১৯০৭ সালে প্ল্যানটার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ‘সিটিজেন অফ দার্জিলিঙ হিলস’-এর নামে তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের কাছে দার্জিলিঙ জেলাকে বাঙলা থেকে পৃথক করে এক রাজ্য গঠনের যে দাবি করেছিল তা শতবর্ষের দরজা পার করে দিয়েছে। সেই দাবিই আজ পাহাড়ে জনজাতির জাতিসত্তার লড়াইতে রূপান্তরিত হয়ে সমতলের রাজনৈতিক দলগুলির মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ফলে এই দাবি যতখানি পাহাড়ি জনজাতির স্বাধীন পরিচয় তথা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মানসিকতাকে হাজির করছে তার থেকে পাহাড়ের মানুষের অদম্য আকাঙ্খাকে ব্যবহার করে একেক সময় একেক দল তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনে সেই গোর্খাল্যান্ড দাবির রথের সারথী হয়ে বসতে চাইছে। স্থায়ী মীমাংসার জন্য কোনো পক্ষ থেকে আদৌ কোনও আন্তরিক ইচ্ছা আছে কিনা তা নিয়ে অতীতের ক্ষেত্রে যেমন গভীর সন্দেহ ছিল তেমনি বর্তমানের রাজনৈতিক চেহারা দেখে সেই প্রশ্ন পাহাড়িদের মনে আরো গভীরভাবে দেখা দিচ্ছে।
দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকার ইতিহাস ও ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার জন্য দীর্ঘ পরিসরের প্রয়োজন। এই প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির মধ্যেই এই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হল। ‘পাহাড় হাসছে’ এমন কথার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই ১১৫ বছরের পুরনো সমস্যার সমাধান করার সাফল্য দাবি করলেও বাস্তবে কিন্তু চুক্তিপত্রের কালি শুকোবার আগেই সেই দাবি ইতিহাসের গর্ভে জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। ভাবনার দরজায় এসে কড়া নাড়ছে-- পাহাড়ে আবার কী হতে চলেছে?
মুখ্যমন্ত্রী নিঃসন্দেহে পাহাড়ে শান্তি চান। কিন্তু এর জন্য কলকাতায় তাঁর দপ্তরে পাহাড়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে বৈঠক ডেকেছিলেন সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আজকের এই রাজনৈতিক জটিলতা ও সঙ্কট। গোর্খাল্যান্ড নামক পৃথক রাজ্যের দাবি আদতে জাতিসত্তার এক বিশ্বজনীন সঙ্কটের অংশ এই সত্যটাকে মাথায় না রেখে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন আগাগোড়াই এই দাবিকে কোনো এক ব্যক্তিনির্ভর আন্দোলন হিসেবে গণ্য করেছেন। পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রীরাও একই ভুল করেছিলেন। তাঁরাও ধরেই নিয়েছিলেন সুবাস ঘিসিংকে বা বিমল গুরুংকে বশে আনতে পারলে অথবা বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই এই দাবি থেকে জনগনের মন সরিয়ে দিতে পারবেন।
পরবর্তী রাজ্য সরকার আবার একটু অন্যপথ নিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ পাহাড়ের প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য না ডেকে সেখানে বিভেদের প্রচেষ্টায় প্রশাসনের মনোনীত দল ও ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানালেন। এটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাহাড়ে যেখানে একটা ঐক্যবদ্ধ পাহাড়ি জাতিসত্তার বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল তাকে উৎপাটিত করতে ১৫টি পাহাড়ি জনজাতির নামে পৃথক পৃথক গোষ্ঠী উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করে তাদের পৃথক জাতিসত্তার ভাবাবেগকে উসকে দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঔপনিবেশিক শাসনের সেই ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ ভাবনার প্রেতাত্মা কীভাবে স্বাধীন ভারতের কোনও রাজ্য প্রশাসনের ওপর চেপে বসতে পারে তার যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
এরপর গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ১০৫ দিন ধরে অভূতপূর্ব পাহাড় বন্ধে শুধু যে পাহাড়ের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছিল তা নয়, সংলগ্ন সমতলের আর্থিক অবস্থারও ঘটেছিল ভয়াবহ বিপর্যয়। ব্যবসায়ী মহল থেকে ক্রমাগত চাপ বাড়ছিল। এই অবস্থায় বিমল গুরুং যে বন্ধ প্রত্যাহারের অজুহাত খুঁজে চলেছিলেন সে খবর তো রাজ্য সরকারের কাছে ছিলই। সে সময় রাজ্য সরকার যদি ইউএপির মতন অগণতান্ত্রিক আইনের ধারায় বিমল গুরুংকে গ্রেফতারের হুলিয়া জারি না করে তাঁকে আলোচনার জন্য ডেকে এনে তাঁকে দিয়েই বন্ধ প্রত্যাহারের ঘোষণা করাতেন তা হলে বিমল গুরুংকেই পাহাড়ের জনতার কাছে এই হটকারি বন্ধ ডাকা ও তা প্রত্যাহারের কৈফিয়ত দিতে হত। রাজ্য সরকার তা না করে বিনয় তামাঙকে দিয়ে সেই প্রত্যাহারের ঘোষণা করিয়ে তাঁকে বিমল গুরুং-এর বিকল্প নেতা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন।
