পুরাণের বিভিন্ন নারী চরিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে শুধু যে মহিয়সী নারীদেরই দেখা মিলেছে তা নয়। বেশ কিছু খল চরিত্রও মনে দাগ কেটে যায়। এইসব খলস্বভাবা নারীরাও পুরাণে নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর। হোলিকা তেমনই চরিত্র যার কথা শুনলে রাগ হয় অথচ তাঁকে ভোলাও সম্ভব হয় না। আর এই কারণেই হোলিকারা বেঁচে থাকেন কখনো পুরাণের পাতায়, কখনো লোকের মুখে মুখে।
হিরণ্যকশিপু ছিলেন বিষ্ণুর পরম শত্রু। তাঁর বড় ভাই হিরণ্যাক্ষের অত্যাচারে যখন দেবতাকুল অতিষ্ঠ তখন তাঁকে হত্যা করেন বিষ্ণু স্বয়ং। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন হিরণ্যকশিপু। তাঁর রাজ্যে বিষ্ণু পূজা নিষিদ্ধ করা হল, এমনকি তাঁর নামগান করা সাধু সন্ন্যাসীদের জীবন করে তুললেন নাজেহাল। বিষ্ণুকে না মেরে তাঁর শান্তি নেই।
নিজেকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে ও অমরত্ব লাভের আশায় তিনি শুরু করলেন ব্রহ্মার তপস্যা। দীর্ঘ ও কঠিন তপস্যায় ব্রহ্মা খুশি হয়ে জানতে চান কী বর চাই তাঁর। হিরণ্যকশিপু তখন অন্য কিছু না চেয়ে যুদ্ধে কোনদিনও পরাজিত না হওয়ার বর চেয়ে বসলেন। ব্রহ্মা যেহেতু সম্মতি দিয়েছিলেন তাই সেই কথানুযায়ী তাঁকে পাঁচটি বর দিলেন। সেই পাঁচটি বর হল, কোনো মানুষ বা প্রাণী তাঁকে কখনো মারতে পারবে না, ঘরের ভেতর ও বাইরেও তাঁর মৃত্যু হবে না, দিনে অথবা রাতে তাঁর মৃত্যু হবে না, কোনো অস্ত্রশস্ত্র দ্বারাও তাঁর মৃত্যু হবে না। সর্বশেষ বর হল, হিরণ্যকশিপুকে জলে, স্থলে এমনকি শূন্যেও কেউ মারতে পারবে না। এমন বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। রাজ্য জুড়ে তাঁর অত্যাচারে সবাই দিশেহারা হতে লাগল। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল কোনো না কোনো উপায়ে বিষ্ণুকে হত্যা করা। বিষ্ণু যদি কোনোভাবে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তাহলে ব্রহ্মার বরের ফলে হিরণ্যকশিপুই জয়ী হবেন, কারণ তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে কেউ পারবে না।
এই হিরণ্যকশিপুর বোনের নামই হল হোলিকা। ভাইয়ের মতো তিনিও ছিলেন বিষ্ণু বিদ্বেষী। তাই এই বোন ছিল দৈত্যরাজের খুব কাছের। অন্যদিকে চার ছেলের মধ্যে প্রহ্লাদ ছিলেন অন্যরকম, পিতার চাইতে এবং পরিবারের অন্যান্যদের চাইতে একেবারে আলাদা। এত বিষ্ণু বিরোধীদের মধ্যে বাস করেও প্রহ্লাদ হয়ে উঠলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। নিজেকে বিষ্ণুর চরণে সঁপে দিলেন তিনি। বিষ্ণু ছাড়া তাঁর জগতে আর কিছু নেই, শ্রীহরি ছাড়া আর কোনো নাম নেই।
ছেলের এই মতি দেখে মনে মনে চরম বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলেন হিরণ্যকশিপু। তিনি নানা উপায়ে ছেলেকে বিষ্ণু বিদ্বেষী করে তুলতে চাইলেন। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল প্রহ্লাদ আরও বিষ্ণু নিবেদিত প্রাণ হয়ে গেলেন। কিছুতেই তিনি পিতার অনুরোধ, উপরোধ, আদেশ কিছুই মানলেন না।
