রেনীর তরাই ডুয়ার্স। উমেশ শর্মা
প্রকাশক এখন ডুয়ার্স। দাম ২৫০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান ৬২৯৭৭৩১১৮৮
প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও জলপাইগুড়ি জেলার ইতিহাস অন্বেষক শ্রী উমেশ শর্মার লেখালেখির আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর দৌলতে আমাদের জলপাইগুড়ি জেলার পারিপার্শ্বিক ভূভাগ সম্বন্ধে আমরা অনেক অজানা তথ্যে ঋদ্ধ হয়েছি। এছাড়াও তিনি জেলার সঙ্গে অসম্পৃক্তদেরও এ ভূভাগের ইতিহাস ও তথ্যাদি সম্বন্ধে আগ্রহী করে তুলেছেন।
এমন এক লেখকের নবতম গ্রন্থ 'রেনীর তরাই ডুয়ার্স' হাতে পেয়ে পুলক অনুভব করলাম। তাঁর তথ্যবহুল অন্যান্য অনেক গ্রন্থ যেভাবে খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে, এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটি হয়েছে বিপরীত। খুঁটিয়ে পড়া তো দূরের কথা লেখাটি অনেকটা তরতরিয়ে গড়িয়ে চলে। বর্তমান পুস্তকটির উপজীব্য বিষয় হল একাধিক ব্রিটিশ মিশনের ভুটান গমন ও পরিশেষে ইঙ্গ ভুটান যুদ্ধ। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকেই ব্রিটিশদের সঙ্গে ভুটান সরকারের একটা বিরোধ চলছিল। বিরোধের প্রধান কারণ ইংরেজ আশ্রিত কুচবিহার ও জলপাইগুড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা ভুটানিরা দখল করে, লুটপাট করে ও অধিবাসীদের বন্দি করে নিয়ে যেতো। এসবের একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য ইংরেজি ১৮৬৩ সালে মিঃ অ্যাসলে ইডেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশরা ভুটানে একটি শান্তি মিশন প্রেরণ করেন। বইটিতে ঐ মিশনের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে।
শ্রী উমেশ শর্মার এই বইটি সার্জেন রেনীর 'ভুটান এন্ড দ্য স্টোরি অব্ দ্য দুয়ার ওয়ার' নামে বিখ্যাত গ্রন্থটি আশ্রয় করে লেখা। ৪০৭ পৃষ্ঠার এই বৃহৎ গ্রন্থটি সেই সময়কার ভুটান ও ডুয়ার্সের অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যসমূহ জানার জন্য একটি আকর গ্রন্থ। এই সুবৃহৎ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ এ যাবৎ না হওয়াতে সেই ঘাটতি পূরণ করতে বর্তমান লেখকের এটা একটা সাধু প্রয়াস। শ্রী শর্মা বইটি হুবহু অনুবাদ না করে প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠায় তার ভাবানুবাদ করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যই বাদ দেন নি। উপরন্তু বইটির মেদ ঝরিয়ে অন্যান্য স্থান থেকে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য সংযোজন করেছেন।
কোন কিছু অনুবাদ করতে গেলে অনুবাদককে অনেক সময় মূল লেখকের ভাষাশৈলীকে অনুসরণ করতে হয় এবং তা লেখার প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান ক্ষেত্রে লেখককে (জ্ঞানতই তাঁকে অনুবাদক বলছি না) ঐ অসুবিধা পোহাতে হয় নি। তিনি তাঁর মতো করে নিজস্ব শৈলীতেই লেখাটি লেখার স্বাধীনতা পেয়েছেন। তাই বইটি কোনো মিশন যাত্রার ক্রনিকাল না হয়ে একটা রোমাঞ্চকর ভ্রমণ কাহিনিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
লেখক বইটি বারটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে প্রথম দুটি অধ্যায়ে প্রাককথন ও ভুটান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। পরের তিনটি অধ্যায়ে যুদ্ধের বর্ণনা ও শেষের দুটি অধ্যায়ে সার্জেন রেনীর পর্যবেক্ষণ ও তরাই ডুয়ার্সে প্রত্যাবর্তনের বিবরণ দিয়েছেন।
