মধু মাস। ঋতুটিও মধুময়। এই সময়ে মধু যেন ঝরে বিশ্ব চরাচরে।
মধুক্ষরা এই সময় বড্ড বেশি আপন আমাদের প্রাত্যহিকতায়। আর তারই রং প্রকৃতিতে। রঙের সেই খেলায় কে নেই!
প্রকৃতির খেলা উত্তরেও। এমনিতেই পাহাড়, অরণ্য, চা-বাগান ঘেরা এই তরঙ্গায়িত ভূমি নয়নলোভন। আর তার সঙ্গে যদি মিশে যায় হরেক রং, তবে কী নিদারুণ হতে পারে ব্যাপারটি সেটা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। সংকোষের পশ্চিম থেকে তিস্তার পূর্ব অবধি ডুয়ার্স তাই রঙিন। শিমুল, পলাশ, মাদার, সজনে, রুদ্রপলাশ প্রত্যেকে নিজের মতো রং ঢেলে সাজিয়ে তুলেছে পৃথিবীকে।
রঙিন তরাইয়ের অন্য অঞ্চলও। রঙের সুখ স্পর্শ চারদিকে।
রং কি শুধু প্রকৃতিতে? নাকি রঙের নির্যাস মনুষ্য জীবনেও?
একটু তলিয়ে দেখলেই উত্তর মেলে। প্রকৃতির রঙের মেলা কবে কখন যেন আমাদের জীবনেও ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলেছে এই বসন্তে। তাই কোচবিহার থেকে মালদা পর্যন্ত, উত্তরের প্রায় সব জনপদে, বসন্ত উৎসব উদযাপিত হয়েছে পুরোদমে। ছোট থেকে বড়, কচি থেকে বুড়ো, কে নেই সেই উৎসব উদযাপনে! অবশ্য শান্তিনিকেতনের ধাঁচে বসন্ত উৎসব পালনের রেওয়াজ, আজকাল রাজ্যের সর্বত্র।
বারো মাসের তেরো পার্বণের বাঙালি জীবনে বসন্ত উৎসবকে হয়ত নতুন সংযোজন বলা যাবে না। কিন্তু কয়েক বছর আগেও তার এতটা ব্যাপকতা ছিল না। ১৯০৭ সালে বসন্ত উৎসব শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তার নাম ছিল ঋতুরঙ্গ উৎসব। তবে বসন্ত উৎসবের সবটুকু কৃতিত্ব বোধহয় তাঁর একার নয়।
'১৩১৩ সালের ৫ই ফাল্গুন তারিখে শ্রীপঞ্চমীর দিন রবীন্দ্রনাথের কণিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রথম বসন্তোৎসব উদযাপন করেন। সে সময়ের আশ্রমের গুটি কয়েক ছাত্র নিয়ে শমীন্দ্রনাথ আদি কুটিরের হলঘরে এই উৎসব পালন করেন। বর্তমানে সে ঘর নিশ্চিহ্ন। তার পরিবর্তে স্থান নিয়েছে নব প্রাক কুটির। সেই ১৩১৩ বঙ্গাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব পালিত হয়ে আসছে। শ্রীপঞ্চমী এখনো উদযাপিত হয়। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দোলের দিন বসন্তোৎসব পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই উৎসবকে ঋতু উৎসব পর্যায় ভুক্ত করেন।' ( প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ: উৎসব ও ভবন-- দিলীপ কুমার দত্ত)
হোলির অনুষঙ্গে বসন্ত উৎসবের সূচনা হলেও, হোলির সঙ্গে তাকে এক করে দেওয়া ঠিক নয়। হোলিকা দহন থেকে সৃষ্ট হোলির গভীরে শীতের বিদায় ও বসন্তের আবাহন থাকলেও, তার মূল সুর ধর্মীয়। হোলির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাধাকৃষ্ণ। মথুরা-বৃন্দাবন সহ উত্তর ভারতের সব জায়গাতেই, 'লাথমার হোলি' থেকে যত ধরণের হোলি উৎসব হয়, তার নেপথ্যে রয়েছেন তাঁরা।
