বিষুব রেখা থেকেই আসে বিষু, বিহু, বিঝু, বৈষু, বৈষি নামের নানান উৎসবের নাম। সব কয়টাই এই সময়ের ঋতু পরিবর্তন জনিত কৃষিভিত্তিক সমাজের কৃষিজ সংস্কৃতির নানান রূপ। একটু ভালো করে দেখলেই সব কয়টাকেই এক সূতায় বেঁধে নেওয়া যায়।
সৌর পঞ্জিকার যে দিনও গননা তাতে পৌষ সংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে আর চৈত্র সংক্রান্তিকে বলা হয় মহাবিষু, আড় বিষু । পৌষ শীতকাল। সে সময়ে সূর্য হেলে থাকে দক্ষিণে, সেখানে আছে কল্পিত মকরক্রান্তি রেখা, আর চৈত্রে সূর্য তাঁর আড় ভেঙ্গে উঠে আসে মাথার ওপরে, অর্থাৎ বিষুবরেখায়। বাঙ্গালীরা, এই ত্রিপুরাতেও চৈত্র সংক্রান্তি পালন করে থাকেন দুই দিনে। চৈত্রের শেষ দিনের আগের দিনটি হয় আড় বিষু। আড়চোখ যেমন তেমনি সেই দিন পর্যন্ত সূর্য খানিক ঢলে থাকে, আর তাঁর পর দিনেই সূর্য উঠবে মাথায়। চৈত্রের শেষ দিনটি তাই মহা বিষু।
পৃথিবীর এই ঘুরে চলায় আমাদের ঋতু পরিবর্তন সামনে আসে। আদিম কৃষিব্যবস্থার জুম চাষে তাই ত্রিপুরায় গড়িয়া পূজা হয়ে উঠে বীজ বোনার শুভক্ষণ। এখানে সব উৎসব মুখরতা উর্বরাশক্তির পূজামুখী। চাকমাদের বিঝু উৎসব হয় তিন দিনের। বাঙ্গালীদের আড়বিষুর দিনে চাকমাসমাজে হয় ফুল বিঝু, এর পরদিন মূল বিঝু আর বৈশাখের প্রথমদিনে গাচ্যপাচ্য বিঝু। প্রথম দিনটি নদীতে ফুল ভাসানো হয় ইশ্বরের উদ্দেশে। মূল বিঝু মানে শাঁক-পাতা –ওশুধি র পাচন খাওয়া। শেষদিনে খাওয়া দাওয়া, হৈ হুল্লোড়ের উতসব মুখরতা। এই সময়ে চাকমা সমাজে যুবকযুবতিদের অবাধ মেলামেশা আর জীবন সঙ্গী বাছাইয়ের সময় বলে ধরে নেওয়া হত প্রাচীন সমাজে।
প্রায় একই রকম ভাবে প্রায় কাছাকাছি উপাচার, উপকরনে ত্রিপুরী সমাজে বিষু উৎসব হয়, রিয়াং সমাজে হয় বৈষি, উচই সমাজ বলে থাকে বৈষু। মগ সমাজে এই সময় সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম বিষয় হল ছেলে ও মেয়েদের নানান দল এক এক করে একে অন্যের দিকে জল ছুঁড়ে মারবে। প্রতিযোগিতামূলক এই খেলা ভারতের বাইরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানা দেশেও জনপ্রিয়। বৈশাখের সাত তারিখে ত্রিপুরার বৃহত্তর উপজাতি সমাজ সাত দিনের টানা গড়িয়া উৎসবের সমাপ্তি ঘটায় এবং বৃষ্টির অপেক্ষায় জুমে বীজ রোপন শুরু করবে। চৈত্রেই জুম পাহাড় পোড়ানো শেষ হয়ে যায়। ক্ষেত তৈরি করে এই অবসরে তাঁরা উৎসবে মেতে থাকবে অন্তত সাতদিন।
সেদিক থেকে ত্রিপুরার গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন শুরু হয়ে যায় একমাস আগে থেকে অর্থাৎ চৈত্র শুরু হলেই মাঠে নামে গাজন আর চড়কের শিব গৌরী। বাঙ্গালীর লোকায়ত ধর্ম যা এখনো নব আর্য সংমিশ্রণ এড়িয়ে খানিকটা হলেও টিকে আছে সে গুলির তালিকায় গাজন অন্যতম একটি। বলা হয়ে থাকে আদি অস্ট্রিক যে সভ্যতা তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধ মহাযান মতের তন্ত্র সাধনা এবং শৈব সাধনার সংমিশ্রণ ঘটেছে গাজন চড়কে। চড়কের দিন সন্ন্যাসীদের বড়শিতে গেথে চড়ক গাছে ঘুরানো, শরীরের নানান জায়গায় শিক গেঁথে দেওয়া, আগুনের ওপর দিয়ে দৌড় করানো -- এই খেলাগুলি তন্ত্রসাধকদের আত্মনির্যাতনের পরম্পরা। তথাকথিত আধুনিক, ভদ্রবিত্তরা এই উপাসনা পদ্ধতিকে আত্মহত্যার মতন নিষেধের নৈতিকতায় গুলিয়ে দেয় বলে বিষয়টি অন্ত্যজ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। এতে সুবিধা হল নাগরিকতার বিলাসী ছোঁয়ায় একেবারে হারিয়ে যেতে পারছে না।
ত্রিপুরার গ্রামগঞ্জের এই সময়ের উৎসব চড়কের মেলা অনেক জায়গার সাতদিনও লম্বা হয়ে থাকে। শহর যখন বর্ষবরণ আর বর্ষবিদায়ী কেতাবী নাম দিয়ে চৈত্রের শেষদিনে রাত বারোটায় বাজি পটকা ফাটায় গ্রাম কিন্তু ব্যস্ত থাকে শুধু চড়কে, গাজনে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team