 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 তনুশ্রী পাল
                                            
                                                
                                                তনুশ্রী পাল
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        পরিস্কার ধবধবে ধুতি-সার্ট, গলায় তুলসীবীজের মালা। পুরনো একটা সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে পরপর খানতিনেক গামলা, সবকটা রূপোর মতো ঝকঝকে! নীচেরটি আকারে বড়, মেজোটি তারচেয়ে ছোটো, আর সর্বোপরিটি আরেকটু ছোটো। গামলাগুলো পাটের রশি দিয়ে ক্যারিয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। হস্টেলের লালরঙা টিনের গেট ঠেলে প্রায় প্রতিটি রোববারে লাঞ্চের পরে তাঁর আবির্ভাব ঘটত। রোববারের দুপুরের মেনুতে মাংস। সে একপিস আলু আর দুটুকরো মাংস সমেত দুহাতা পাতলা ঝোল হলেও, সবাই দু-হাতা ভাত বেশিই খেতাম। সে বয়সে খিদে বা খাইখাই ভাবটি বেশিই থাকে, তাইনা। আর এমন রোববার করে সেই মানুষটির মধুর উপস্থিতিতে বোর্ডারদের মনে অপার্থিব খুশির ঢেউ, সে বলাইবাহুল্য! সত্যি বলছি, সাধারণ ধুতিসার্ট পরিহিত রোগা-সোগা চেহারার ভদ্রলোকটি আমাদের রুটিনবাঁধা হস্টেল জীবনে বিশেষ ব্যক্তি ছিলেন। নইলে এতগুলো দশক পেরিয়ে এসেও সহজ সরল শান্ত চেহারাটি স্পষ্ট মনে থাকল কী করে! আমাদেরমহানন্দ বা গভীর আকর্ষণের মূল উৎস ছিল কিন্তু রুপোরঙের ঝকঝকে পাত্রে শায়িত রাজকন্যেরা। ঘোষমশাই মনে মনে কী ভাবতেন তা তিনিই জানতেন; তবে সরল মানুষটির এ সত্যউপলব্ধি করতে খানিক দেরি হয়ে গিয়েছিল যে ব্যক্তি তিনি নন তাঁর সৃষ্ট গামলা-শায়িত মিষ্টান্নগুলির প্রতিই হষ্টেল-কন্যেরা বিশেষরূপে আকৃষ্ট ও বশীভূত ছিল!
টিনের গেটটি ঠেলে হস্টেল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই হাল্কা একটি উল্লাস ধ্বনি শোনা যেত, 'ঘোষমশাই, ঘোষমশাই...' এমন সুচারু আমন্ত্রণ সংগীতে তিনিও খানিক আপ্লুত হতেন নিশ্চিত। অতগুলো তরুণীর অমন ঐ্ক্য কন্ঠবাদনে কোন সে জিতেন্দ্রিয় পুরুষসিংহটিআছেন যাঁর হৃদয় প্রস্তরীভূত, চিত্ত অবিচল থেকে যাবে! বিচলিত তিনি হতেন নিশ্চিত নইলে চোখের সামনে নিজের সাড়ে সর্বনাশ হতে দেখেও হাস্যময় ভঙ্গিতে শান্ত দাঁড়িয়ে থাকেন কী করে?
সেই রূপোরঙ পাত্র তিনটিতে সগৌরবেবিরাজমান ভেতরে ক্ষীরের পুর দেওয়া লেডিকেনি, কালচে লালরঙা পান্তুয়া আর হালকা ঘিয়ে রঙা কমলাভোগ। সবই আকারে যথেষ্ট বড়, স্বাদে এককথায় আহা! অতুলনীয়!
