০১৫-১৬ সালে ১০০৫.৯৯ কোটি টাকা কেন্দ্র সরকার অনুমোদন করলেও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশী ৫৮২.৯৯ কোটি টাকা ছিটমহল উন্নয়নের জন্যে রাজ্য সরকার হাতে পায়নি বলে অভিযোগের কথা শোনা যায়। অর্থের অপ্রতুলতায় সাবেক ছিটমহলের উন্নয়নের কাজ ধীর গতি সম্পন্ন হলে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। পূর্বে এই স্থানগুলিতে কোনরূপ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দশকের পর দশক ধরে কঠিন সংকটের মধ্যে দিন গুজরান করতে হয়েছিল। একথা বিবেচনা করেই রাজ্য সরকার সাবেক ছিটমহলগুলিতে প্রাথমিক স্কুল, অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নেয়। তা নিয়েও জটিলতা কম হয় নি। শিক্ষক ও স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগে সাবেক ছিটমহলবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এমন দাবীও ওঠে। ক্ষোভ- বিক্ষোভের সালতামামির মধ্যেই বস্তুগত উন্নয়নের এই ধারা পূর্বেকার চালচিত্রকে আংশিক হলেও পরিবর্তন করে।
জীবন-জীবিকার সংকট
১লা আগস্টের আলোর রোশনাই দ্রুত নিভে যায়। সামনে চলে আসে প্রখর বাস্তব। বিনিময়ের বহু আগে থেকেই, ছিটমহলে বসবাসকারীদের জীবন ও জীবিকার প্রায় সমস্ত পথ অবরুদ্ধ ছিল। সিংহভাগ বাসিন্দা কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও, জমির মালিকানা তাঁদের ছিল না। চাষাবাদ করলেও, তাঁরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পেতেন না। ফলে অনেকেই যেমন ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়, তেমনই অনেকেই অবৈধ উপার্জনের পথে সামিল হতে বাধ্য হয়। বিনিময়ের পর অনেকেই তাই নতুন সংকটে পড়েন। কারণ বিনিময়ের পূর্বে অবৈধ কারবারিরা বর্ডার সংলগ্ন ছিটমহলগুলিকে বছরের পর বছর ধরে চোরাচালান সহ একাধিক অবৈধ কাজে ব্যবহার করে এসেছিল। আর এই অবৈধ উপার্জনের ওপর বাধ্য হয়েই প্রান্ত ভূখণ্ডবাসীদের একাংশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বেশ কিছু ছিটমহলে গাঁজার চাষ হত। যেখান থেকে বিপুল অর্থাগম হলেও, ছিটমহলবাসীদের কপালে জুটত সামান্যই। এদিকে ভারতীয় পুলিশ প্রশাসন সেকথা জানলেও, তাঁদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া গত্যান্তর ছিল না। কারণ তাঁদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে বিনিময়ের পর ওই গ্রামগুলিতে প্রশাসনের সক্রিয়তায় গাঁজা চাষের পাণ্ডাদের আধিপত্য হ্রাস পায়। কিন্তু ফলে এর ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা কার্যত জীবিকাহীন হয়ে পড়েন।
এছাড়াও বিনিময়ের পর নতুন করে জমির সংকট দেখা দেয়। কারণ অধিকাংশেরই ভোগ দখল করা জমির কার্যত কোনও কাগজ ছিল না। তাই তাঁদের সেই অধিকারের কোন বৈধতাও ছিল না। এদিকে নতুন নিয়ম অনুযায়ী জনবসতি শূন্য ছিটমহলগুলির জমি সরকারের অধিকারে চলে গেলে অনেকেই জমিহারা হয়ে যান। যেমন মেখলীগঞ্জের জামালদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ১৯৩ নং রতনপুর গ্রামের সত্তরোর্ধ দেবেশ্বর বর্মণ সাবেক ছিটমহলে ৩ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেই সংসার চালাতেন। তিনি জানতেনও না যে তাঁর ওই জমি ছিটমহলের মধ্যে ছিল। কিন্তু বিনিময়ের পর ওই ছিটমহলের জমির ওপর সরকারের অধিকার কায়েম হলে তাঁর সেই অধিকার খর্ব হয়। তিনি ওই জমিতে চাষের অধিকার হারিয়ে কার্যত জীবিকাহীন হয়ে যান।
