 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 অভিযান সাহা
                                            
                                                
                                                অভিযান সাহা
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        এক চা-বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের রাস্তায় একটা বোর্ডে লিখেছেন "Elephant friendly zone, এখানে হাতিদের আনাগোনা ও পারাপারের রাস্তা, তাদের বিরক্ত করবেন না”। এত বড় বোর্ড যে অনায়াসে সবার চোখে পড়ে, খবরের কাগজে যায়, দেশ-বিদেশ থেকে কত রথী-মহারথীরা আসে দেখবার জন্য। মানুষ জানে, বোঝে, একে ওপরকে বলাবলি করে, "বাগান মালিকের তুলনাই হয় না, আমাদের কথা ভাবে, হাতিদের কথা ভাবে।"
সেই রাতে হাতিরা আসে, শুঁড় দিয়ে বোর্ডটিকে ছোঁয়, কিন্তু তাতে লেখা ভাষা তাদের মাথায় আসে না। আবার আপন মনে রাস্তা ধরে চলে, গন্ধ নেয় অন্য হাতির, গন্ধ পায় গোবরের। অবশেষে প্রশ্ন করে নিজেকে, "আমার পরিবার কি এই রাস্তায় গিয়েছে ?"
হ্যাঁ, গিয়েছে, আর তাদের যেতেই হবে, কারণ অতীতের খয়ের, জারুলের জঙ্গল এখানে নেই, এখানে এখন তিন ফুটের ছোটো ছোটো সাজানো ঝোপ।
“এরকম ঝোপ তো মায়ের সাথে ছোটবেলায় দেখিনি। তাতে কেমন এক বিশ্রী, উগ্ৰ গন্ধও বটে। আমার জঙ্গলে এমন কোন গাছে এরম গন্ধ নেই। দ্রুত পা চালাই, আর কিছুদূর এমন গন্ধ হজম করলেই আমার চেনা খয়েরের জঙ্গল পাব। গত রাতে আমার মা এই রাস্তায় গিয়েছে আমার নতুন বোনকে সঙ্গে নিয়ে।
“চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার, ঝিরঝির বৃষ্টিও শুরু হয়েছে, এখানে যদিও ঝি ঝি পোকার ডাক নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কীসের এত আওয়াজ ? সে্কী! মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছি মনে হয়। আমাকে দ্রুত যেতেই হবে। এই অচেনা তিন ফুটের জঙ্গলে কত বড় বড় গর্ত, অনেকটা সরু নালার মত, খুব চাপা। এগুলোকে নাকি "চা-নালা" বলে। আমার বড় বড় থামের মত পা এই নালা ভেঙে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর আমি তাই করলাম। উপায় নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মায়ের কাছে যেতেই হবে।
“এভাবেই কিছুটা এগিয়ে দেখি, মা সামনেই শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আমায় ইশারা করছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। সামনে যেতেই দেখি মায়ের চোখে জল, মা'কে স্পর্শ করতেই বুঝতে পারলাম খুব একটা বড় বিপদ হয়েছে। আসলে আমাদের সমাজে স্পর্শ দিয়েই আমরা মনের ভাব বিনিময় করি। গতরাতে আমার ছোট বোনটা ঐ রকম এক চাপা চা-নালায় পড়ে গেছে, উঠতে পারছে না। চারিদিকের মাটি ধ্বসে পড়েছে। তাই আমাদের কেউ সাহস করতে পারছে না তাকে টেনে তোলার। এই কঠিন বাস্তব বোঝার মতো যে কেউ নেই। এই বৃষ্টির রাতে বাগানের মালিক তার পোষ্যকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
“বলতে বলতেই দূরে কারা যেন সাদা টর্চ এর আলো জ্বেলেছে। ওই যে, ওই যে আবার সেই মানুষের দল। আমরা মনে হয় আর ঘরে ফিরতে পারবো না। নাকে এল হালকা বারুদের গন্ধ, হ্যাঁ এদিকেই আসছে যে। ওরা কারা, খাকি পোষাক পরে দল বল নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে একটা গাড়িও দেখতে পাচ্ছি। এই তীব্র বারুদের গন্ধে আমার পরিবারের বাকি সবাই জঙ্গলের পথ ধরেছে। তবে আমি আমার বোনকে ছেড়ে যাবো না। আমার মাও তাই, আমরা দুজনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
“কিন্তু এই মানুষগুলো যে আমাদের দিকেই পটকা ছুড়ে চলেছে অনবরত। সর্বনাশ, এবার কী হবে? এ যে মারাত্মক। কদিন আগেই পাশের গাঁয়ের লোকজন এই পটকা আমার শুঁড়ে মেরেছিল, তার ক্ষত এখনও মেটেনি। মাকে নিয়ে বাধ্য হয়েই জঙ্গলে ফিরে গেলাম, জঙ্গলে সবাই আমার বোনের জন্য উদগ্রীব, মা কেঁদেই চলেছে। দূর থেকে বোনের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কিছু মানুষের হৈ হুল্লোড় , গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ, আরও কত কী। কিছুই যে বুঝতে পারছি না। চোখের সামনে আবার একটা হেরে যাওয়ার ভোর হতে চললো।