তেতলা নতুন বিল্ডিংয়ের নীচতলার বাঁদিকে ছিল ডাইনিং হল। পেটপুরে রোববারের আহার সেরে বেরিয়েই গামলাবদ্ধ সাইকেল ও ঘোষমশাইকে দেখেই চিত্তচঞ্চল! সবচেয়ে আশ্চর্য ছিল হস্টেলকন্যাদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস! হয়তো ভেবেছিলেন এতবড় এক হস্টেলবাড়ি, থাকছে সব ভদ্রপরিবারের মেয়ে, তায় কলেজ-পড়ুয়া মানে দেবী সরস্বতীর সাধনায় মগ্ন, সুতরাং এসকল কন্যেরা নিশ্চিত অতীব ভালো না হয়ে যায়না। মালক্ষ্মীরা খাবেন এবং নিজেরাই সঠিক দাম দিয়ে দেবেন এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে নিজের হাতে তুলে কাউকেই তিনি মিষ্টি দিতেন না। সম্ভবত হিসেবও রাখতেন না! পাত্রগুলো পরপর সিঁড়ির ডানধারের বসবার জায়গায় রেখে, ঢাকনাগুলো খুলে নিজে একধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মেয়েরা টপাটপমিষ্টি তুলে তুলে সোজা মুখগহ্বরে চালান করে দিত। সবার আগে শেষ হয়ে যেত কমলাভোগের গামলাটি এবং একে একে অন্যদুটিও। পাত্র তিনটির নীচে পড়ে থাকত রসসিক্ত দুয়েক কুচি অবশিষ্টাংশ। সবগুলো মিষ্টি পঞ্চাশপয়সা বা আটআনা দামের। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল কমলাভোগ। একটিমাত্র কেনার সংগতি ছিল। খেয়েইদৌড়ে তেতলার রুম থেকে এনে দাম দিতাম। হাতে গোণা কয়েকজনই ছিলাম নগদের কারবারি। বাকি বেশিরভাগ কন্যেরা গবাগব খান দুই তিন নির্বিকার ভঙ্গিতে মুখে চালান করে বলে দিত, 'লিখে রাখবেন ঘোষমশাই। মাসেরটা একবারে দেব।' কেউ গা মুচড়ে বলত 'ঘোষমশাই পরের রোববার, ঠিক আছে। এখন আবার রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না' ' কত যেন হয়েছে আমার? আচ্ছা, হিসাব করে পরের দিন। অপূর্ব খেলাম জানেন। আপনার মতো কেউ এমন মিষ্টি বানাতেই পারেনা।' তিনি সব কথাতেই মাথা দুলিয়ে সায় দিতেন। নিঃশেষিত পাত্রগুলি ক্যারিয়ারে বেঁধে সাইকেল ঠেলে ধীরেধীরে বেরিয়ে যেতেন। 
সরলবিশ্বাসী সাদাসিধে স্বভাবের ঘোষমশাইকে নিয়ে নানা ধরনের হাসিমস্করার চল ছিল হস্টেলে। গামলার ঢাকনা খুলে ওনার বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা, পয়সা চাইতে না পারা, ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা, শূন্যপাত্র সমেত সাইকেল নিয়ে বাইরে চলে যাওয়া সবটা নিয়েই জোর হাসিঠাট্টা চলত।কে কতটাকার মিষ্টি খেয়েছে এবং ঠিক করে রেখেছে পরের জন্মে ঋণ শোধ করে দেবে! কে তিরিশ টাকার মিষ্টি খেয়ে দশ টাকা দিয়ে হিসাব ক্লিয়ার করেছে এবং ঘোষমশাই ধরতেও পারেনি। কে কে খেয়েই যাচ্ছে মাসদুয়েক ধরে এখন অবধি একপয়সাও ছোঁয়ায়নি, আর এমনই ক্যাবলা ওই লোক যে একপয়সাও চায়নি আজ পর্যন্ত! আসলে হিসাবপত্তর জানেনা, তাই চায়না। খালি মিষ্টি বানালে ব্যবসা চলে? হিসেব পত্তর জানা চাই, তবে না তুমি ব্যবসায়ী।
এরপর হস্টেলে ঘোষমশাইয়ের আনাগোনা ক্রমে ক্রমে কমে যেতে লাগলো, প্রথমে দুসপ্তায় একদিন তারপর মাসে একদিন তারপর খেয়াল করা গেল, উনি আর আসছেন না! পাত্র শায়িত রাজকন্যা ও সাইকেল সমেত তিনি উধাও হলেন। হস্টেলের ত্রিসীমানায় আর তাঁর দর্শন পাওয়া গেল না!