ছিটমহলবাসীদের জীবন ও জীবিকার সংস্থান করা প্রশাসনের কাছে ছিল এক বড় পরীক্ষা। পূর্বের তুলনায় এই প্রান্তিক গ্রামগুলিতে অপরাধ কমলেও, তাঁদের উপার্জনের পথ সেভাবে উন্মুক্ত হয়নি। তাঁদের চিরাচরিত জীবন সংগ্রামের সাথে সম্পর্কহীন তথাকথিত উন্নয়নের ধারায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটা তাই অস্বাভাবিক ছিল না। এমনিতেই বিনিময়ের পর থেকেই তাঁরা বৈধ নাগরিকত্বের পত্র, ১০০ দিনের কাজ, সপ্তাহে ৭ লিটার কেরোসিন তেল ও রেশন দেওয়ার দাবী জানাতে থাকে। প্রশাসনের তরফে ‘জব কার্ড’ প্রদানের ক্যাম্প খোলা হয়। ৫১টি ছিটমহলের ১৫,৮৫৬ জনকে বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণ দ্রুত হাতে তুলে দেওয়া ছাড়াও ব্যাঙ্ক আকাউণ্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে তাঁরা ‘জব কার্ডে’র আগে ‘আধার কার্ড’ দেওয়ার দাবী তোলেন। আধার কার্ড নাগরিকত্বের অন্যতম প্রধান প্রমাণপত্র হওয়ায় ভিনদেশে কাজ করতে যাওয়া সহ অন্যান্য অনেক কাজেই তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘জবকার্ডে’র আগে ‘আধারকার্ড’ দেওয়ার দাবী দিনহাটা মহকুমার পোয়াতুরকুঠি, মশালডাঙ্গা থেকে আগে উঠলেও, তা ক্রমে অন্যান্য সাবেক ছিটমহলেও দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এবিষয়ে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় সমিতি’। ৩১ আগস্ট তারিখে খলিসামারির ফলনাপুরে প্রশাসনের তরফে ‘জবকার্ড’ বিতরণের ক্যাম্প খোলা হলেও, ‘ছিট সুরক্ষা সমিতি’র নেতৃত্বে সাবেক ছিটমহলবাসীরা বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ তুলে ‘জবকার্ড’ গ্রহণবয়কট করে। বরং তাঁরা তাঁদের জমির বৈধ অধিকারের নথির দাবী তোলেন।
ছিটমহল বিনিময়ের পর গ্রামগুলি বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতায় এলে স্থানীয় মহিলাদের জীবিকার পথ সুগম করতে এবং তাঁদের ক্ষমতায়নের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছিল। সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা করলেও, স্থানীয় স্তরে তা সঠিকভাবে কার্যকরী যে হয়নি, তা নিয়ে অভিযোগ ওঠে একাধিকবার। যেমন বাত্রিগাছ গ্রামে যে পাঁচটি মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলা হলেও, সেগুলি আর্থিকভাবে লাভবান করে তোলার ক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে।
জমির অধিকার
ছিটমহল বিনিময়ের প্রাক্কালে অনেকেই দোলাচলে ছিলেন। এর মূল কারণ ছিল জমি। অনেকেরই ধারণা হয়েছিল বিনিময়ের পর তাঁদের জমি হারাতে হবে। অনেকেই বিনিময়ের পরিবর্তে যোগাযোগের জন্য বর্ডারে করিডোর স্থাপনের দাবী তোলে। এছাড়াও জমি মাফিয়াদের হাত থেকে জমিকে রক্ষার জন্যেও তাঁরা সোচ্চার হন। অর্থাৎ জমির মালিকানার বিষয়টিই ছিটমহলবাসীদের প্রথম ও প্রধান চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতাও কম ছিল না। কারণ এখানে অধিকাংশ ছিটমহলবাসী জমি ভোগ দখল করলেও, জমির প্রকৃত মালিকানা ছিল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে। যাঁদের বিরাট অংশ ইতিপূর্বেই ভারতীয় ভূখণ্ডে জমি-জমা কিনে বসবাস শুরু করেছেন ও ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। বিনিময়ের আগে এই অঞ্চলে আমূল ভূমিসংস্কার না হওয়ায় অধিকাংশ সাধারণ কৃষকের হাতে জমির কোনও পাট্টা ছিল না। বহু ছিটমহলে স্বল্প কিছু ব্যক্তির হাতে বিপুল জমির মালিকানা বহু আগে থেকেই ছিল। এমন অনেক ভারতীয় নাগরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে যাঁরা ছিটমহলে শতাধিক বিঘা জমির মালিক ছিলেন। ছিটমহলগুলিতে