“অবশেষে বৃষ্টি থামলো, হঠাৎ করে মা জঙ্গল থেকে বেরিয়েই হাঁটা দিল সোজা বোনের দিকে। মায়ের পেছন পেছন আমিও চললাম, লোকজন আর দেখতে পারছি না, বহুদূরে সেই খাকি পোষাক পরা লোকগুলো দাঁড়িয়ে! কিন্তু এ কী, আমার বোন যে সোজা নালা থেকে উঠে পড়েছে, কাদামাটি গায়ে মায়ের দিকে দৌড়ে আসছে। আনন্দে আটখানা, মাকে সামনে পেয়ে সবার আগে সে প্রাণভরে দুধ খেল। আমিও সামনে গেলাম, দলের বাকি কয়েকজন সারিন দিদিরাও এগিয়ে এল। সবাই আমার বোনটিকে পেয়ে এতটাই খুশি যে বলে বোঝাতে পারছে না। আসলে আমাদের সমাজে তো ছোট বাচ্চারাই সবকিছু। তাদেরকে ঘিরেই তো এই সমাজ, নাহলে কে বয়ে নিয়ে যাবে আমাদের উত্তরসূরীর শিরোপা।
“নেহাত রক্ষা যে আমার পরিবারে এখন কোন সাহানীয়া গুণ্ডা নেই, নাহলে আমার বোনটাকে দলে নিতেই চাইতো না। কারণ ওর গায়ে অল্প হলেও মানুষের গন্ধ লেগেছে। শুনেছি আমাদের মতো এমন অনেক হস্তি পরিবারকেও তাদের সদ্যোজাতকে নিয়ে ভুগতে হয়েছে। কেউ নালায় পড়ে গিয়ে চিরতরে পৃথিবী থেকে চলে গেছে, কেউ তার মা ও আত্মীয়স্বজনদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে আজীবনের জন্য।
“সেই দিন থেকেই এই খাকি পোষাকের লোকগুলোর সাথে আমাদের ভালো পরিচয় হয়ে গিয়েছে। যাক, বিপদে বাগানের মালিকের দেখা না পেলেও, খাকিরা ঠিকই ঝড়জল পেরিয়ে আমাদের জন্যই এসেছে। তারপরেও এদের বহুবার দেখেছি। বিভিন্ন কারনে মাঝেমাঝে রেষারেষি হয় ঠিকই, কিন্তু এরা সেই মানুষগুলোর চেয়ে ভালো, যারা আমাদের পায়ে চলার পথে বড়বড় গর্ত, নালা নিজের ফায়দায় খুঁড়ে রেখেছে।”

মানুষের ভাষায় হাতির এই কাল্পনিক আত্মকথার অবতারণা। মানুষের অবরোধে হাতির দল চা-বাগানে আটকে পড়েছে, এ খবর হামেশাই শোনা যায়। ধান কিংবা ভুট্টার মরসুমে নিত্যদিনের ঘটনা। আসলে সমগ্ৰ উত্তরবঙ্গ জুড়ে চা বাগানের অবিন্যস্ত বিস্তারের ফলে বাদ যায়নি হাতিদের যাতায়াতের রাস্তা থেকে শুরু করে বিচরণভূমিও। হাতিদের জীবনধারায় হাতিরা কখনোই একই জায়গায় স্থায়ী থাকতে পারে না। দৈহিক ও জৈবিক চাহিদায় তাদের দলবল, সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় বন-বনান্তরে। কারণ, পেটের টান যে মারাত্মক, এত বড় সংসার, এক জায়গায় থাকলে খাবে কী? আজ এই জঙ্গল, কাল ওই জঙ্গল, এই করেই বছর ঘুরে যায়। ততদিনে গাছপালা আবার নতুন করে সতেজ হয়ে ওঠে, মাটি হয়ে ওঠে উর্বর, গুবরে পোকারা অর্ধপাচ্য বীজ ছড়িয়ে দেয়, একটা পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়া চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। হাতিরা তাদের চলার পথ, ঘর, পরিবার, চারপাশের জগৎ কোনো কিছুই স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে যেতে দেয় না। ফুটফুটে বাচ্চার জন্মের পর থেকেই হাতি সমাজের রীতিনীতি তাকে শিখিয়ে দেয় দলে তার সঠিক অবস্থান ও উদ্দেশ্যে। এমন শৃঙ্খলা সমাজের সব পশু জগতে থাকে না বললেই চলে। এমনকি মানব সমাজেও না।
একটি হাতির চোখে তার নিত্যদিন মানে বেঁচে থাকবার লড়াই। না, শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সবার আগে মেরুদন্ড শক্ত করে নিজের পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। এসব না বোঝারই কথা, এত বড় একটা প্রাণী, তার মাথায় আবার এত কিছু চলে? হ্যাঁ, চলে বটে, এই জন্যেই তো সে হাতি। "হাতিরা কি ত্যাগ করে"? হ্যাঁ করে, নাহলে কেউ বাচ্চাদের আগলে রাখতে গিয়ে সপরিবারে লোকো পাইলটের হাতে প্রাণ দেয় না! আরও বলছি - হাতিরা সত্যিই ত্যাগ করে এবং করতে শিখেছে পরিস্থিতি থেকে। প্রতিদিন যখন হাজার হাজার বৃক্ষ প্রাণ দেয়, তখন এক শ্রেনীর জীব খুশি হলেও হাতিরা কিন্তু দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে শুধু কাঁদতেই পারে, সকলের সামনে লোক দেখিয়ে নয়। সেই নীরব কান্না অবশেষে জঙ্গলের মাটিতেই মিশে যায়। একটি সদ্যোজাত বাচ্চা তার মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মানব সভ্যতার প্রকৃত ধ্বংসলীলা। তার চোখে জল এলেও, আমরা তাকে বলি "হার্ডেরিয়ান গ্রন্থির নিঃসরণ"।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
