কলিকাগ্রাম কল্কে সমিতির সদস্যরা দল বাঁধিয়া পাহাড়ে গিয়াছে। সমিতির চালা ঘরে প্রাক্তন ভূ-পর্যটক গবাক্ষ নন্দীর মুখে পাকিস্তান ভ্রমণের গপ্পো শুনতেছি সহসা সম্পাদকের ফোন আসিল। ধরিতেই তিনি খ্যাক খ্যাক করিয়া হাসিলেন। কহিলেন, “আমাদের লিট ফেস্ট লইয়া কিছু লিখিবে। খ্যাক খ্যাক খি---।”
লিট ফেস্ট বুঝিতেই মিনিট খানেক গেল। শেষে গবাক্ষবাবু হেল্প করিলেন। “আপনাকে লিট ফেস্ট নিয়ে লিখতে বলেছে তো? বেশ তো, গাড়ি থেকে নামার আগে এক ছিলিম টেনে নেবেন’খন। আমিই নিয়ে যাব গাড়ি চালিয়ে। আপনি টানবেন আর যাবেন।”
এহেন স্নেহপুষ্ট পরামর্শ পাইয়া লিট ফেস্টে যাইতেই গদি আঁটা দ্বারবিশিষ্ট বৃহৎ কক্ষে গল্পকার বিল্বপত্র মুখোমুখি। মুখ শুষ্ক দেখিয়া কহিলাম, “কী হে! সুগার আছে নাকি?” ওমনি সে ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া চাপা স্বরে কহিলেন, “কী কহিব কলম! ডুয়ার্সের ছোটগপ্পে মার্কেজের প্রভাব শীর্ষক ডকুচিত্র একটু আগেই রিলিজ করিয়াছে। আমার সত্তর মিনিটের বক্তব্য কেটে কত করেছে জান?”
“কত? দশ সেকেন্ড?”
বিল্ব একটু চটিয়া বলিল, “না। উনচল্লিশ।”
উহাকে সান্ত্বনা দিয়া বামে তাকাইতেই দেখি কবি কঙ্কাবতী। তাহাকে বিল্বপত্রের ঘটনা বলতেই সে নাক কুঁচকাইয়া কহিল, “তাও তো রেখেছে! পনসদা আমাকে স-ব ফুটেজ দেখিয়েছে, বুঝলে। বিল্বদার বক্তব্য একেবারে সহায়িকা থেকে ঝাড়া। পনসদা কী রেঞ্জের পরিচালক তুমি জানোই না।”
আমি কঙ্কাবতীর সহিত একমত হইয়া কফি খাইয়া বাথরুমে গিয়া দেখি উদাসী গায়ক উর্ধনেত্র হইয়া শি দিতেছেন। সেই অবস্থায় বলিলেন, “তুমি কি আমার অণু গল্পের সংকলন পড়েছ কলম? অবশ্য তোমরা কেন পড়বে? আমরা তো আর লেখক নই!”
“কিন্তু আপনি তো মান্না দের গান গাইতেন! এখানে?”
শি শেষে চিরিক করে চেন টানিয়া ক্লান্ত স্বরে উদাসী জবাব দিলেন, “আমি যে লিখি সেটাই অনেকে জানে না। আমি তো ঔপন্যাসিক তুষারমালার মত লিখতে পারি না। কেন তোমরা পড়বে?”
তুষারমালাকে আমি চিনি না। কিন্তু খানিক পর সর্বগুণা একা একা ঘুরিতেছে দেখিয়া কহিলাম, “তুষারমালা আসে নাই?” তিনি গম্ভীর হইয়া জবাব দিলেন, “তাকে বাদ দিয়ে আজকাল কিছু হয়? ওই দেখুন একসাথে দু-জন তাকে সাহিত্য বোঝাচ্ছে! দু-জনের আগ্রহ দেখেছেন? অথচ দু-জনের একজনও আমার শ্রেষ্ঠগল্প নিয়ে একটা লাইনও লেখেন নি। জিগ্যেস করলেই বলে, এই তো পড়ব! আপনি পড়েছেন?”
“না তো?”