কারুর বেশ দুঃখ হল 'টাকা পাবেন তো উনি, কী মুস্কিল! শোধ দেব কীভাবে!' কেউ বেশ পুলকিত, টাকাটা শোধ দিতে হলনা। কেউ বলে, 'দারুণ ছিল রে মিষ্টিগুলো, আর পাওয়া যাবেনা?' 'ওনার ব্যবসা মালক্ষ্মীরাই চৌপাট করে দিল, হায় রে! বেচারা ঘোষ মশাইয়ের ব্যবসা তোরাই ডোবালি।' বলল থার্ড ইয়ারের দীপাদি। 'মানুষকে ঠকালে নিজেকেও ঠকতে হয় জানিস তো।' বলে মীরু। ধারাবাহিক ধার বাকিতে মিঠাই খেয়ে ঘোষমশাইয়ের ব্যবসা চৌপাট করার আরেক কারিগর মীরুর রুমমেট ডোনা বলে, 'তোর ঠাকুমাগিরি বন্ধ কর তো। কোথাকার নীতিবাগীশ এলেন রে। অত দরদ তো আমার মিষ্টিগুলোর দাম দিলি না কেন? থাম। শা আ আ...' 'আমার পয়সা নেই তাই তোর মতো রোজ খাইনি রে ডোনা। হঠাৎ একআধদিন। দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে, তাই আমি ভাত খেয়েই ঘরে চলে গেছি। সামনেই যাইনি।...তুই তো।' 'থাম ন্যাকুচন্দ্র...বেশ করেছি যা করেছি। ভাগ...' এমন সব তর্কের ঢেউ উঠল, থামল। আখেরে সাদাসিধে মানুষটি উধাও হলেন আমাদের জীবন থেকে। শুধু গামলা আর লঝঝড়ে সাইকেল সহ নাকি ব্যবসা সমেত ডুব দিলেন চিরকালের জন্য? ঈশ্বর জানেন।
বড়মাসিমা আর ছোটমাসিমা ছিলেন মেয়েদের দেখভালের দায়িত্বে। মোটাসোটা, ভারি চেহারা তাই বড়মাসিমা আর ছোটখাটো চেহারার ছোটমাসিমা। দুজনেই স্বামীহারা, থাকতেন হস্টেলেই। কিচেন, খাবার ঘর, প্রেয়ার হল সর্বত্রই ঘুরঘুর করতেন। সবাই বলত সুপার দিদির স্পাই। আসলে মেয়েদের চোখে চোখে রাখাটা ওনাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর একটু আধটু অন্যকিছুর গন্ধ পেলেই দিদিকে গিয়ে লাগানো। ওনাদের মূল কাজই ছিল এটা! মেয়েরা বাইরে গেলে সঙ্গে যেতেন লক্ষ্মণভাই বা সীতারামভাই পাহারাদার হয়ে আর অবশ্যই যেকোনো একজন মাসিমা। বাইরে বেরোলেই মেয়েরা পুলকিত, চলনে বলনে বেশ একটা চনমনে ভাব। তার ঠিক বিপরীত মুখভঙ্গি পাহারাদারগণের; অকারণ গোমড়ামুখো!
হয়তো বহির্জগতের উৎসাহী ছেলেপুলেদের ভড়কে দেওয়ার একটা কৌশল! আবার এও শুনেছি খুউউব গোপনে নানা উপহার বা ঘুষে ছোট মাসিমাকে হাত করে, তাঁর আঁচলের আড়ালে দু'একজন বোর্ডার চিঠিপত্তর দেয়া-নেয়া করে! দু চারটি বেশ চালাকচতুর কন্যে ছিল, কলেজ ফেরৎ মাসিমাদের ঘরে গিয়ে ভাত খেত। সেখানে নাকি ভাত-ডাল-সব্জি পাওয়া যায়। জানিনা কীভাবে ম্যানেজ করত, বন্ধু হয়েও তারা সে গোপন কথাটি কখনো বলেনি। বরং সেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে, টিফিনের জন্য আমাদের হল্লা চলছে, মাসিমাদের ঘর থেকে পেটপুরে খেয়ে আসা মেয়েরাও বেশ গলা মেলাত, ‘ও লক্ষ্মণ ভাই, আজ টিফিন দেবেনা নাকি? আজকেরটা কাল দেবে? কী করছ? ধুউর ভাল্লাগে না। কখন থেকে ডাকাডাকি করছি, কানে কালা নাকি?' সকাল ন'টা সাড়ে ন'টায় ভাত খেয়ে বিকেল পাঁচটা পেরিয়ে পেটে ছুঁচোর কীর্তন তখন। কিন্তু বিকেলের টিফিন আর দেয়না!তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুই ঠাকুরভাই, দুই মাসিমা চায়ের কেটলি আর টিফিনের বালতি,গামলা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসত।'ছেলেদের হস্টেল হলে বুঝতে মজা' বলি। রোজই একই কান্ড কিন্তু তেমন জোরদার প্রতিবাদ নেই!