সাবেক জোতদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ না হওয়াতেই বিনিময়ের পর নতুন করে জমি সংকট সৃষ্টি হয়। বিশেষত সাবেক জোতদারদের হাতে থাকা বিপুল জমির বন্দোবস্তও জরুরী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে জমির মালিকানাহীন অধিকাংশ ছিটমহলবাসীরাও চরম আশঙ্কায় দিন গুজরান করতে থাকেন। মাথাভাঙ্গা মহকুমার অন্তর্গত ‘নলগ্রাম-ফলনাপুর-জোংড়া ছিট নাগরিক সুরক্ষা কমিটি’ অবিলম্বে তাঁদের ভূসম্পত্তির অধিকার অপরিবর্তিত রেখে মালিকানা ঘোষণার দাবী তোলেন। এছাড়াও তাঁদের সম্মতি ছাড়াই সাবেক ছিটমহলগুলির এলাকাকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সাথে এক করে নতুন মৌজা পুনর্গঠিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এর ফলে জমির মালিকানা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাঁদের বিপুল সমস্যায় পড়তে হবে বলেও জানান। ওই সংগঠনের সম্পাদক বিন্দেশ্বর বর্মণ এর প্রতিকার না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দেন। যে প্রায় ১৬ হাজার বাসিন্দা ভারতের নাগরিকত্ব পান তাঁদের জমির অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি সরকারের কাছেও ছিল চিন্তার।
অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর জমি সংক্রান্ত ক্ষোভের স্থায়ী নিরসন হয়। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি তারিখে প্রশাসনের তরফে সাবেক ৫১ টি ছিটমহলের ১৩,৫৬০ জন বাসিন্দাদের হাতে মোট ৭১১০ একর জমির খসড়া খতিয়ান তুলে দেওয়া হয়। ওই দিনে প্রথমে তুফানগঞ্জে; তারপর দিনহাটার শালমারা, নয়ারহাট ও বাত্রিগাছে; মেখলীগঞ্জ, শীতলকুচি প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প করে ওই খতিয়ানের কাগজ তুলে দেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। এর ফলে জমির ক্রয়বিক্রয়, সরকারি আবাস যোজনা, ব্যাঙ্ক লোন প্রভৃতি প্রাপ্তির যে বাধা এতদিন ছিল, তা দূর হয়। বিনিময়ের পর সাবেক ছিটমহলবাসীদের হাতে জমির কাগজ তুলে দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছিল। ফলে স্বল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকা অধিকাংশ জমির বণ্টন প্রায় সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ সরকার জমির এই খতিয়ান প্রদান করে ছিটমহলবাসীদের এক দীর্ঘ সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু দ্রুত গতিতে কাজ করতে গিয়ে ছন্দপতন ঘটে। ৩ জানুয়ারি তারিখে খসড়া খতিয়ান তুলে দেওয়া হলেও, তা ভুলে ভরা বলে সাবেক ছিটমহলবাসীদের একাংশ অভিযোগ করেন। নামের ভুল ছাড়াও জমির দাগ নম্বর ও পরিমাণ নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ৫ জানুয়ারি তারিখে নলগ্রাম, ফলনাপুর, জোংরার বাসিন্দারা ‘নলগ্রাম কনক আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এই সভায় রেজয়ান করিম, গৌতম বর্মণ প্রমুখদের নেতৃত্বে ‘সাবেক ছিটমহল ভূমি আন্দোলন কমিটি’ গঠিত হয়। সংগঠনটি নতুন ভাবে জমি জরিপ করে নির্ভুল ভাবে জমির খতিয়ান দেওয়ার দাবী জানায়। যদিও মাথাভাঙ্গা মহকুমা প্রশাসনের তরফে এই ভুল সংশোধনের জন্য ৯ নম্বর ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়। অর্থাৎ বিগত বছরগুলিতে জমির অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে একাধিক জটিলতা সৃষ্টি হলেও, বর্তমানে সেই ক্ষোভের নিরসন হয়েছে।
ভিনরাজ্যে অভিপ্রয়াণ
