এসময় মাটি চায় জল দাও! গাছ চায় জল দাও! তৃষ্ণার্ত পাখি চায় জল দাও! চাষি চায়, জল দাও। জ্যৈষ্ঠের এই দগদগে গরমে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় শব্দদুটি কখন যে বিশ্বজনীন আবেদনে রূপান্তরিত হয়, আবার কখন যে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে ‘হট কেক’ হয়ে যায় সেকথা কেউ কখনও আগাম অনুমান করতে পারে নি। নদীমাতৃক এই বাংলার উত্তর ভাগে রয়েছে জলসম্পদের সিংহভাগ, সেকথা নতুন করে বলবার কিছু নেই। শিল্পবিহীন এই প্রান্তিক উত্তরবঙ্গে কৃষিভিত্তিক জনপদ গড়ে উঠেছিল এইসব নদীগুলিকে ঘিরেই। পাহাড় নদী জঙ্গল ঘেরা এই উত্তরভূমিতে বিগত গত কয়েক দশকের অপরিমিত জনবিস্ফোরণ এই এলাকার ইকোসিস্টেমকে যেমন বিঘ্নিত করেছে, তেমনি দীর্ঘদিনের অপরিকল্পিত সংরক্ষণ এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতাকে বিনষ্ট করেছে, কোনও সন্দেহ নেই। উত্তরবঙ্গের কৃষিজাত খাদ্যশস্য-আনাজ ও নদীজাত মৎস্য উৎপাদন এখানকার মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদাকে মেটাতে আজ আর যে সক্ষম নয় তা বলাই বাহুল্য।
গ্রীষ্মের প্রখরতায় বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে যে পরিমাণ জল প্রয়োজন হয় পরিকল্পিত নদীভিত্তিক সেচ ছাড়া তা পূরণ করা সম্ভব নয়। যে সময় কৃষক আরো আরো জল চায় তার ফসলের উৎকর্ষতার জন্য, সেসময় শুখা নদী খাতে পড়ে থাকে কেবল বালি-পাথর। পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারার সঙ্গে যে বালি-পাথর নদীবক্ষের উচ্চতা ক্রমশ বাড়াতেই থাকে। নদী অববাহিকার কৃষি জমিতে যেসময় ফসল মাথা তুলে উঠে দাঁড়ায়, সেসময় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে প্লাবিত হয়ে যায় সেইসব বিস্তীর্ণ অঞ্চল, চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি। ভাগ্যের লিখন আর সরকারি ত্রাণকে সম্বল করে এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।
এমনই এক নদীভিত্তিক ব্যর্থ অসমাপ্ত ট্রাজেডির নাম হলো তিস্তা। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে যে নদীর পাহাড়ী স্বাভাবিক গতিপথকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলা হয়েছে প্রাকৃতিক ভূবিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে। তারও আগে যে নদীকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে সুবিশাল বিজ্ঞানভিত্তিক সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে অহেতুক অবহেলা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে। অথচ যার সঠিক সময়ে সফল রূপায়ণ পুরোপুরি বদলে দিতে পারত কৃষিভিত্তিক উত্তরবঙ্গের ভাগ্যকে। এরপর নদী আরও ১৫৩ কিলোমিটার (মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫কিমি) বয়ে চলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এ নদীর জলে সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে আসছেন তাঁরা সেই গত ৭৫ বছর ধরে। কিন্তু ফলশ্রুতিতে কিছুই মেলেনি তাঁদের, দীর্ঘকালের দাবি আজ প্রায় আশাহীনতায় পরিণত হয়েছে। দুই বাংলার সুসম্পর্কের পথে কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। জলবন্টনের ইস্যু আজ তিস্তাকে বিতর্কিত আন্তর্জাতিক নদীতে পরিণত করেছে।
কিন্তু আজকের বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাঁদের ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধার ফায়দা দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের কাছ থেকেই ওঠাতে চাইছে। স্বভাবতই তিস্তার জল এখন তাঁদের কাছে প্রয়োজনের চাইতেও বেশি প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের দেশের তিস্তাকে সারিয়ে ও সাজিয়ে তুলতে সুবিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ সরকার। তিস্তাবক্ষে জল ধরার ক্ষমতা ও নাব্যতা বাড়ানোর জন্য ও বন্যারোধের লক্ষ্যে ১০৮ কিমি ড্রেজিং, বর্ষাকালের অতিরিক্ত জল ধরে রাখবার জন্য একটি বিশাল রিজার্ভার নির্মাণ, নদীর ধার বরাবর ১১৫ কিমি ফোরলেন রাস্তা এবং দুধারে ১৭৩ কিমি নদী বাঁধ এবং নদীর ধারে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের এই মেগাপ্রকল্পে।
এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়িত করবার জন্য চীনের কাছে প্রায় একশ কোটি ডলারের আর্থিক ঋণ চেয়েছেন তাঁরা। চীনের পাওয়ার করপোরেশন এই ঋণ প্রকল্পের যথার্থতায় অনুমোদন দিয়েছেন বছর দুয়েক আগেই। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, এর আগে যে সব প্রকল্পের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তিস্তা নদীর এই উন্নয়ন প্রকল্পকে সেগুলির চাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। স্বভাবতই তাঁদের এই আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং প্রকল্পের কাজ শুরু এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে তিস্তার জল অধিকার নিয়ে ফের সরব হয়েছেন বাংলাদেশ সরকার। সম্প্রতি গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী বিষয়ক আলোচনার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, আরো ৫৪টি নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনও সমস্যা না হলেও গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তিস্তার জলবন্টনের মীমাংসা না হওয়াটা অত্যন্ত লজ্জার। এর ফলে কোনও সন্দেহ নেই তিস্তা অদূর ভবিষ্যতেই চীন-ভারত-বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। আরো উল্লেখ্য বিষয় বাংলাদেশের মিডিয়াও তিস্তা ইস্যু নিয়ে যথেষ্ট সরব হয়েছে। তিস্তা নিয়ে চৈনিক মদতে সীমান্তের ওই পারের এই পরোক্ষ চাপ আমাদের সরকার কীভাবে সামলায় সেটাই দেখবার বিষয় বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।
ঘরোয়া জনপ্রিয়তার রাজনীতির স্বার্থেই তিস্তার জল নিয়ে এই টানাপোড়েন ঠিক কথা, তবে জনগণের চোখের আড়ালে রাজনীতির কোন রঙ্গ অনুষ্ঠিত হবে তা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। একই নদীকে নিয়ে সীমান্তের একদিকে রয়েছে নদীর পূর্ণ অধিকার পেয়েও যথেচ্ছ পরিকল্পনাবিহীন উপযোগ, অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি নদীর জলের অধিকার পাওয়ার আগেই জলসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আগামী দিনের সুসংহত পরিকল্পনা। এই দুইয়ের মোকাবিলায় কোনপক্ষ শেষ অব্দি লাভবান হবে তা আমরা জানি না। তবে নদী ও মানুষের চিরকালীন ভারসাম্য রক্ষায় কোথাও যেন বিচ্যুতি না ঘটে সেটুকু একজন সাধারণ মানুষের সেটুকুই কামনা। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, নদী যেমন মানব সভ্যতা নির্মাণ করে তেমনি তা ধ্বংস করতেও একইরকম পারঙ্গম।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team