এক বেলা মাছ না হলে যে ভেতো বাঙালির রসনা সঠিক পরিতৃপ্তি লাভ করে না সেই বাঙালির হুঁশই নেই যে তার মধ্যাহ্নকালীন ভোজনের পাত থেকে অনেক চেনা সুস্বাদু মাছই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যারা আজও অন্ধ্র বিহারের চাষের বরফ দেওয়া মাছের চাইতে উত্তরের নদিয়ালি ছোট মাছের কদর করেন বেশি তাঁরা জানেন এই চিত্রটা শুধু যে নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ তেমনটা নয়, মালদার পুনর্ভবা বা বালুরঘাটের আত্রেয়ী, উত্তর দিনাজপুরে মহানন্দা অথবা কোচবিহারের তিস্তা-তোর্সার সামগ্রিক চিত্রটা মোটামুটি এক। নদীমাতৃক বাংলায় মাছের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য থাকাটাই স্বাভাবিক তবে দিনাজপুরেও যে তার ব্যাতিক্রম ছিল না আমরা সেকথা F.W. Strong সাহেবের Eastern Bengal District Gazetteer DINAJPUR এই ভৌগলিক বিবরণী পড়লেই জানতে পারি সেখানে উল্লেখ রয়েছে—Dinajpur was at-one time famous for its fish and was known in the Mahabharata as Matsya Desha, or the fish country.
উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় মাছ বলতেই সকলে একবাক্যে বোরলি মাছের নাম করেন তার স্বাদুতার জন্য, তবে আত্রেয়ীর রাইখোর মাছ, সোনালী আড়ও যে তার স্বাদে গুণে কোনও অংশেই কম যায় না তা বলাই বাহুল্য । রাইখোর মাছ এ দেশেই শুধু নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। রাইখোর মূলত রুই জাতীয় ছোট মাছ বিশেষ । বৈজ্ঞানিক নাম Cirrhinus reba তবে ইংরেজিতে Reba Crap নামেই পরিচিত । স্হানীয় ভাষায় এই মাছকে রাইক, টাটাকিনি ইত্যাদি নানান নামে ডাকা হয়। এই প্রজাতির মাছের দৈর্ঘ্য সাধারনত ২৫ সেমি থেকে ৩২.৫ সে.মি। আপাতভাবে দেখলে বাটা মাছের মতো মনে হলেও এই মাছের পৃষ্ঠদেশ কালো এবং পাখনায় কালো দাগ বর্তমান, অঙ্কীয় দেশে শ্রেনী পাখনা ও পায়ু পাখনায় কমলা রঙের দাগ দেখা যায়। আঁশের আকৃতি ষড়ভূজ। রুই প্রজাতির মিষ্টি জলের মাছ হলেও এদের বৃদ্ধি রুই মাছের মতো দ্রুত হারে হয় না। সাধারণত বর্ষার শুরুতে এ মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পায়, মূলত নদীর মাছ হলেও বর্ষার শুরুতে মূল নদী থেকে প্লাবিত হয়ে নদীর অগভীর খাতে বা জলাশয়ে এসে এরা প্রজনন করে থাকে। প্রজনন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সময় ভোর ও সন্ধ্যা। রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছের মতো এ মাছের চাষ না হলেও তাদের সাথে মিশে এরা চাষ করা পুকুরে, খালবিলে চলে আসে। কৃত্রিম উপায়ে চাষ না হওয়ার কারণে এবং এর স্বাদুতার জন্য এই মাছের চাহিদা প্রচুর। বর্তমানে এ মাছের বাজার মূল্য কিলো প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, তবে যোগান অনুযায়ী দামের হেরফের হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত এ মাছের কমবেশি দেখা মেলে তবে পূজা পরবর্তী সময়ে কিছুটা বেশি পরিমাণে জালে ধরা পড়ে।
অনুপযুক্ত পরিবেশের কারণে, খামখেয়ালি ভাবে প্রকৃতির চারিত্রিক বদল ঘটায় অনেক মাছই বিলুপ্তির পথে সেই তালিকা থেকে রাইখোরের নাম বাদ যায় না। তবে একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে খাবার পাতে যেমন মাছ ছাড়া বাঙালী অসম্পূর্ণ তেমনি মাছ ছাড়া বাঙালীর সংস্কৃতি অসম্পূর্ণ। তাই বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানে মাছের ভূমিকা কম বেশি থাকেই। বাঙালীর আবেগের সাথে মাছ কোথাও যেন একীভূত হয়ে গিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ঠিক তেমনই দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের প্রায় ৩৫০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী গৌরী পাল বাড়ির দুর্গাপূজাতে ঘরের মেয়ে উমাকে বিদায় জানানো হয় আত্রেয়ী নদীর রাইখোর ও বোয়াল মাছ এবং পান্তা ভাত সহযোগে ভোগ নিবেদন করে। এই প্রথার মধ্য দিয়ে দেবী উমা কোথায় যেন সত্যি সত্যি বাঙালীর ঘরের মেয়ে উমা হয়ে উঠেছে। মা ঠাকুমার হাতের রান্না করা রাইখোরের নানান পদ পরবর্তী প্রজন্ম আস্বাদন করতে পারবে কিনা জানি না তবে সব কিছু ছাড়িয়েও ঈশ্বর গুপ্তের ‘তপসে মাছ’ কবিতার দুটি পংক্তি এ প্রসঙ্গে বার বার বলতে ইচ্ছে হয় –
“না করে উদর যেই তোমায় গ্রহণ
বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন।”
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team