হস্টেল প্রসঙ্গে কত মজার স্মৃতি জমে আছে! অনেকেরই যেমন থাকে। একবারআমাকে ডাক্তারের কাছে চোখ দেখানোর চশমা করানোর জন্য সেদিন আর সময় পান নি আমার মা, ফিরতি বাসের তাড়া থাকায় প্রেসক্রিপসন আর টাকা সুপার ম্যাডামের হাতে দিয়ে গেলেন। সীতারাম ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে চশমার দোকানে পাঠালেন সুপার দিদি। ভাইয়া,দিদির খুব বিশ্বস্ত এবং সীমান্তের সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো মেয়েদের চোখে চোখেরাখে। বড়মাসিমা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন কোনো কারণে। ছোটমাসিমা পায়ের পাতায় চোট পেয়েছেন, হাঁটাহাঁটি প্রায় বন্ধ সুতরাং সীতারাম ভাই, তিনি হস্টেলের প্রহরী।দীর্ঘকায়,কৃষ্ণবর্ণ, পাতলা হিলহিলে, লম্বা নাক আর বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখের সীতারামভাইয়ের সঙ্গে চললাম চশমার দোকানে। আমি রিক্সায় আর টিংটিং করে বেল বাজিয়ে আমার পেছনে সাইকেলে ভাই। সে ভারি অস্বস্তিকর যাত্রা! মনে হচ্ছে যেন সারা দুনিয়ার লোক নিজেদের খাওয়া দাওয়া, কাজকম্ম ফেলে আমাদের দিকেই চেয়ে আছে! মেইন বাজারের পৌঁছে রাস্তার ডান দিকে পাশাপাশি দুটো চশমার দোকান, সেখানে ঘড়িও পাওয়া যায়। প্রথমটিতে ঢুকে পড়ি, পেছনে সতর্ক প্রহরী ভাইয়াজি। তাঁরা ফ্রেম দেখায় সামনের গোল আয়নায় স্বমুখশ্রী দর্শন করি আবার অদূরে দন্ডায়মান সীতারাম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি, 'দ্যাখো তো, ঠিক হ্যায়?' যেটাই পরে দেখাই তাতেই ভাইয়া ব্যাজার মুখে হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়ে। সম্ভবত জীবনে এই প্রথমবার ভাইয়াজি এমনতর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। মনে মনে খুব খুশি হচ্ছিলাম, ব্যাটা পাহারাদারজিকে বিরক্ত করে।
খানিকবাদে সীতারাম ভাইয়া বুঝে যায়, চশমার ফ্রেম পছন্দ করা কাজটি কঠিন এবং অনেক সময় নেবে। বলে, 'দিদি তুম পসন্দ কর লো, ম্যায় দো মিনিটমে আতি হু দুসরা কাম করকে। ইহা পে রহ, কাহি মাত যানা হাঁ।' বড় করে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাতে ভাইজি সাইকেল নিয়ে সাঁ সাঁ করে কোথাও যায়। রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যেতেই 'দাঁড়ান একটু আসছি' বলে বেরিয়েআসি আর মাঝের ছোট্ট ওষুধের দোকান পেরিয়ে পরের চশমার দোকানে ঢুকে পড়ি। খানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কেজানে কেন একটি চৌকো ঢাউস আকারের কালো ফ্রেম পছন্দ হল। প্রেসক্রিপশন, এডভান্স সব মিটিয়ে রাস্তার দিকে নজর করি এবার। হায় কী দৃশ্য! সীতারাম ভাই অবিশ্রান্ত টিং টিং টিং বেল বাজিয়ে দোকানের ডানদিকে ছুটে যাচ্ছে সাঁ সাঁ সাইকেল চালিয়ে। 'এই যে আমি এখানে' মৃদুস্বরে ডাক দিই, কিন্তু সে শুনতে পায়না। মিনিট দুয়েক বাদেই আবার তাকে দেখা যায় একই গতিতে সে দোকানের সামনে দিয়ে বাঁদিকে ছুটে যাচ্ছে। গতির তাড়নায় সামনে ঝুঁকে সাইকেল চালাচ্ছে, বিপরীতমুখি হাওয়ায় তার দীর্ঘ টিকিটি পতপত করে উড়ছে, সঙ্গে অবিশ্রান্ত টিং টিং টিং টিং! 