হিরণ্যকশিপুর রাগ আরও বেড়ে গেল। ছেলেকে কিছুতেই বশ মানাতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। তাঁর বিষ্ণু বিদ্বেষ ছিল পুত্রস্নেহ থেকেও অনেকগুণ বেশি। তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে প্রহ্লাদকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করলেন পিতা স্বয়ং। তবে নিজেকে পুত্রহন্তা হিসেবে পরিচিত করাতেও তাঁর আপত্তি ছিল, তাই সরাসরি মৃত্যুদন্ড নয় কৌশলে মারার কথা ভাবলেন।
প্রহ্লাদকে মারার জন্য নিজের বোন হোলিকার শরণাপন্ন হলেন তিনি। ব্রহ্মার কাছ থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে একটি আশির্বাদী শাল পেয়েছিলেন হোলিকা, যে শাল গায়ে জড়ালে তাঁকে কোনো বিপদ ছুঁতে পারবে না, এমনকী তিনি কোনোদিন আগুনেও পুড়বেন না। হোলিকা এই শালের সাহায্যেই একটি পরিকল্পনা করলেন। ঠিক হল, এক যজ্ঞের আয়োজন করা হবে আর সেই যজ্ঞে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে বসবেন হোলিকা। কৌশলে সেই আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে প্রহ্লাদকে আর শাল শরীরে জড়িয়ে থাকার কারণে হোলিকা বেঁচে যাবেন।
পরিকল্পনা মতো সব আয়োজন করা হল। যজ্ঞের সময় হোলিকার কোলে বসলেন প্রহ্লাদ। কিন্তু সবরকম সাবধানতা নেওয়া স্বত্ত্বেও ঘটনাটা সম্পূর্ণ উলটে গেল। মুহূর্তের গাফিলতিতে সেই আশির্বাদী শাল জড়িয়ে গেল প্রহ্লাদের শরীরে, আর হোলিকা আগুনে পুড়ে মারা গেলেন। অন্যদিকে শালের জন্য অক্ষত রইলেন প্রহ্লাদ। মনে করা হয় বিষ্ণু স্বয়ং পবনদেবকে অকুস্থলে পাঠান যার ফলে শালটি প্রহ্লাদের গায়ে জড়িয়ে যায়। হোলিকার পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈর্ষা, অশুভ শক্তি, লোভ, হিংসা সব জ্বলে ছাড়খার হয়ে গেল।
এই হোলিকা দহনকে কেন্দ্র করেই দোল উৎসবের আগে ‘ন্যাড়া পোড়া’ উদযাপিত হয়। দিনটি ছিল ফাল্গুনী শুক্লপক্ষের চতুর্দশ্তম দিন। আদতে এর অর্থ অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির আহ্বান। তাই তো ডালপালা, আগাছা কিম্বা ধান কাটার পর গাছের গোড়ার অবশিষ্টাংশ যা ন্যাড়া বা নাড়া নামে পরিচিত তা পুড়িয়ে অশুভ শক্তিকে নাশ করা হয়। পরদিন সকলে মেতে ওঠে রঙের উৎসবে। মনে করা হয় অসুর নারী হোলিকার নামানুসারেই এই রঙের উৎসবকে বলা হয় হোলি।
তাই তো প্রতিবছর দোলের আগেরদিন যতবার আমরা বলে উঠি, “আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল/ পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বলো হরিবোল”, আর ততবারই ইচ্ছে না থাকলেও ওই দৈত্যরমণীকে স্মরণ করে ফেলি। এমন এক চরিত্রকে ভুলতে চাইলেও তাই ভোলার উপায় নেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team