ছিটমহল বিনিময়ের সময়ে অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের জীবনে সুদিন ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও, জীবিকার কোন সুরাহা হয় নি। নলগ্রাম, ফলনাপুরের মত মশালডাঙ্গা, পোয়াতুরকুঠি, বাত্রিগাছ প্রায় সব সাবেক ছিটমহল থেকে বহু যুবক জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেন ভিনরাজ্যে। মুসলমান প্রধান বাত্রিগাছ থেকে ব্যাপক হারে অভিপ্রয়াণ ঘটে। এই গ্রামের দুই বুথ থেকে প্রায় আশি শতাংশ বাড়ির যুবক মূলত কেরল, হরিয়ানা, দিল্লী প্রভৃতি রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। আবার অনেকে দিল্লীর ইঁটভাটায় কাজ করতে যান। ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার ধারা শুধু সাবেক ছিটমহলগুলোতেই ছিল না, ক্যাম্পগুলোতেও ব্যাপক হারে দেখা যায়। যেমন দিনহাটার অস্থায়ী শিবির থেকেও অনেকেই ঘরে তালা দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অন্য রাজ্যে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে দিল্লী, জয়পুর, বেঙ্গালুরুতে এই ক্যাম্প থেকে পাড়ি দেয়। এই শিবিরের বাসিন্দা হরেকৃষ্ণ বর্মণ, কৃষ্ণ অধিকারী, কাছুয়া বর্মণ অভিযোগ করেন এখানে তাঁদের জীবিকার কোনও উপায় নেই। চার- পাঁচ জন টোটো চালালেও, অধিকাংশই দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু দিনমজুরের কাজ পর্যাপ্ত না থাকায়, অনেকেই যেমন সপরিবারে পাড়ি দিয়েছেন, আবার অনেকেই পরিবারকে ক্যাম্পে রেখে জীবিকার সন্ধানে চলে গিয়েছেন। এই অভিপ্রয়াণ মোটেও সুখকর ছিল না। কারণ ভিন রাজ্যে নানা বিপদে পড়তে হয়েছে এই অসহায় যুবকদের। পোয়াতুরকুঠির রফিকুল নামে জনৈক এক যুবক পরিচিতির নথি জমা দিতে না পারায় তাঁকে নয়ডায় গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর সাথে আরও অনেকে গ্রেপ্তার হলেও, তাঁরা জামিন পেয়ে গেলেও সে পায়নি। রফিকুল জমির কোনো কাগজ দেখাতে না পারায় তাঁর নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এভাবে ভিন রাজ্যে সাবেক ছিটমহলের ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের দিনের পর দিন হেনস্তার শিকার হতে হয়। এই শ্রমিকদের দুর্দশার কোনও সুরাহাই হয়নি এবং ছিটমহল বিনিময়ের পরও তাঁদের সুদিন ফিরে আসেনি।
এনক্লেভ ক্যাম্প
বিনিময়ের প্রাক্কালে ভারতীয় প্রশাসন অনুমান করেছিল বাংলাদেশের অন্তর্গত ১১১ টি ছিটমহলের সকল বাসিন্দারা এদেশে চলে আসবেন। এজন্যে প্রশাসন সারা কুচবিহার জেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক ‘এনক্লেভ ক্যাম্প’ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু ৬ জুন তারিখ থেকে সপ্তাহকাল ব্যাপী ‘অপশন’ গ্রহণের ক্যাম্পে মাত্র ৯৮০ জন নাম নথিভুক্ত করেন। অতঃপর প্রশাসন জেলার মাত্র তিনটি স্থানে অর্থাৎ দিনহাটা, মেখলীগঞ্জ ও হলদিবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রথম থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিল ভারতীয় ছিটমহলবাসীরা। যে ক্যাম্পে তাঁরা এসে উঠবেন তা নিয়ে নানা গুজব তাঁদের কানে আসতে থাকে। তাই ৩৯ জনের একটি দল বাংলাদেশ সরকারের ট্রাভেল পাস নিয়ে চ্যাংরাবান্দা সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে এদেশে এসে ক্যাম্পের হালহকিকৎ সরোজমিনে দেখে যেতে চাইলে ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁদের আটকে দেন বুড়িমারি চেকপোস্টের আধিকারিকরা। ‘ট্রাভেল পাস’ বাবদ মাথাপিছু ৫৫০ টাকা দিতে হবে বলে জানান। এই নিয়ে সাময়িক অশান্তির সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা সীমান্ত পার করে কুচবিহারের ক্যাম্পগুলি দেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই পরিদর্শনকারী দল অভিযোগ করেন যে, অনেকে ভারতে আসতে চাইলেও হুমকির ভয়ে নাম নথিভুক্ত করতে পারছেন না।