'ও সীতারাম ভাই, এই যে এই যে' দোকানের সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে ডাকলেও সে শুনতেই পায়না! দোকানদার জিজ্ঞেস করেন, 'কী হইচে?' সামনে দিয়ে আবার ডানদিকে ছুটে যাওয়া সীতারামভাইকে দেখিয়ে বলি, 'উনি আমার সঙ্গে এসেছেন হস্টেল থেকে, আমাকে খুঁজছেন। তাই...' প্রথমদিকে ভাইয়ার ছোটাছুটির দৃশ্য যতটা আনন্দ দিচ্ছিল পরে আর তা রইল না। দোকানের কর্মচারী সমেত মালিক ভদ্রলোক সিঁড়িতে এসে দাঁড়ান। হৈচৈ ডাকাডাকিকরে সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটন্ত সীতারাম ভাইকে থামাতে সক্ষম হন ওনারা। আমাকে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সীতারাম ভাইয়ের ধরে প্রাণ ফিরল মনে হল। চাকরি গেল না, থানা পুলিশ হল না। জয় রাম জি।
কোনও প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাইনি, চশমার ভালো ফ্রেমের খোঁজে অন্য দোকানে এসেছি, এটুকুই যা দোষের! ব্যাপারটাবুঝে এবং বিপদমুক্ত হয়ে সে আশ্বস্ত হয়। অনভ্যাসের হাসির রেখা ফোটে তার শুকনো মুখে। আবার রিক্সা, রিক্সার অনুসরণরত সাইকেল ও টিং টিং ধ্বনিমুখরিত আমরা হোস্টেলে প্রত্যাবর্তন করি। মন ফুরফুরে, মাত্রা ছাড়ানো মজা ও তৎসংক্রান্ত ভয় উদ্বেগ কেটে গেছে ততক্ষণে। রিক্সা থেকে নেমে গেটের দরজায় হাত রাখতেই সীতারামভাই পেছন থেকেবলে ওঠে, 'দিদি, সুপার ম্যাডামজিকো কুছ মাত বোলিয়ে, বহৎ গুসসে মে রহতেহ্যায় উও। কাম মে বিজি রহতে হ্যায়। মাত বোলো কুছ দিদি।'
'না না চিন্তা নাই। কী আবার বলবো' মনে ভাবি, বেশ হয়েছে, এক রাস্তায় দশবারচক্কর কেটেছে ব্যাটা রামভক্ত হনুমান! টিকিটা একেবারে উড়ে গেলেই বেশি খুশি হতাম। নালিশ করা, কথা লাগানো, সারাক্ষণ চিলের মতো মেয়েদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা! আজ ব্যাটা মজা টের পেয়েছে।আত্মতুষ্টির সুখ।
একবার হস্টেলে নিজের ছোটবোন ভারতীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক। একবছরের জুনিয়র চা বাগানের মেয়ে ভারতীর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব ছিল। বাড়ি থেকে খাবার পাঠালে, ভাগ পেতাম। পুজোয় শখ করে কাচের চুড়ি কিনেছে তো আমার জন্যেও এনেছে। ভারি নরম মনের মেয়ে সে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ একটু আধটু কবিতা বা গল্প লিখে বা কিছু এঁকেটেকে ওকে দেখাতাম। প্রিয় মেরুন রঙের ডাইরিতে আমার ইচ্ছেডানার ইচ্ছেমতো ওড়াউড়ি চলত। মাঝেমধ্যে ভারতীও এমনই দু'চার পংক্তিকিছু লিখত। সবই ছিল ভাললাগার আর মজা। আমাদের দুতিনজনের মধ্যেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ। একতলায় থ্রি-সিটেড রুমে ওরা থাকে আমরা তিনতলায় ডাবল বেডেড রুমে। ওর লেখার খাতা কখনো আমার কাছে, আমারটি কখনো ওদের রুমে। তা একবার ওর কলকাতা প্রবাসী খ্যাতিমান লেখক মেজদাদা হস্টেলে এলেন বোনের সঙ্গে দেখা করতে। একটা আলোড়ন চারধারে। সিনিয়র দিদিরা বা অন্যান্য দু'চারজন ভিজিটর্স রুমে গিয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ করছে, প্রণাম করছে, কেউবা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমি উঁকি দিয়ে একবার দেখে এলাম। শ্যামলা রঙের, কোঁকড়াচুলো, হাল্কারঙা সার্ট পরা দাদাটিকে। আলাপ করার বাসনা থাকলেও সামনে গেলাম না লজ্জায় বা অকারণ সংকোচে! ওই ভারতী একটা কান্ড করে ফেলেছে ততক্ষণে!