এই একই ভুল কাশ্মীরের রাজনীতিতে করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। শেখ আব্দুল্লাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে তার মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে তাকে ১১ বছর জেলে বন্দি রেখে প্রথমে বক্সি গোলাম মহম্মদকে পরে মীরকাসিমকে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। নেহেরুর ধারণা ছিল শেখ আব্দুলাকে ক্ষমতার বাইরে রাখলে জনতা ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। ফল হয়েছিল উল্টো। শেখ সাহেব কাশ্মীরের জনতার মনের আরও গভীরে ঢুকে গেলেন। আর গোলাম মহম্মদরা কেন্দ্রের তল্পিবাহক বলে চিহ্নিত হয়ে জনতার ঘৃণার পাত্র হয়ে রইলেন।
ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে তাকে অপব্যবহার করে দার্জিলিং পাহাড়ে বিমল গুরুং-এর জনপ্রিয়তার পারদ তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল, যেমন হয়েছিল সুবাস ঘিসিঙ্গের বেলাতেও। কিন্তু রাজ্য সরকার বিনয় তামাঙ বা অনিত থাপাকে বিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় পাহাড়ের জনতার চোখে তাঁরাই কিন্তু নতুন করে ‘বঙাল সরকারের অনুচর’ চিহ্নিত হলেন। ফলে পাহাড়ের নেতিবাচক আবেগ কিন্তু অনেকাংশেই বিমল গুরুংএর উপর থেকে তাঁদের দিকে সরে গেল। অন্যদিকে বিমল গুরুং জানেন সুবাস ঘিসিঙ গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নামক বাঘের পিঠে চড়ে বসার পর লালকুঠির ক্ষমতার আরাম কেদারাকে স্থায়ী করার স্বপ্নে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার আশ্বাসে সেই পিঠ থেকে নামার চেষ্টা না করলে তিনি সেই চেয়ার দখল করতে পারতেন না। তাই সেই মূল গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে ধরেই তিনি তাঁর হারানো ক্ষমতাকে ফিরে পেতে চাইছেন। আর একথা সত্যি পাহাড়ের আন্দোলনে সেখানকার মহিলারা বরাবরই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে থাকে। বিমলের নারী মুক্তি মোর্চা কিন্তু তাঁর এখনও বড় শক্তি। পাহাড়ের মানুষের এই আবেগের শক্তিকে বিনয়-অনিতেরা অস্বীকার করতে পারছেন না। তাঁরা রাজ্য সরকারের এত কাছের লোক হয়েও ঘোষণা করতে পারছেন না যে গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে তাঁরা সরে এসেছেন। তাঁদের প্রজাতন্ত্র মোর্চা প্রস্তাবিত জিটিএ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজ্য সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করতে চাইলেও কখনও বলতে পারছেন না যে তাঁরা বাঙলাকে অটুট রাখতে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিকে আর সমর্থন করেন না।
অপরদিকে অজয় এডওয়ার্ডের হামরো পাটি প্রথম আবির্ভাবেই চমক দেখাল বটে তবে তার যত না জনবল তার থেকে বেশি অর্থবল এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে বলে পাহাড়ের অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। তাঁর বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে সামলে তিনি পাহাড়ের মূল জাতিসত্তার সমস্যা সমাধানে কতখানি সময় দিতে পারবেন এবং কতদিন এই রাজনীতিতে থাকবেন তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। বিমল গুরুং কৌশলগত কারণে বিজেপির থেকে তাঁর দুরত্ব দেখাচ্ছেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও তার সঙ্গেই বিজেপির একটা বোঝাপড়া আছে বলে পাহাড়ের রাজনৈতিক মহলের একাংশের বিশ্বাস।
তবে মনে রাখতে হবে দার্জিলিঙ পশ্চিমবঙ্গের অংশ হলেও সিকিমসহ এই পার্বত্য এলাকা কিন্ত ভৌগলিক, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসে এই রাজ্যের সমতলের তুলনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক কাছাকাছি। ভারতের মূল ভূখন্ডের অমঙ্গোলিয়ান জনজাতির তুলনায় মঙ্গোলিয়ান জনজাতি একে অপরকে অনেক কাছের মানুষ বলে ভাবে। এদের কাছে দিল্লি বা কলকাতা উভয়ই দূরের দেশ বলে মনে হয়। তাই সংহতির নামে তাড়াহুড়ো করে কিছু চালাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সব মিলিয়ে বলতেই হয় দার্জিলিঙ কিন্তু আজ আর হাসছে না। বরং কী হয় এক অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় দুলছে বাংলার হিমালয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team