ভিড়ভাট্টার বাইরে একদম নিসর্গ আর নিজের মুখোমুখি হতেই বেশ করে ইচ্ছে করে এই বয়সে এসে। কোলাহলের বাইরে পাখির ডাক, কিংবা জল ঝোরাঝরনার আওয়াজ খোঁজে মন। খুব বেশি মানুষী কথাবার্তাও ভালো লাগে না। হঠাৎ করেই কাফেরগাঁওয়ের হদিশ দিলেন প্রিয় বন্ধু। লুফেও নিলাম!
মালবাজার ঢুকবার মুখেই ডানদিকের রাস্তা ধরে গুরজংঝোরা চা বাগানের পথে গাড়ি ঘোরালেই মন আরো বেশি তৈরি হয়ে যায়! মাল নদী বাগান ও মীনগ্লাসের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোনো মানেই নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়া। রোদছায়া পথে শুধু অস্ফুট ডাক! মীনগ্লাসের ফ্যাক্টরিকে ডানদিকে রেখে গরুবাথানে যাবার বড় রাস্তা। ছবি আঁকছে ফাগু টী এস্টেট। মিশন হিলের রাস্তাটাও বড্ড টানে!
গরুবাথান বাজারের মানুষজন গাড়িকে কাটিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিতেই মন ভালো করা ক্যানভাস। পাপরখেতিতে মোমো এবং চা। অতিকায় পাথরের ওপর দেবতার সঙ্গে সেলফি তোলার হিড়িক চলছে। নিচে নদী চলেছে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে। সে জলতরঙ্গ প্রশান্তি ছড়াচ্ছে সকালি হাওয়ায়!
লাভাকে পেছনে রেখে চলেছি আরো নৈ:শব্দ আর সবুজের দিকে। কালিম্পং-এর অনেকটা আগে সাড়ে বারো মাইল থেকে বাঁদিকে গাড়ির চাকা বাঁক নিল। রেলি বাজার ছাড়িয়ে অপরূপ ল্যান্ডস্কেপকে সঙ্গী করে কাফেরগাঁওয়ের গন্তব্যে যেতে যেতে দারুণ দারুণ সব পাহাড়ি বাড়ি দেখছিলাম। বৃষ্টির জলে ভিজে আছে পাহাড়। আরো স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে।
লোলেগাঁও থেকে আরো ছ’কিলোমিটারের মতো। ঋজু পাইনের সেই রাস্তাটা গোটা জীবনের জন্য বুকে গেঁথে গেল!
কাফেরগাঁও পৌছতেই সুনীল তামাং-এর উষ্ণ অভ্যর্থনা, যেন সত্যিই অতিথি এলো তাঁর ঘরে। মেঘ কুয়াশা খেলে বেড়াচ্ছে সুনীলের অতিথিশালায়! পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই গ্রামটায়। স্কোয়াশের লকলকে লতা পাতা ঝুলছে এদিকওদিক। একটা মিষ্টি বাঁশের সাঁকো বানিয়ে রেখেছেন সুনীল। দৃষ্টিনন্দন। কটেজের ভেতর ঢুকে মনখুশ। কাঠ দিয়ে এত সুন্দর ইন্টেরিয়র সাজগোজ, ঘরের সঙ্গে মানানসই সোফা, টেবিল, আলমারি! লোভনীয় বারান্দা! পৌঁছেই মনে হতে লাগল – এত অল্প সময়ের জন্য কেন এলাম!
