আবহাওয়ার চূড়ান্ত অনিয়ম ও প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত যথেচ্ছ ব্যবহার সরাসরি ক্ষতিসাধন করছে প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদনে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় বাণিজ্য এবং তার উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি। শিল্পহীন উত্তরবঙ্গে মূল কৃষিজ সম্পদ যেগুলি স্থানীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ সেগুলির ভবিষ্যৎ এভাবেই অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢেকে থাকছে বছরের পর বছর। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী মালদহ জেলার আম উৎপাদন নিয়েও একথাই বলতে হয়। আম যেমন এই জেলার অর্থনীতির অন্যতম অবলম্বন, অন্যদিকে জেলার মানুষের সুখদুঃখ সংস্কার-সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকও। এই জেলার বহুকালের প্রচলিত ধাঁধা, প্রবাদ, পুরাকাহিনি, গান, উৎসব, পূজা-পার্বণ, এমনকি মালদহের বিখ্যাত গম্ভীরাতেও আমের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মালদহের আমসত্ত্ব, আচার, জ্যাম, জুস, আম-সন্দেশ, আম-দই বিশ্বময় খাদ্যরসিকদের আমোদিত করে এসেছে বহুযুগ ধরে।
আনুমানিক ১৮৯০ সাল থেকে মালদহে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ শুরু হয়। এর শুভ সূচনা ঘটে ইংলিশবাজার থানার অন্তর্ভুক্ত কোতোয়ালি অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গ তথা কলকাতা ছিল এই বাণিজ্যের প্রধান বাজার। ধীরে ধীরে তা দেশের নানান প্রান্তে এমনকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিদেশে। মালদহের মতো ব্যবসা-ভিত্তিক আমবাগান পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও দেখা যায় না। বর্তমানে মালদহ জেলার ইংলিশবাজার, রতুয়া, কালিয়াচক, মানিকচক, হরিশ্চন্দ্রপুর, গাজোল, বামনগোলা, আইহোসহ মোট ৩১৫০০ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়। প্রতিবছরেই গড়ে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মেট্রিক টন আমের ফলন হয়ে থাকে, এমনকি কখনও চার লক্ষ মেট্রিক টনের কাছেও পৌঁছে যায়।
এই বিপুল আমের সম্ভারে যে কেবল দুই-এক প্রকারের আম-ই সামিল তা নয়, দেড়শ থেকে দুশ প্রকারের আম উৎপাদন হয় এই জেলায়। যদিও বর্তমানে নগরায়নের প্রসার এবং মানুষের চাহিদার উপর নির্ভর করে এই সংখ্যা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। তবুও আজকের বাজারে অতি সহজেই মেলে বৈশাখী, গুটি, গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা, আলতাপেটি, মতিচুর, দিলখোশ, জহুরী, মোহনভোগ, মোহনবাঁশি, বৃন্দাবনী, ভারতী, বিষ্ণুভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, রুইমন্ডা, রাখালভোগ, কিষানভোগ, ডালভাঙ্গা, চৈতা, জেঠুয়া, নবাবখাস, দুধকমল, আশ্বিনা, সিন্দুরিয়া, লতিকা–র মতো অতি সুস্বাদু আম, যার কোনো কোনোটি আন্তর্জাতিক বাজারেও বিখ্যাত।
মালদহে আমের ব্যবসার প্রস্তুতি শুরু হয় মুকুল আসার বহু আগেই। দালাল, বারিওলদের উপদ্রবে বাগান মালিকের সঙ্গে বাগানের সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটে মোটা টাকার বিনিময়ে। আমের বোল ফোটার ছয়-সাত মাস আগেই বেশিরভাগ গাছ বিক্রি হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, ভাগলপুর, নদীয়া, ধূলিয়ান এমন নানান জায়গা থেকে দলে দলে বাগান-ক্রেতারা উপস্থিত হয়।
আম গাছে মুকুল আসার একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে-- আমপাতার রং দেখেই তা বোঝা যায়। নতুন পাতায় আম হয় না। এই ফলের প্রাকৃতিক নিয়ম হল-- একবছর আম দেয় যে গাছ, আগামীবছর সেইগাছে খুব কম আম ধরে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সাধারণত মুকুল আসে, নতুন পাতা ধরে ফাল্গুন মাস থেকে অর্থাৎ এবছর ফাল্গুনে কোনো গাছে নতুন পাতা ধরলে বুঝে নিতে হবে পরের বছর মাঘ-ফাল্গুনে সেই গাছে মুকুল আসবে। আমবাগানকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো বছর করুণ-বেদনাদায়ক চিত্রও প্রতিফলিত হয়। মুকুল বের হওয়ার মুখে প্রবল শীত, মুকুল বেরোনোর পর কুয়াশা, বৃষ্টি, ফল ধরার পর