আমার লেখার খাতাটি দাদার হাতে দিয়েছে এবং উনি পাতা উল্টে পড়ছেন, দেখছেন। এরপর উনি ডাকলেন, 'যা ডেকে আন বন্ধুকে, একটু কথা বলি। বেশ লিখেছে। হুম।' ভারতী খুশিতে ডগমগ হয়ে এধারের বারান্দায় খানিক রেগেমেগে দাঁড়িয়ে থাকা আমার হাত ধরে টানে, 'চল চল দাদা কথা বলবে, ডাকছে তোমায়।' ' তুই ডাইরিটা দিলি কেন? ছিঃ, আমার খুব লজ্জা লাগছে, আমি যাবই না। কিচ্ছু হয়নি ওসব পচা লেখা কেন দেখালি? ভারতী হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে চায়; হাত ছাড়িয়ে একদৌড়ে তেতলায় পলায়ন করি।
কতকাল আগের কথা, কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। মাননীয় সেই লেখক অজস্র গল্প, নাটক, স্মৃতিকথা, ভ্রমণআখ্যান, উপন্যাস লিখেছেন; দেশে বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর রচনারপটভূমিতে বিরাট স্থান করেনিয়েছে উত্তরবঙ্গ, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চা-বাগান, চাবাগানের মানুষ, জনজীবনকে লেখা উপন্যাসগুলো পাঠকপ্রিয় হয়েছে। বইমেলায় এখনো তাঁর বইয়ের বিক্রি বহু খ্যাতিমানলেখকদের চাইতে কোনও অংশে কম নয়।
এতকাল পরে ভাবি কেন সেদিন অকারণে রেগে গেলাম ভারতীর ওপর! কেন ভদ্রতার, সৌজন্যের তোয়াক্কা না করে, একজন বরিষ্ঠ মানুষের ডাক উপেক্ষা করে পালিয়েছিলাম! ওনার পরামর্শ নিলে নিজেরই তো উপকার হত। কেন এমন যুক্তিহীন অদ্ভুত আচরণ! আত্মবিশ্বাসের অভাব?
কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পাঠরত একটি মেয়ে... সাহিত্য পড়ছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ছে, গান গাইছে, শুনছে, আবৃত্তি করছে, খেলছে, অন্যভাষার পাঠ নিচ্ছে কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের, সৌজন্যের, ভদ্রতার পাঠ কি তার আদৌ নেওয়া হয়েছে? এটা কেন? কী কারণে? আত্মবিশ্বাসের অভাব? মর্যাদাবোধের অভাব! এডুকেশন শেষ হবার পরেই যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কর্মময় জগতের কঠিন যুদ্ধে সেখানে এমন পলায়নপর, অমিশুকে, দুর্বল মনোবৃত্তি নিয়ে কোনো কাজে কি সফল হওয়া যায়?
এসব ভেবেছি জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে। আরও ভেবেছি মেয়ে-হস্টেলের যুক্তিহীন শাসন, পারিবারিক অযৌক্তিক, অনাবশ্যক সংস্কারগুলো জীবনে কোন কাজে লাগলো? এই যে হস্টেলের মাসিমা বা গার্ডদের সদা সতর্ক, সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, নানান বিধি আর অদৃশ্য শৃঙ্খলের বাঁধনে আবদ্ধ থাকা, কিছুই কি স্বাভাবিক? সুন্দর?স্বচ্ছ, আত্মবিশ্বাসী সবল মনটি গড়ে উঠবার অনুকূল আবহাওয়া কি প্রবাহিত হত সেই হস্টেল প্রাঙ্গণে? 
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
