পরিকল্পনা না থাকলে কৃষিতে যে কখনই সাফল্য বা উন্নতি আসতে পারে না তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান মিলছে কোচবিহারে। রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ দেখানো যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে এই জেলায়। এবছরও সেই চিত্রের কোনো ব্যতিক্রম হল না। পরিকাঠামোর অভাব, সঠিক নীতি বা পদ্ধতির অনুপস্থিতি কৃষকদের প্রতি বছর চ্যালেঞ্জের মুখে এনে ফেলছে। যার প্রভাব পড়ছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। বিশেষ করে যে ধরনের অর্থকরী ফসল কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারে তা বার বার অধরাই থেকে যাচ্ছে কৃষকের কাছে। আর এর পেছনে রয়েছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। আরেকজন যেটা করছে, আমাকেও সেটাই চাষ করতে হবে, এই ধারনা থেকে তারা বাইরে আসতে পারছে না। আর এর ফলে প্রতি বছর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে এই জেলায়।
সরকারের তরফ থেকে জেলার কৃষি আধিকারিকরা প্রতি ব্লকে ব্লকে গিয়ে সরাসরি কৃষকদের সাথে কথা বলা, তাদের চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা, চাষের নতুন নতুন যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করানো সবই করে থাকেন। এবার কৃষক কতটা তাদের পরামর্শ নেবেন, সেটা তাদের ব্যাপার। কারণ নিজের জমিতে কৃষক কী চাষ করবেন সে ব্যাপারে সরকার কখনই জোর করতে পারে না! এই সাম্প্রতিক মন্তব্য এক কৃষি আধিকারি্কের।
এক বছর আগে ঠিক এই সময় হৈ হৈ করে আলু উৎসব হয়েছিল কোচবিহারে। অনেক আশার বাণীও শোনা গিয়েছিল সেই উৎসবে। যেমন, কোচবিহারের আলুকে বিশ্বমানের করে তোলা হবে। জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত আলু যাতে বিদেশে রপ্তানি করা যায়, সেই চেষ্টা করা হবে ইত্যাদি প্রভৃতি। দক্ষিণবঙ্গে আলুর ফলন তেমন ভালো না হওয়ায় উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানি করে সেবার লাভের মুখ কিছুটা দেখেছিল আলু চাষি। গতবছর ৩৩৫০০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল ৯ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয় প্রয়োজন ৬-৭ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি নয়। বাকিটা বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত আলু বাইরে বিক্রি করে জেলার গ্রামীন অর্থনীতির কোনো উন্নতি ঘটে কি? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। গতবারের লাভ দেখে কৃষি দপ্তরের সাবধানতা সত্ত্বেও এবছর আরও বেশি (৩৫১০০ হেক্টর) জমিতে তারা আলু চাষ করে। ১১ লক্ষ মেট্রিক টন আলুর ফলন হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই দাম পড়ে যায়। অবশেষে মাত্র ৪.৫০ টাকার জায়গায় সরকারি মধ্যস্থতায় তারা ৬.৫০ টাকা/কেজিতে মাঠ থেকে আলু বিক্রি করতে পারে। অপর্যাপ্ত হিমঘর, বন্ডের কালোবাজারি, অনিয়ন্ত্রিত আলুর বাজার এসবের জন্য ভুগতে হচ্ছে কিন্তু সেই কৃষকদেরকেই।
চাষিদের এবছর সর্ষে চাষের উপর জোর দিতে বলা হয়েছিল কৃষি দপ্তর থেকে। গতবছর পর্যন্ত সর্ষের দাম ৭০-৮০ টাকা প্রতি কেজি পাওয়া গিয়েছিল। হঠাৎই এবছর সেই সর্ষের দাম চলছে ৪৫ টাকা/কেজি। ফলে সর্ষে চাষিদের মাথায় হাত। বেশি লাভের আশায় উলটে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিকে। তবে প্রতি বছর টমেটো আর লঙ্কাচাষ করে যে গেল গেল রব ওঠে, এবছর সেই চাষিরা কিছুটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। আসলে ফসলের উৎপাদন, চাহিদা, আবহাওয়া, এধরনের অনেকগুলো ফ্যাক্টর চাষের ক্ষেত্রে কাজ করে। আর সম্পূর্ণটা এতটাই অনিশ্চিত যে কিছু ক্ষেত্রে চাষিদের ভাগ্যের উপরও খানিকটা নির্ভর করতে হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সরকার থেকে বারবার বিকল্প চাষের কথা বললেও তারা নিজের ইচ্ছেমত চাষ করছে সেক্ষেত্রে কারোরই কিছু করার থাকে না।
কৃষিদপ্তরে কিছু আধিকারিক আন্তরিক সচেষ্ট তা চাষিদের কাছ থেকেই যেমন জানা গেল, তেমনি জানা গেল কৃষকদের নিজেদের মধ্যেই কোনো একতা নেই। পাশাপাশি সার, কীটনাশক ও বীজ নিয়ে আক্ষেপের সুরও শোনা গেল কোচবিহারের এক কৃষকের গলায়। তার কথায়, যে হারে এসবের দাম বেড়েছে, সেই তুলনায় কিন্তু বাড়েনি সব্জির দাম। মাত্র ২ বছর আগে ডিএবি সার ছিল ২২-২৫ টাকা কেজি। বর্তমানে তার দাম হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। পটাশের দাম ছিল ১৬ টাকা কেজি, তার দাম এখন ৫০ টাকা কেজি। মজার কথা হল, প্যাকেটের গায়ে কিন্তু এই দাম লেখা থাকে না। সার ও কীটনাশকের এই কালোবাজারি কী করে সরকারের নজর এড়িয়ে যায়, এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় তাদের মনে।
কোচবিহার জেলায় প্রায় ৭৬% হল কৃষিজমি। কৃষকরা নিজেদের মধ্যে তেমন সঙ্ঘবদ্ধ না থাকায় সরকারী নানা প্রকল্প, ঋণ ইত্যাদি থেকে বেশিরভাগ চাষি বঞ্চিত হয়। যারা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল তেমন মুষ্টিমেয় কয়েকজনই এই সুবিধাগুলো ভোগ করতে থাকে। এখানেই থেকে যায় একটা মস্ত বড় ফাঁক। কোচবিহারের কৃষি ব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে অসংগঠিত এই বিভাগটি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রশাসনিক চিন্তাভাবনা চলছিল বলে শোনা যায়। কৃষিদপ্তরের সাথে কৃষকের লিয়াজোঁ বা সংযোগ যদি নিয়মিত থাকে তবে আখেরে লাভবান হবে কৃষকরাই। এটাকে মাথায় রেখে কোচবিহার জেলা প্রশাসন কৃষি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জেলার জন্য ‘মিশন কৃষি আলো’ নামে একটি পরিকল্পনা করেছে। আগামী তিন বছরে চাষিদের আয় যাতে দ্বিগুণ হতে পারে সেই লক্ষ্যে জেলায় কিছু কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছে বলে জানা গেল। এগ্রিকালচার, হর্টিকালচার সহ নানা ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পাইলট প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে। চাষিদের দুঃখ দূর করতে এ সব উদ্যোগ কতোটা কার্যকরী হয় সেটাই দেখবার।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team