এমনিতে সম্পূর্ণ বইটিই উপাদেয়। তবুও তৃতীয় থেকে পঞ্চম অধ্যায় পর্যন্ত, যে স্থলে মিশন নিয়ে মিঃ অ্যাসলে ইডেনের ভুটান যাত্রার বিবরণ দেওয়া আছে, তার এককথায় অনবদ্য। একটা রাজনৈতিক মিশনের যাত্রাপথ এতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারে, তার এই বই না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যিই সার্জেন রেনীর এই যাত্রার বিবরণ খুব সুন্দর ভাবে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন। ইডেন সাহেব এমন একটি আদিম দেশের ভেতর দিয়ে তাঁর মিশনকে নিয়ে যাচ্ছেন,যে দেশ সম্বন্ধে তাঁর কিছুই জানা ছিল না। জানা ছিল না ঐ দেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য। পদে পদে কীভাবে তিনি পথের বন্ধুরতা, প্রকৃতির প্রতিকূলতা বা সেখানকার দেবরাজার কর্মচারীদের শত্রুতাপূর্ণ আচরণে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন, তার অনুপুঙ্খ লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। কারো কাছে আশ্রয় না পেয়ে সাহেবকে বরফের উপর তাঁবু ফেলতে হয়েছে, তাঁর সঙ্গী সাথীরা অনেকেই ঠাণ্ডায় মারা গেছেন, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী চুরি ও লুটপাট হয়েছে। প্রতি পদে পদে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঐ সময়ে সাহায্য করা দূরে থাক, স্থানীয় রাজকর্মচারীরা তাঁকে প্রবঞ্চনা করে চলেছিলেন। যত ধরনের প্রতিকূলতা সম্ভব সেসবের প্রায় সবগুলোই তাঁকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
শ্রী উমেশ শর্মার লেখার প্রসাদ গুণে এই যাত্রাপথের বিবরণ একটা রোমাঞ্চকর ভ্রমণ কাহিনিতে রূপান্তরিত হয়েছে । আমার কখনোই মনে হয় নি, লেখাটি একটি মিশনের ইতিবৃত্তের ভাবানুবাদ মাত্র। এই অংশটি পাঠককেও গোগ্রাসে পড়তে হবে। এবং পাঠ শেষে আরও পড়তে পারলে ভালো হতো বলে অতৃপ্ত থাকতে বাধ্য হবেন কিংবা মূল গ্রন্থটি পড়ে হবেন অনুপ্রাণিত হবেন।
ষষ্ঠ থেকে দশম অধ্যায়ে ভুটানের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধের বিষদ বিবরণ এ কাহিনিতে একটা পরম প্রাপ্তি।এ বিবরণটিও মনোজ্ঞ ও তথ্যবহুল। এটাই স্বাভাবিক। একদিকে আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ বাহিনী এবং অপরদিকে আদ্যিকালের তীর ধনুক,গাদা বন্দুক বেশির ভাগে গুলতি পাথর হাতে আনাড়ি অস্থায়ী সৈনিক। ফলতঃ যুদ্ধের অন্তিম পরিণতি সহজেই অনুমেয়। তবুও ভুটানিদের গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ সকলের নজর কাড়বেই।
অন্তিম অধ্যায় দুটিতে রেনী সাহেবের দার্জিলিং,তরাই ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের বিবরণ এ জেলার অধিবাসীদের আকর্ষণ করবেই। কারণ, জেলার বিভিন্ন স্থান ও স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন লেখক।
পরিশেষে একটি কথা পুনরাবৃত্তি না করে পারছি না যে বহুদিন পর একটা সুন্দর ও সুখপাঠ্য বই পড়ে আমি তৃপ্ত হয়েছি এবং আশা রাখছি পাঠকমহলেও বইটি সমাদৃত হবে।
প্রচ্ছদ, কাগজ, ছাপা বা বাঁধাই-- সব মিলিয়ে বইটির প্রকাশনাও সুরুচিপূর্ণ।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team