“সে কী! আমাজনে পাওয়া যায় তো! দাঁড়ান লিংক হোয়াটসাপ করে দিচ্ছি। এখন অর্ডার করবেন তো?”
“বাড়ি গিয়ে...।”
“আরে আপনি আমাজন খুলুন। পেমেন্ট আমার কার্ড থেকে করবেন। আমাকে পরে পাঠিয়ে দিলেই তো হলো, তাই না?”
আমি হাঁটা শুরু করিয়া বলিয়া দিলাম, “সকাল হইতে এত ভিডিও কল করিয়াছি যে দেড় জিবি ফুরাইয়া গেছে।”
“আমি হটস্পট দিচ্ছি।”
সর্বগুণা সুন্দরী হইলেও তাহার অনুরোধ না রাখিয়া হাঁটা দিলাম। একটি বালিকা ব্যাজ পরাইতে আসিল। কহিলাম, “ইহাতে এলার্জি আছে। শ্বাসকষ্ট হয়।” সে বলিল, “সরি কাকু!” সম্পাদক কহিলেন, “ফেস্ট তো শুরু হয় নাই! যাচ্ছ কোথায়?” আমি তাহাকে সব বলিতেই তিনি আমাকে যাইতে বলিয়া মিটিমিটি হাসিতে হাসিতে বাথরুমে ঢুকিয়া পড়িলেন। আমি তড়িৎ গতিতে বাহির হইয়া নিকটস্থ বিয়ারাপণে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম গবাক্ষবাবু ঢুলুঢুলু। কহিলেন, “ফেস্ট তো সদ্য শুরু হইল। রিপোর্ট লিখিবে না?”
আমি কহিলাম, “না না। আমি পলিটিক্স লিখিব। পোয়েটিক্সে আগ্রহ নাই।”
তিনি কহিলেন, “ইহাই ভালো। কোনও জটিলতা নাই। বড়ফুলের রাজ্যাধিপতি ডুয়ার্সে প্রবল টাইফুনের মুখে পড়িয়াছে, বৈকুণ্ঠপুরে সূর্যকুলীনবাবু পদ পায় নাই, যমদেব ঠিকাদারি ত্যাগ করিয়া ইন্দ্র হইয়াছেন, উত্তরবঙ্গীয় রথদপ্তর খাবি খাইতেছে, মন্ত্রীকুমারীর চাকরি নট হইয়াছে, একজোড়া হাতি খুন হইয়াছে --- এতসব উত্তেজনা ছাড়িয়া তুমি পোয়েটিক্সে গিয়া ভুল করিয়াছ! এখন এক ঢোঁক ভালুক খাও। গাড়িতে বসিয়া তামাক খাইও।”
আমি ঢোঁক মারিয়া বোতল অর্ধেক করিয়া ভাবিলাম, পলিটিক্স লিখিয়া শহিদ হওয়া মঙ্গল। জেলে গেলেও আপত্তি নাই। সম্পাদককে কহিব, ছোট ফুলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামাইতে গিয়া যদি সিবিআই-এর পাল্লায় পড়ি তাহাতেও সুখ। কেহ যদি পাকিস্তান যাইতে পরামর্শ দেয় তো চলিয়া যাইব। কিন্তু পোয়েটিক্স ...।
তখনই সম্পাদকের হোয়াটসআপ আসিল: “তুমি কোথায়? প্রাবন্ধিক ব্রহ্মাণ্ড বাচস্পতি তাহার 'ছোটগল্পে ধনেশ পাখির বিবর্তন' গ্রন্থখানির উদ্বোধক রূপে তোমার খবর করিতেছেন। অণুগল্প লেখিকা মন্দাকিনী তাহার 'অণুমতি' সংকলনের মোড়ক উন্মোচন তোমাকে দিয়া করাইতে ইচ্ছুক। এই বিষয়ে তোমার প্রতিক্রিয়া কী?”
একটু ভাবিয়া উত্তর দিলাম, “বাকরুদ্ধ।”
তারপর লিখিলাম, “স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছি।”
তিনি স্মাইলি পাঠালেন। তাহাতে সাইলেন্ট খ্যাক খ্যাক খ্যাক ...।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team