হোম স্টে-র মালিক সুনীল তামাং-এর কাছে জানতে চাইলাম – এত সুন্দর গ্রামটির নাম ‘কাফেরগাঁও’ কেন! স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে জানালেন, মেঠো আলুর মতো এক ধরণের ফল হয় এখানে, মাটির নিচে। তাকে ‘কাফের’ বলা হয়। সে থেকেই ‘কাফেরগাঁও’। পাহাড়ের গায়ে বিরাট এলাকা নিয়ে সুনীলের হোম স্টে। জৈব সারে কত শাক সবজি ফলছে এখানে। ছাগল, মুরগি ইত্যাদি পালন।
ফুলমায়া তামাং (৬৯), সুনীলের মা, যেন শরীরে পাহাড়ের প্রবীণ সৌন্দর্য ধরে রেখেছেন সযত্নে। মুখ জুড়ে বলিরেখা, নাকে ট্রাডিশনাল বিশাল নোলক, মুখ ভরা হাসি। এক মনে কাজ করে চলেছেন। পাতা পচানো সার দিয়ে চলেছেন গাছের গোড়ায় গোড়ায়। পাশে গিয়ে বসতেই আত্মীয়তার হাসি। তাঁর স্বামী ধনবাহাদুর তামাং-ও এসে বসলেন। তিয়াত্তর বছর বয়সেও একটা মানুষ সারাদিন কত কত কাজ করে চলেন – তিনটে দিন কাছ থেকে দেখেছি আর বিস্মিত হয়েছি। এ গ্রামের মানুষেরা কথা বলেন কম, কাজ করে যান নীরবে, আর কপটবিহীন হাসতে জানেন অনর্গল!
হোম স্টে-র সামন দিয়েই একটা মোহময় পথ চলে গেছে ঘন পাইন বনের দিকে। এ পথে হাঁটা জীবনের এক অসামান্য অর্জন।
ধনবাহাদুরের সঙ্গে অনেকটা সময় পাহাড়ের গল্প শুনে কাটল। কাফেরগাঁওয়ের পত্তন হয়েছিল ১৯২৮ সালে; তার আগের বছর লোলেগাঁও। ধনবাহাদুরের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল – ঘোড়ায় চড়ে টকটকে ফর্সা সাহেবরা আসতেন এ গ্রামে। পাইন বনের গভীরে যেতেন শিকার করতে। এই পাহাড়ের জঙ্গলে প্রচুর গাছ – পাইন, রানি চাপ, ধুপি, বর, পিপল, চিলাউনি ...। কত জানা অজানা লতাপাতা কীটপতঙ্গ, রকমারি পাখি। জঙ্গলে অনেক হরিণ আছে। ভালুক চিতাবাঘ আছে গভীর অরণ্যে। প্রাচীন গাছের গায়ে পরগাছা ফুল। ৫২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই গ্রামে সবসময় মেঘ আর কুয়াশার খেলা। ধনবাহাদুর জানালেন – এখান থেকে দু কিলোমিটার গেলে সাইলুং বাজার, সেখানে হাট বসে প্রতি শুক্রবার।
ডাইনিং হলের ওপরতলায় কী যত্ন করে একটা ছোটোখাটো গুম্ফা বানিয়ে ফেলেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সুনীল। বুদ্ধ পূর্ণিমার সকালে সেই পারিবারিক গুম্ফায় গিয়ে বসলাম। জানি না, এ সুযোগ আর এ জীবনে হবে কিনা! বুদ্ধের জন্মদিনে, তাঁর বোধিলাভ ও মহানির্বাণ লাভের পুণ্যদিনে পুরো বৌদ্ধ আরাধনা দেখলাম সেখানে বসে। লামা এসে উদার কন্ঠে নানান সুর করে ত্রিপিটক থেকে মন্ত্র পড়ছেন। ছড়িয়ে পড়ছে সেই মন্ত্র পাহাড়ে পাহাড়ে। পুজো শেষে পেলাম বুদ্ধ-পুজোর প্রসাদ।
কাফেরগাঁও বড্ড শান্তি দিয়েছে। পূর্ণিমা মেখে রাতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল রূপান্তরিত হচ্ছি আমি। সেই রূপান্তর ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। অনুভব করতে হলে কাফেরগাঁওয়েই যেতে হবে, সব ব্যস্ততা সমতলে রেখে দিয়ে!
কাফের হোম স্টে সুনীল তামাং – ৯৮৩২৩১১৫০৫
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team