 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 সব্যসাচী দত্ত
                                            
                                                
                                                সব্যসাচী দত্ত
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        সামাজিক বিভিন্ন আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ‘সংস্কার’। কিছু ভালো কিছু মন্দ। সংস্কার
থেকে গড়ে ওঠে বিশ্বাস। আবার দেবদেবীকে ঘিরে জীবন সংস্কৃতির একটি অন্যরূপ প্রকাশিত হয়। তাই প্রাচীন কাল থেকেই ভয়ে ভক্তিতে অথবা মানসিক শান্তি পেতে দেবতার আশ্রয় খোঁজা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। রচিত হয়েছে ‘মঙ্গলকাব্য’। মঙ্গলকাব্য রচনার সঙ্গে কেবল ভয়-ভক্তি-মানসিক শান্তি জড়িয়ে আছে তা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনের অন্য একটি অংশ। যেখানে আছে কল্পনার উন্মেষ, সৃষ্টির অনাবিল আনন্দ। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ইত্যাদি কাব্য দেবীর মাহাত্ম প্রচারে রচিত হয়েছে। আর আছে ‘পাঁচালী’। এই সব ধরণের রচনায় আছে কাহিনি। যা আমাদের মনকে আকর্ষণ করে। কথক ঠাকুর যখন তাঁর অনবদ্য বাচন ভঙ্গিতে এই কাহিনিকাব্যগুলি পরিবেশন করেন তখন আমরা মোহিত হয়ে যাই। মা-ঠাকুরমা বাড়িতে পুজো উপলক্ষে পাঁচালি পড়েন, সুর ক’রে। তা শোনার জন্য তাঁদের ঘিরে বসে পড়েন অনেকেই, ভক্তিভরে। উপস্থিত প্রত্যেকের মধ্যেই ভাবের খেলার যোগসূত্র তৈরি হয়। লক্ষ্মী, নারায়ণ, ত্রিনাথ সহ অনেকেই আমাদের জীবনে অবলীলায় প্রবেশ করেছেন। কোচ, রাজবংশী সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে ‘সাইটল’, ‘কাতিপূজা’, ‘চন্ডীনাচ’, ‘বিষহরি’ ইত্যাদি। কোচবিহারের গ্রামগুলিতে এই লোক দেবদেবীদের প্রবল প্রভাব।
সাইটল সন্তান ধারণের দেবী। বিশ্বাস, বংশপ্রদীপের সলতে জ্বলে তাঁর দয়াতেই। তাই এই দেবীর গুরুত্ব সমাজ জীবনের অত্যন্ত গভীরে। সাইটল গীতাভিনয় রূপে প্রচলিত। কখনও বা এর কিছু আঙ্গিকাভিনয় প্রত্যক্ষ করা যায় গীতের সঙ্গে। তবে সে প্রচলন খুবই সামান্য। কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার পুটিমারি অঞ্চলে সাইটল ও কাতিপূজার গান বহুল পরিচিত। এর গান, নাচ অত্যন্ত সুন্দর ও শিল্প সুষমামন্ডিত। সাইটলের কাহিনি এইরূপ--
এক ব্যক্তির সাত পুত্র। বিবাহযোগ্য হলে তাঁদের বিয়ে দিলেন তিনি। পুত্রবধূরা সুন্দরী, ছেলেরা কর্মঠ। সুখে ভরে উঠলো সংসার। সময় মত ছয় পুত্রবধূর গর্ভসঞ্চার হ’ল, সন্তান জন্মালো। কিন্তু ছোট বউ নীলার গর্ভে সন্তানচিহ্ন নেই। বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়। নীলার দুঃখ বেড়ে চলে। সইতে হয় গঞ্জনা, বাঁকা কথা। সে বন্ধ্যা, তাই সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে যায়। মানসিক যন্ত্রনা সইতে সইতে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও পিছপা হয় না ।
একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে নীলা। নিজের মৃত্যু কামনায় হাঁটতে থাকে আনমনে। নিজের অজান্তেই গভীর এক জঙ্গলে প্রবেশ করে। ক্রমশ গভীর থেকে আরও গভীরে চলতে থাকে সে। একসময় পৌঁছে যায় ঘন প্রায়-অন্ধকার অরণ্য গভীরে। সেখানে বাস করে এক বাঘ দম্পতি। নীলা তাদের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করে তাকে খেয়ে ফেলার জন্য। নিজের দুঃখের কাহিনি বর্ণনা করে সে। বাঘ নীলাকে খেতে উদ্যত হয়। হা-হা ক’রে ওঠে বাঘিনি। বাধা দেয়। সে বলে, আরে এতো বন্ধ্যা। একে খেলে আমাদের সন্তান-সন্ততি হবে না। না-না আমরা একে খেতে পারবো না।