ছিটমহল বিনিময় এক দীর্ঘ সমস্যার সমাধান করলেও অনেক পরিবারে ভাঙন ধরে। এ’দেশে স্থায়ীভাবে চলে আসা অনেকই ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে পড়েছিলেন। কারণ তাঁদের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে এ’দেশে চলে আসার সরকারী নির্দেশনামা জারি হয়। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ক্রেতার অভাবে তাঁদের বাড়ি, জমিজমা বিক্রি কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদেশে আসার ব্যাপারে যারা মনস্থির করেছিলেন, তাঁদের একটি প্রতিনিধি দল ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখে কুচবিহারে জেলাশাসকের সাথে দেখা করেন। কৃষ্ণকান্ত বর্মণ, মনমোহন বর্মণ প্রমুখরা তাঁদের এই সমস্যার কথা তুলে ধরেন। দাশিয়াড়ছড়া ছিটমহলের মোশারোফ হোসেন জানান, তাঁর ১০ বিঘা জমি বিক্রি করতে পারছেন না। ক্রেতা নেই। এই অবস্থায় জমিজমা ফেলে রেখে কীভাবে তারা এদেশে আসবে? এদিকে এদেশে আসার দিন ঘনিয়ে এলে অনেকেই জমি বিক্রি না করেই চলে আসেন। এসেও স্বস্তি নেই। ক্যাম্পের ছোট ছোট টিনের চালের ঘরগুলিতে পরিবারের সবাই মিলে গাদাগাদি করে থাকাটা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ না থাকায় ক্যাম্পবাসীদের গ্রীষ্মকালে ভোগান্তি যেমন চরমে ওঠে, তেমনই পড়ুয়াদের পঠন-পাঠনেও ব্যাঘাত ঘটে। বিনিময়ের এক বছর পরেও অবস্থা তথৈবচ।
ছিটমহল বিনিময়ের প্রথম বর্ষপূর্তিতে দিনহাটা, মেখলীগঞ্জের ক্যাম্পে ক্ষোভের নিরসন না হলেও, হলদিবাড়ি ক্যাম্পে এই ঐতিহাসিক দিনটি উদযাপিত হয় মহাসমারোহেই। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে এই ক্যাম্পগুলির দুই বছর পূর্ণ হলেও, ক্যাম্পবাসীদের সমস্যার সুরাহা হয়নি। অথচ দু’বছরের মধ্যে তাঁদের পুনর্বাসনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল। ক্যাম্পগুলির অব্যবস্থা নিয়ে প্রায়শই তাঁদের সরব হতে দেখা গেছে। মেখলীগঞ্জের ভোটবাড়ি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য যে স্থানে ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মিত হচ্ছিল, তা নিয়েও তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের অন্ত ছিল না। চ্যাংরাবান্দাতে ১৫২ নং পানিশালার পাণ্ডব বর্জিত স্থানে নবনির্মিত ফ্ল্যাট নিয়ে মেখলীগঞ্জ মহকুমা শাসকের কাছে ইতিপূর্বে একাধিকবার অসন্তোষ জানালেও কোনও সুরাহা হয়নি। অবশেষে তাঁরা অনশনে বসেছিলেন। সেই অনশনকারীদের ওপর নির্মম পুলিশি নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। পানিশালায় স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তোলার কাজ শুরু হলেও, সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব না দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন ক্যাম্পবাসীরা। পানিশালা স্থানটি এতটাই অনুন্নত যে, যোগাযোগের সুবিধার জন্যে ধরলা নদীর ওপর ব্রিজের দাবী জানান। কারণ এই ব্রিজ হলে তাঁরা পানিশালা থেকে সহজেই চাংরাবান্দা স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে যেতে পারবেন। নইলে তাঁদের বহু পথ ঘুরে চ্যাংরাবান্দায় যেতে হবে।
