এক্কেবারে রোজের ভোজ যাকে বলে, সপ্তাহের সাতদিন- বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিন। দিনের ব্যস্ত বাঘাযতীন পার্ক ঘেঁষা মেইন রোডে কাছারি বাবুদের দাপাদাপি, টোটোতে টোটোতে ঠোকাঠুকি জমজমাট, সমস্ত এলাকায় এক ফুরসৎহীন ব্যস্ততা। সূর্য ডোবার সাথে সাথে সব ম্লান হয়ে আসে। সন্ধ্যায় যেন এক অন্য রূপ বাঘাযতীন পার্কের; পার্ক পড়ে থাকে পার্কের মত, মাঠ জুড়ে মর্নিং ওয়াকের গমগমে সাউন্ড পোস্ট, সামনের রবীন্দ্র মঞ্চ সব যেন খাঁ খাঁ করতে থাকে। তখন মেতে ওঠে পার্কের উত্তর পশ্চিমের দুই রাস্তা। রীতিমত হাজার স্বাদের মজা নিতে শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্ক অঞ্চল যেন রোজের সন্ধ্যা পরব সাজিয়ে বসে। স্থানীয় ছেলে ছোকরাদের কাছে যার সংক্ষিপ্ত ডাক নাম ‘বি-জে-পি’। আলো ঝলমলে পরিবেশে তাওয়া খুন্তির হেঁসেল সঙ্গতে এ এক অন্য রকম ‘এক টুকরো শিলিগুড়ি’। বর্তমান মেয়র মশাই পর্যন্ত এই সেদিন মজায় মজায় আফসোস করে গেলেন-“এত সুন্দর করে সাজালাম গোছালাম এই বাঘাযতীন পার্ক চত্বরকে, আর সবার আদরে তা কিনা হয়ে গেল বি-জে-পি!”
মেয়র মশাইয়েরই বা দোষ কী? নিজের পাড়া, নিজের ওয়ার্ড বলে কথা; তাঁর এই বাঘাযতীন পার্কের নষ্টালজিয়া আর দশজন শিলিগুড়িবাসীর চেয়ে তো কম নয়। তাই এই পার্কের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট ভাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী হয়েই উদ্যোগি হয়েছিলেন পার্ক চত্বর সাজাতে। সুন্দর লোহার গ্রিল ঘেরা মাঠ, মাঠজুড়ে সাউন্ড সিস্টেম, সমস্ত চৌহদ্দি জুড়ে দেবদারু, অমলতাস, ছাতিমের সবুজায়নের সাথে রঙ্গিন পেভার টাইলস ফুটপাথ, ঘন ঘন বসার প্রিকাস্ট কনক্রিট বেঞ্চ। এক পাশে ভাষা শহীদ বেদি। সব মিলিয়ে এক সাজানো সংসার যেন। এর পর এই পক্ষপাত যদি একজন রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নাম নিয়ে (বিজেপি) সবার কাছে ধরাও দেয় তাতে কিছুটা অভিমানে তো কোনও দোষ থাকে না। তবে মেয়র মশাইয়ের এই কথা নিছক মজা বৈ আর কিছু নয় অবশ্যই।
এই সাজানো সংসারের হাত ধরেই আস্তে আস্তে জায়গা করে নিয়েছে একটা একটা করে ঠেলা গাড়ি। মোমো, চাউমিন, বিরিয়ানি, শিক কাবাব, ফুচকা, ফিস ফিঙ্গারের মত খাবারের বৈচিত্রে তৈরি হয়েছে আজকের এই ‘সান্ধ্য ফুডকোর্ট’। গুটি গুটি তাতে ভীড় জমিয়েছে ফালুদা, মোজিটোর দল।এই ‘ফুড কোর্ট’ কিন্তু শৃঙ্খলা ভাঙ্গে না। কায়েম করে না আর দশটা ফুড কোর্টের মত জমির মালিকানা, চেপে বসে না প্রশাসনের মাথার উপর। রাস্তার প্রয়োজনে, প্রশাসনের প্রয়োজনে তারা গাড়ি নিয়ে সরে যায়, আবার মানুষের প্রয়োজনে তাদের জীবিকার তাগিদে বিকেল থেকে প্রস্তুতি চলতে থাকে দোকানের। চলে রাত প্রায় সাড়ে দশটা এগারোটা পর্যন্ত। আধুনিকতার ছোয়ায় ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থাও পাওয়া যায় প্রায় সব দোকানেই। সন্ধ্যা থেকে যত রাত বাড়ে, বাড়তে থাকে ভীড় আর এই ভীড়ের আড়ালে একটু চোখ রাখলে হয়তো কখনও ঈষান কোণের আড়াল ঘেঁষে কাটলেট হাতে খুঁজে পাওয়া যায় রিটায়ার্ড সেই দুঁদে আমলা বাবুটিকেও; যাঁর ব্লাড সুগার, কোলস্টরেল কিংবা ইউরিক অ্যাসিডের আধিক্যে গিন্নির কড়া শাস্নে বাড়িতে বাঁধা ডায়েট সাদা মাটা রুটির সাথে ম্যাড়মেড়ে সব্জি বা চিনিহীন দুধ কর্নফ্লেক্স।
খাবারের মান, পরিচ্ছন্নতা ও দামের নিরিখে প্রতিপক্ষ দোকানের সাথে প্রতিযোগিতায় অভিনন্দনের চাপ-বিরিয়ানি, সজলের সু্প বা চিকেন লালিপপ, মৈনুদ্দিনের শিক কাবাব, মঞ্জনের ফুচকা অথবা রাবনের তন্দুরি রুটির মত তপনের মশলা চা-এর লোভে দিন মজুর, বাড়ির ঠিকে কাজের মেয়েটি থেকে ধোপ দুরস্ত অফিসবাবুটির কেউ পরিবার নিয়ে, তো কেউ বা আলো আঁধারির লুকোচুরির ভেতর একটু সান্ধ্য রসনা তৃপ্তির স্বাদে মেতে ওঠে। চিকেন সিক্সস্টি ফাইভে বা ফিস ফিঙ্গারে ভর করে কত যে প্রেম ধরা দেয়, নবপ্রজন্মের কত যে প্রেমের অভিমান ভেঙ্গে হৃদয় জুড়ে দেয় এই বিজেপির কোনাকাঞ্চি। আবার অনেকের কাছে নিজের মত করে প্রতিদিন এই সান্ধ্য ‘ফুডকোর্ট’ ধরা দেয় যেন এক মায়ামহল। এই ‘ফুডকোর্টে’র সান্ধ্য মায়ায় ঘরবন্দী রাশভারী শিলিগুড়িবাসী আর দশ জনেরও হয়ত মনটা টানে একটু এসে সপরিবারে তাওয়া গরম কিছু চেখে দেখতে, একটু হাওয়া খেয়ে, দু ঢোক মাজিটোর স্বাদে কিংবা পারিবারিক চাপ বাড়িতে রেখে এসে দু-দণ্ড দক্ষিণের ফাঁকা রাস্তায় ফালুদার স্বাদ নিতে নিতে হয়তো গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কয়েক কলি। প্রতিদিনের এই সান্ধ্য মায়া আর যাই হোক আজকের শিলিগুড়ির কাছে তো প্রপঞ্চময় মোটেই নয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team