কথাগুলি নীলার মনে তীরের মত বেঁধে। বাঘিনীর কথাগুলো অনুরণন তোলে গাছে-গাছে আকাশে বাতাসে। নিজের প্রতি ঘৃণা আরও প্রবল হয় তার। আবার হাঁটতে শুরু করে সে। এই ঘটনার সময় সে অরণ্য পেরুচ্ছিলেন শিব ও পার্বতী। আকাশ পথে যেতে যেতে নীলার কান্না শুনে পার্বতীর মন ভারাক্রান্ত হয়। শিবকে বললেন চলতো দেখি কে কাঁদছে! মহাদেব তখন নেশায় কাতর। কোনও কিছুতেই মন নেই তাঁর। পার্বতী একাই নেমে পড়লেন। এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে এসে উপস্থিত হলেন নীলার সামনে। জানতে চাইলেন তার কান্নার কারণ। নীলা নিজের দুঃখের কাহিনি বৃদ্ধাকে শোনায়।
পার্বতী অভয় দিলেন। বললেন তুমি এগিয়ে চল। কিছুদূর গেলে পাবে এক সরোবর। সেখানে প্রতিদিন দেবী সাইটল জলবিহারে আসেন। তাঁকে খুলে বলবে সব। তিনিই তোমার দুঃখ দূর করবেন। আশায় বুক বেঁধে নীলা এগিয়ে চলল সরোবরের উদ্দেশে। সরোবরে পৌঁছে নীলা পেল দেবী সাইটলকে। তাঁকে সব কথা খুলে বলল সে। দেবী বললেন কোনও চিন্তা কোরো না। বাড়ি ফিরে যাও। গ্রামে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা কর। পুজো কর নিয়মিত। তুমি মা হবে। নীলা খুশী হয়ে গাঁয়ে ফিরলো। প্রতিষ্ঠা করলো সাইটল দেবীর। ভক্তিভরে পুজো করলো নিয়ম ক’রে। কিছুদিন পর সত্যি গর্ভবতী হ’ল নীলা। নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হ’ল সে। খুশীতে, আনন্দে ভরে উঠলো তার জীবন।
সাইটল মূলত মেয়েদের ব্রতপালনের উৎসব। মহিলাদের আসরে নৃত্য সহযোগে এই গান করা হয়। শুধু অবসর বিনোদনের জন্য সাইটলের উপস্থাপন হয় না। ব্রত পালনের অনুসঙ্গ এই গান ও নাচ। গান ও নাচ থাকলেও এতে অভিনয়ের প্রভাব আছে। অনেক বিশেষজ্ঞই সাইটলকে লোকনাট্যের মর্যাদা দিতে নারাজ। কারণ এর গীতিধর্মিতা। সাইটল পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় গৃহস্থের মানসিক অনুসারে। বিবাহিত মহিলারাই এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। সাইটলের গানে খুব বেশি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় না। সাইটল গানের সঙ্গে ঢাক বাজে কেবল। ঢাকের তালে তালে মেয়েরা সাইটল ব্রত কথার প্রচলিত গান গান এবং নাচ করেন। তবে ইদানিংকালে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যখন সাইটল গানের আসর বসে তখন দোতারা, সারিঞ্জা, বাঁশী, ঢোল, আকরাই ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
সাইটল ও কাতিপূজার গানের বিখ্যাত শিল্পী ফুলতি গীদাল। মূল নাম ফুলতি বর্মণ। কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার পুটিমারি গ্রামে তাঁর বাড়ি। কিছুদিন হ’ল তিনি পরলোক গমন করেছেন। এক গ্রীষ্মের দুপুরে পৌঁছেছিলাম তাঁর কাছে। তখনও তিনি বেঁচে আছেন। বয়স বিরানব্বই (২০০৬ সালে) বা তারও বেশি। তিনি বেঁচেছিলেন একশ বছরেরও বেশি। গ্রীষ্মের এক বিকেলে পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়ি। সঙ্গী আর এক সংস্কৃতিপ্রেমী ও শিল্পী স্থানীয় মানুষ অমূল্য দেবনাথ। পুটিমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গ্রাম শিমুলতলা বসগীরের ধাম। দু’কিলোমিটার আঁকাবাঁকা মেঠো রাস্তা। দু’পাশে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। দু’একটি ছোট দোকান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি আর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইতিউতি বসেছে তাসের আড্ডা। মাঠে বাতাবিলেবুর ফুটবল পিটছে ছেলেরা। মেয়েরা কেউ খেলছে ‘দাড়িয়া বান্ধা’, ‘চু-কিতকিত’ অথবা শুধুই বসে গল্প করছে। ক্ষণে ক্ষণে হাসির ফোয়ারা উঠছে। আমরা চলেছি দুইজনা। ফুলতি বর্মনের পরিচিতি ‘ফুলতি গীদালী’ নামে। এই নামটি গ্রামের সকলে উচ্চারণ করেন সম্মানের সঙ্গে। অলিগলি পাকস্থলির ভেতর দিয়ে পৌঁছে গেলাম ফুলতি গীদালীর বাড়ি।