দু’বছর অতিক্রান্ত হলে স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনও সম্ভাবনা তো দেখা যায়ই নি, উপরন্তু দিনহাটা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন যে, তাঁদের রেশন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাম্পবাসীরা জানান, শুধু রেশন বন্ধই নয় ১০০ দিনের কাজ করেও তাঁরা টাকা পাননি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাঁদের শাকপাতা লবন দিয়ে ভাত জুটছে। আসলে ক্যাম্পবাসীদের দু’বছরের জন্যই রেশন বরাদ্দ করা হয়েছিল। দু’বছর অতিক্রান্ত হলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তিনটি ক্যাম্পের রেশন বন্ধ হয়ে যায়। জীবিকাহীন এই ক্যাম্পবাসীদের রেশন বন্ধ হলে তাঁদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে যায়। কুচবিহারের জেলা প্রশাসন পুনরায় রেশন চালুর জন্যে তৎপর হলেও, এই বিলম্ব ক্যাম্পবাসীদের কাছে দুঃসহ হয়ে ওঠে।
ইতিমধ্যে ২৯মে তারিখে ‘দিনহাটা কৃষিমেলা সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব কে.বি.সিং এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে এলে ক্যাম্পবাসীরা তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দেন। এমনিতেই রেশন নিয়ে ক্ষোভ তো ছিলই, উপরন্তু ১০০ দিনের কাজ ঠিকমত না পাওয়া, সময়মত পারিশ্রমিক না পাওয়া, বাংলাদেশে থাকা জমিজমা বিক্রি করার অসুবিধা প্রভৃতি একাধিক বিষয়ে তাঁরা ওই প্রতিনিধি দলকে অভিযোগের কথা জানান। একই চিত্র মেখলীগঞ্জ ব্লকের ভোটবাড়ির ক্যাম্পেও। এখানে ঘরের তুলনায় আশ্রিত পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হওয়ায় অনেককেই বাইরে বারান্দায় থাকতে হয়। এছাড়াও শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা সহ পানীয় জল, শৌচাগারের অভাব; রেশন ও বিদ্যুতের সমস্যা তো ছিলই, তবে কর্মসংস্থানের অভাবে তাঁরা তীব্র আর্থিক সংকটে ভুগতে শুরু করেন। প্রশাসনের তরফে ক্যাম্পে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন, গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় উপকরণ তুলে দিলেও ক্যাম্পবাসীদের ক্ষোভের নিরসন হয়নি। দিনহাটা ক্যাম্পে রেশন নিয়ে যে অভিযোগ ছিল, তার কোনও সুরাহা হয় নি। অপর্যাপ্ত রেশন নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে অনেক ক্যাম্পবাসী ফিরে যাওয়ার কথাও জানতে দ্বিধা করেননি।
না-নাগরিক
বিনিময়ের পর গভীর সমস্যায় পড়েন ছিটমহলবাসীদের একাংশ। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে দু’দেশের ছিটমহলগুলিতে জনগণনা করলে বহু মানুষের নাম তালিকা ভুক্ত হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। ছিটমহলবাসীরা এর জন্যে প্রশাসনকে দায়ী করলেও, গণনা কালে অনেকে উপস্থিত না থাকায় তাঁদের নাম ওঠেনি। মেখলীগঞ্জ শহর সংলগ্ন ‘ধবলসূতী মৃগীপুর’ ছিটমহলের অনেকেই জানিয়েছেন সেকথা। কারণ গণনা কালে অনেক শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে ছিলেন। অর্থাৎ ছিটমহল বিনিময়ে বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের ছিটমহলগুলি থেকে ‘লেবার মাইগ্রেশন’ হয়েছে। ভিন রাজ্যে যাওয়া এই হিন্দু ও মুসলমান শ্রমিক বা লেবারদের একটা বড় অংশই ২০১১ সালে ছিটমহলের প্রথম জনগণনা থেকে বাদ চলে যান। শুধু এদেশেই নয়, বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলিতেও অনুপস্থিতির কারণে এবং আবার অনেকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ থাকায় নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। এই যৌথ জনগণনা নিয়ে ছিটমহলবাসীদের মধ্যে অভিযোগের অন্ত ছিল না। তাঁরা এই ভুলে ভরা জনগণনা সংশোধনের দাবীতে প্রায়শই সোচ্চার হয়েছিলেন।
