ইসলামপুর মহকুমার সোনাখোদার পাশের গ্রাম তেলিভিটা। এই তেলিভিটা গ্রামে অবস্থিত 'কমল দিঘি'। কমলাকান্ত নামের এক বিত্তশালী-অভিজাত ব্যক্তি ওই এলাকার তিলি সম্প্রদায়ের মানুষের জল-কষ্ট দূর করার জন্য এই দিঘি খনন করেছিলেন। এই তেলিভিটার ঠিক পাশের গ্রাম চোপড়াঝাড়। জানতে পারা যায় যে ১৯৭৪ সালে তেলিভিটার রফিক ও কাশেম সাহেব নামে উদারমনস্ক দুই ব্যক্তি নিজেদের অংশের পশ্চিম পাড় হিন্দুদের দান করেন। তখন থেকে হিন্দুরা দ্বিধাহীন সেখানে শবদাহ শুরু করে। প্রায় নয়-দশ বিঘার এই পুকুরটিই আসলে দীর্ঘদিন থেকে 'সতীপুকুর' নামেই পরিচিত। কিন্তু, শবদাহের সাথে 'সতী'- ব্যাপারটা খুব ভাবায়, তাই না?
'শব'-'সতী' নাকি 'সতী'- 'শব'? হ্যাঁ, সতী যখন শবদেহে মিশে যায় এবং সবটুকু ছাই যখন সেই জলেই মিশে যায়, তখন সেই পুকুর হয় 'সতীপুকুর'। হ্যাঁ, এখানেও এমন হয়। জানা যায় যে ইসলামপুর বাজারের মন্ডল পরিবারের এক অপুত্রক স্ত্রী চম্পা মন্ডল তাঁর প্রয়াত স্বামী সঙ্গতরাম মন্ডলের সাথে সহমরণ-এ সতী হয়েছিলেন। যা এখনও লোকমুখে শোনা যায়। সময়টা আনুমানিক ১৮১৫ থেকে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। ইসলামপুরের চোপড়াঝাড় জীবন মোড় হয়ে তিস্তা ক্যানেল পেরিয়ে খুব সামান্য দূরত্বেই 'সতীপুকুর শ্মশান'। এই মন্ডল পরিবারই সত্তরের দশকে শব যাত্রীদের জন্য বিশ্রামালয় ও জলকূপ নির্মাণ করেন।
এই সতীপুকুরের আরও অনেক পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক নানান উদ্যোগ। বিভিন্ন মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় বাণীপ্রসাদ নাগ মহাশয়ের নাম উল্লেখ করতেই হয়। এছাড়াও ১৯৭৪ সালে যখন শ্মশান-কমিটি প্রথম গঠিত হয় তার সম্পাদক অনিলচন্দ্র দাস, প্রয়াত সুবোধচন্দ্র দত্ত, প্রয়াত কানাইলাল দাস যিনি শ্মশানে মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছর থেকেই সেখানে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। এই শ্মশান সংস্কারে আরও অনেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। সময়টা ১৯৮৪। সেই সময়ের মহকুমা শাসক প্রয়াত দিলীপ চৌধুরী মহাশয় শবদাহ চুল্লী নির্মাণ করেন।
যার কথা না বললে বিষয়টিই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হল তারাভারতী ব্রহ্মচারীর নাম। শ্রদ্ধেয় বাণীপ্রসাদ বাবুর কথায় তিনিই হলেন শ্মশান উন্নয়নের প্রকৃত পথিকৃৎ। তিনি সবসময় লাল রঙের পোশাক পরতেন। এই নির্জন তৎকালীন অস্বাস্থ্যকর স্থানকেই তিনি তাঁর ঠিকানা করেছিলেন। জানা যায় যে তিনি সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় তৎকালীন প্রাক্তন পৌরপিতা অধীর বিশ্বাস তাঁর জন্য বিশ্রাম গৃহ নির্মাণ করেন। প্রয়াত সুবোধ দত্ত প্রাচীন বট গাছকে ঘিরে একটি বেদী নির্মাণ করেন। তবলা শিল্পী পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাবা প্রয়াত শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে মার্বেল পাথরে তৈরি করেন 'অন্তিম-স্নানাগার', যা সকলের কাছে প্রশংসা কুড়োয়। পরবর্তীতে পুরোনো স্নানাগারটিও সংস্কার হয়। শ্মশানের এই গঠনমূলক পরিবর্তনে বানীপ্রসাদ নাগ মহাশয়ের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সমগ্র ইসলামপুরবাসী। তাঁর উদ্যোগে ও আন্তরিক আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৯৯৭ সালে মাননীয় পি টি শর্মা ও মনোজ প্রসাদ জেলা শাসকের তহবিল থেকে বাউন্ডারি প্রাচীর তৈরির জন্য সাহায্য করলে, এক অন্য জোয়ার আসে 'সতীপুকুর শ্মশান'-এ।
এই স্বল্প-পরিসরে সকলের নাম উল্লেখ সম্ভব হল না। কিন্তু তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! চারপাশ ঘিরে সুসজ্জিত বাগান, ঠিক যেন পার্ক! পার্কের ভেতরে যমরাজ ও হিসেবের খাতা হাতে চিত্রগুপ্ত, ত্রৈলঙ্গস্বামী, বামাখ্যাপা, পুত্র কোলে শৈব্যা ও রাজা হরিশচন্দ্র। প্রবেশ দ্বারের দু'পাশে প্রতি টন ওজনের নন্দী- ভৃঙ্গী। শবদাহ চুল্লী যেতে দু'পাশে মশাল হাতে দু'জন দেবদূত। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় এই যে সতীপুকুর শ্মশান অথচ চুল্লীর গায়ে সতীদাহ প্রথা বন্ধের অন্যতম পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের মূর্তি! এছাড়াও বস্ত্র ব্যবসায়ী নির্মাণ করলেন আরও একটি চুল্লী। পাম্প মেশিন দিল যুবসন্ধি ক্লাব। চুল্লীর পাশেই স্বামী কোলে সতী চম্পার কাল্পনিক মূর্তি, ব্রহ্মা-মহেশ্বরের মূর্তি। মন্দিরের অংশে স্বামী বিবেকানন্দ, কালী-সাধক রামপ্রসাদ এবং লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মূর্তি। পুকুরের দিকে পূর্বে হনুমানজি ও গঙ্গা মূর্তি। মন্দিরের সিঁড়িতে দুটি সিংহ-মূর্তি, মন্দিরের তিনটি ঘরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদা সহ শ্মশান-কালী ও শিব-মূর্তি। সারা মন্দিরের গায়ে সতীর দেহত্যাগ, কৃষ্ণকালী ও ভগীরথের গঙ্গা আনার দৃশ্যাবলি। বিশ্রামগৃহের বারান্দায় কৃষ্ণমূর্তি।২০০৪ সালে সতীপুকুর শ্মশান পেল পূর্ণাঙ্গ রূপ। ব্যবস্থা করা হল শিশু ও বৈষ্ণবদের জন্য সমাধির ব্যবস্থা। সম্প্রতি বৈদ্যুতিক চুল্লীর ব্যবস্থা করা হল প্রশাসনিক উদ্যোগে। সমস্ত ইসলামপুরবাসীর সহযোগিতায়, পৌরসভার অগ্রণী ভূমিকায় সতীপুকুর শ্মশান আজ উত্তর দিনাজপুর তথা পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
ঋণ- বাণীপ্রসাদ নাগ, ড বৃন্দাবন ঘোষ, তপনকুমার বিশ্বাস সহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team