প্রবল ঝড়-শিলাবৃষ্টি, এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পোকার বা বাদুড়ের উপদ্রব আমের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর যা ব্যবসায়ীদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু এখন বাগানের প্রতি যত্ন নিতে সরকারি তরফেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাগানের প্রতিটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে নজর রাখতে তৈরি হয়েছে বাগানের মধ্যেই অফিস, যন্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা, পাম্পঘর। এরই পাশাপাশি স্থান নির্বাচন, চারা নির্বাচন, সঠিক দূরত্ব বজায় রাখা, চারা গাছের চারপাশে বেড়ার ব্যবস্থা করা— ইত্যাদি বিষয়েও বাগান নির্মাতাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাষের ক্ষেত্রে প্রথমেই জমিকে চাষযোগ্য ঊর্বর করে নেওয়া হয়। এরপর গ্রীষ্মকালে জমিতে নির্দিষ্ট মাপের গর্ত খুঁড়ে রেখে মাটিকে ভালো করে ১৫-২০ দিন রোদ খাওয়ানো হয়। এতে মাটির রোগ ও মাটিতে থাকা পোকার জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। এরপর সোজা কাণ্ডের কলমের চারা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে লাগানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বর্গাকার, আয়তাকার, ষটকৌণিক নানা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে জাত নির্বাচন করে গাছ লাগানো হলে সারা মরশুম ফল পাওয়ার আশা থাকে।
মালদহের আম ব্যবসায়ে এক ভিন্নতর মাত্রা এনেছে আমবাজার, আমউৎসব, আম প্রদর্শনী মেলা। এইরকম প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের অনুপ্রেরণায় আমজাত দ্রব্য এবং আমের গুণগত মান নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে সতর্ক হওয়া যায়। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছরের ফলাফলে দাঁড়িয়েছে স্বাদের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে — হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি। আবার রূপের দিক থেকে দেখলে আম্রপালি, সিদুরিয়া, খির্সাপাতি, ভারতী এবং ব্যবসায় বেশি মুনাফা করে-- হিমসাগর, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, আম্রপালি, ফজলি। এই প্রদর্শনীতে মঞ্জিরা, নিলাম, বাতাসা, দশেরি, নীলগোয়ার মতো বহুবিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির আমও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কিন্তু বিগত দুই বছরে অতিমারির ভয়ঙ্কর থাবা এবং এই বছরের খামখেয়ালি আবহাওয়ায় রীতিমতো নাস্তানাবুদ মালদহের আম উৎপাদকেরা। পরপর কয়েক বছরে জেলাজুড়ে আমের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে অর্থনীতির ভিত প্রায় নড়বড়ে হওয়ার উপক্রম। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে এবছর বিদেশে আম রপ্তানির প্রচেষ্টাতেও আকস্মিকভাবেই জল ঢেলে দিয়েছে এবারের ঘনঘন কালবৈশাখীর তাণ্ডব। এখন বাগানজুড়ে কেবলমাত্র মাটিতে পড়ে রয়েছে অপক্ক কাঁচা আম। এই সুযোগে মালদহের স্থানীয় বাজারে চড়া দামে বিকোচ্ছে দক্ষিণ ভারত চেন্নাইয়ের গোলাপখাস ও বেগুনফালি। গোলাপখাস কেজিতে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, বেগুনফালি কেজিতে ১৭০ টাকায় বিক্রি হলেও এদের স্বাদে গন্ধে মোটেও তুষ্ট নন স্থানীয় বাসিন্দারা। মালদহের মোট আমবাগানের প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি এবছর ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৩১ হাজার ৫০০ হেক্টর বাগানে ৩৭ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন আমের ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে। এছাড়াও এবছরে শুলি পোকার আক্রমণ ও ইটভাটার সালফার-ডাই-অক্সাইডে আমের ব্ল্যাকস্পট আমের গুণগত মান খারাপ করে ফেলেছে। যার ফলে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তাল মেলাতে এবছর আমের দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার চিন্তায় আজ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই নাজেহাল।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team