বাড়িটি তাঁর পাখির নীড়ের মত। ছোট এক চিলতে উঠোনে আম, জাম, কাঁঠাল, কদমের ঘেরাটোপে দু’খানা একচালা ঘর দরমার বেড়ার । সেখানেই থাকেন একসময়ের সুন্দরী, চমৎকার গাইয়ে, নৃত্যপটিয়সী ফুলতি দেবী। সঙ্গে তাঁর বিধবা কন্যা। কাঠের পিঁড়ি পেতে বসতে দিলেন। ছোট্ট কাঁসার রেকাবীতে এনে রাখলেন ‘গুয়া-পান’। তিনিও এসে বসলেন আমাদের সঙ্গে।
এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম হয়েছিল ফুলতি বর্মনের। দারিদ্র আর অশিক্ষা এসে হাত ধরেছিল তাঁর। অত্যন্ত কষ্টের জীবনে ফুলতি দেবীর পিতা গান গাইতেন আপন খেয়ালে। গলাটাও ছিল ভারী মিঠে ও সুরেলা। সেই সুর ছেয়ে ফেলে ছোট্ট মেয়েটির হৃদয়। অক্ষর চেনেন না, স্কুলে যাওয়া বা লেখাপড়ার সুযোগই হয়নি কখনও। প্রখর স্মৃতিশক্তি। একবার শুনেই নিখুঁত সুরে পুরো গান শিখে নিতে পারতেন ফুলতি। গান অথবা নাচের কোনও প্রথাগত শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ ছিল না বলা বাহুল্য। তিনি যখন ছোট ছিলেন সে সময় তা সম্ভবও ছিল না। তবে দেখতেন খুব। দেখে দেখেই নিজে অনুশীলন করতেন। অসম্ভব জেদ ও প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করবার প্রবল ক্ষমতা তাঁকে শিল্পী ক’রে তুলেছে। সেই শিল্পীর নিবেদনে আপ্লুত হয়েছেন শিক্ষিত, নিরক্ষর, বিদগ্ধ জন, সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর শিল্পে মুগ্ধ হয়েছেন। সম্মানিত করেছেন। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, সম্বর্ধনা। আর মানুষের বুকভরা ভালোবাসা। শিল্পের আলো ছড়িয়েছেন এই মানুষটি, কিন্তু নিজের জীবনের আঁধার ঘোচেনি। চরম দারিদ্র যায়নি জীবন থেকে শেষদিন পর্যন্ত। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্য লড়াই করতে হয়েছে আজীবন। অথচ তাঁর প্রাণশক্তি, জীবনের প্রতি ভালোবাসা, শিল্পের সঙ্গে আত্মীয়তা আমাদের আশ্চর্য করে। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। শরীর অশক্ত হয়েছে বয়সের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু নব্বই পেরিয়েও নির্ভুল সুরে গাইতে পারেন গান। পা মেলান নাচের সঙ্গেও।
একসময় সমাজ তাঁকে ব্রাত্য করেছিল। গান গাওয়া, নাচ করাই ছিল তাঁর অপরাধ। গঞ্জনা সইতে হয়েছে, অপমানিত হতে হয়েছে, স্বামীর পৌরুষের অত্যাচার সহ্য করেছেন, মার খেতে হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির চাপে দীর্ঘদিন শিল্পচর্চা বন্ধ রাখতে হয়েছে। চোখের জলে চলার পথ হয়েছে পিচ্ছিল। খুব সাবধানে পদক্ষেপ করেছেন। কোনও শর্তেই পদস্খলন হয়নি। শিল্পের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে দেননি। জীবনে অনেক মূল্য চুকিয়েছেন সে জন্য। কিন্তু হেরে যাননি। শিল্পে ফিরেছেন। শিল্প-চর্চায় মুগ্ধ করেছেন অসংখ্য দর্শক-শ্রোতাকে। কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন।
ইতালি, সুইডেন সরকারের আনুকূল্যে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। অনেক বার ডাক এসেছে বিদেশের। কেন গেলেন না? মুহূর্তে ভয় তাঁর মুখে, “হ… অইঠে তো উড়োযাহাযোৎ যাবার নাগে। বাপ্রে… মুই না যাও। স্যালা পড়ি গেলে…” আবার হেসে ফেলেন। সরল-সুন্দর সে হাসি। উজ্জ্বল দুটি চোখ, মুখের অসংখ্য বলিরেখায় গভীর প্রত্যয় ও অভিজ্ঞতা। জীবন্ত এক ইতিহাস তিনি নিজেই। খেদের কথা তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে হারিয়ে গেল সাইটল ও কাতিপূজার অনেক অজানা কাহিনি।
(ক্রমশ)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