প্রাথমিকভাবে এই জনগণনা নিয়ে কোনও সমস্যা তৈরি না হলেও, পরবর্তীতে বিপুল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ২০১৫ সালের ৬ই জুন থেকে সপ্তাহকাল ব্যাপী যে জনগণনা ও ‘অপশন’ গ্রহণের কাজ শুরু হয়, তখন ২০১১ সালের প্রতিবেদনটিকেই ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। ওই তালিকা বহির্ভূতদের নাম অন্তর্ভুক্ত তাতে হয় নি। এই সংখ্যা নেহাতই কম ছিল না। অভিযোগ উঠেছিল, প্রায় ৩০ হাজার ছিটমহলবাসীর নাম নথিভুক্ত হয় নি। এমন কী যাদের নাম নথিভুক্ত হয় নি, তাদের নতুন করে আর অন্তর্ভুক্ত করা হবে না বলেও দু’ দেশের প্রশাসনের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়। দু’দেশের সরকারের কাছে এই নথিভুক্ত না হওয়া ছিটমহলবাসীদের কোন অস্তিত্ব না থাকায় তাঁরা কার্যত না-নাগরিকে পরিণত হন। বিনিময়য়ের সময়ে বিশেষত ভারতীয় ছিটমহলগুলি থেকে অনেকেই যেমন এদেশে আসার ‘অপশন’ দিয়েছিল, তেমনই অনেকেই ইচ্ছুক থাকলেও, তালিকায় নাম না থাকার কারণে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এমনও হয়েছে একই পরিবারের সবাই ‘অপশন’ দিলেও, বাড়ির কর্তাই এদেশে আসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমন বাঁশকাটা ছিটমহলের বলরাম বর্মণ ও তাঁর পরিবার এই সমস্যায় পড়েছেন। বলরাম বর্মণ নিজে ‘ভারতীয় ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিলে’র সভাপতি হলেও, ২০১১ সালে জনগণনায় পরিবারের নাম উঠলেও তাঁর নাম নথিভুক্ত হয়নি। ফলে ২০১৫ সালে ইচ্ছে থাকলেও, ‘অপশন’ দিতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী স্বপ্না বর্মণ পরিবার সহ এদেশে চলে এলেও, সেই সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর মত অনেকেই আছেন, যাঁদের পরিবার এদেশে চলে এলেও, তাঁরা এখনও এদেশের ‘না-নাগরিক’।
শুধু সাবেক ভারতীয় ছিটমহলেই নয়, বাংলাদেশের ছিটমহলের অনেকেই এই সমস্যায় পড়েছেন। যেমন ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মশালডাঙ্গার ১০টি পরিবারের ৪৭ জন কোনওরূপ নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র পায় নি। কারণ ২০১১ সালের যৌথ জনগণনায় তাঁদের নাম ছিল না। ফলে তাঁরা সমস্ত রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরেও এরশাদ আলি, ইমামআলিদের মত মশালডাঙ্গার এই পরিচিতিহীন না-নাগরিকদের মত অনেকেরই নরক যন্ত্রণা ছিল এক অন্য অধ্যায়।
ছিটমহলের বিনিময় হলেও, দীর্ঘ প্রায় সাত দশকের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া দ্রুত সম্ভব নয়। সরকার উন্নয়নের জন্যে সচেষ্ট হলেও, তা তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হয়ত করেনি। সেই অমোচনীয় ক্ষত থেকে ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ের সুফল থেকে সবাই বঞ্চিত হয়েছেন এমনটাও নয়। বিগত দশকে তাঁরা ও তাঁদের পূর্বসূরিরা তথাকথিত ‘ভাগ্যের সাথে চুক্তি’র ফলশ্রুতিতে যে বিকলাঙ্গ জীবন যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি আর কখনোই চান না।
তথ্যসূত্রঃ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’, ‘উত্তরের সারাদিন’, ‘এই সময়’, ‘বর্তমান’পত্রিকার নির্বাচিত সংখ্যা। সাবেক ছিটমহলবাসীদের সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team