নন্দলাল বসু তাঁর 'দৃষ্টি ও সৃষ্টি'-তে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, বসন্ত উৎসবের মুলে রয়েছে প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে জানা ও চেনা। কেননা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়ন। আর সেখানে শিল্পের রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কারণ, শৈল্পিক নান্দনিকতা ও শিক্ষা একে অপরের পরিপূরক। দুর্ভাগ্য, আমাদের পাঠ্যক্রমে অন্য সব বিষয় থাকলেও, শিল্পের জন্য একটি পাতাও বরাদ্দ হয় না।
রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। শান্তিনিকেতনের তাই চালু করেছিলেন প্রকৃতির মাঝে পড়াশোনা। আসলে, প্রকৃতির ওপর বড় শিল্পী যেমন কেউ নেই, তেমনি তার মতো শিক্ষকও কেউ হতে পারে না। তাঁর শিক্ষাপ্রথার অঙ্গ হিসেবে শুরু হয়েছিল বসন্ত উৎসব। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে যারা শহুরে, চিনুক ও জানুক প্রকৃতিকে। প্রকৃতির রূপ রস বহন করুক তাদের চেতনায়। শৈল্পিক হয়ে উঠুক নিজস্ব যাপনে।
তাঁর নিজের কথায়, `আমি তো আজ গাছপালার সঙ্গে বহু প্রাচীনকালের আত্মীয়তা স্বীকার করিব। ব্যস্ত হইয়া কাজ করিয়া বেড়ানোই যে জীবনের অদ্বিতীয় সার্থকতা, এ কথা আজ আমি কিছুতেই মানিব না। আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়োদিদি বনলক্ষ্মীর ঘরে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার সঙ্গে নিতান্ত ঘরের লোকের মতো মিশিতে হইবে। আজ ছায়ায় পড়িয়া সমস্তদিন কাটিবে—মাটিকে আজ দুই হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে—বসন্তের হাওয়া যখন বহিবে, তখন তাহার আনন্দকে যেন আমার বুকের পাঁজরগুলার মধ্য দিয়া অনায়াসে হুহু করিয়া বহিয়া যাইতে দিই—সেখানে সে যেন এমনতরো কোনো ধ্বনি জাগাইয়া তোলে, গাছপালারা যে ভাষা না বোঝে। এমনি করিয়া চৈত্রের শেষ পর্য্যন্ত মাটি, বাতাস ও আকাশের মধ্যে জীবনটাকে কাঁচা করিয়া সবুজ করিয়া ছড়াইয়া দিব—আলোতে-ছায়াতে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিব।
কিন্তু, হায়, কোনো কাজই বন্ধ হয় নাই—হিসাবের খাতা সমানই খোলা রহিয়াছে। নিয়মের কলের মধ্যে কর্ম্মের যাঁদের মধ্যে পড়িয়া গেছি—এখন বসন্ত আসিলেই কী, আর গেলেই কী।
মনুষ্যসমাজের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, এ অবস্থাটা ঠিক নহে। ইহার সংশোধন দরকার। বিশ্বের সহিত স্বতন্ত্র বলিয়াই যে মানুষের গৌরব, তাহা নহে। মানুষের মধ্যে বিশ্বের সকল বৈচিত্র্যই আছে বলিয়া মানুষ বড়। মানুষ জড়ের সহিত জড, তরুলতার সঙ্গে তরুলতা, মৃগপক্ষীর সঙ্গে মৃগপক্ষী। প্রকৃতি-রাজবাড়ীর নানা মহলের নানা দরজাই তাহার কাছে খোলা। কিন্তু খোলা থাকিলে কী হইবে? এক-এক ঋতুতে এক-এক মহল হইতে যখন উৎসবের নিমন্ত্রণ আসে, তখন মানুষ যদি গ্রাহ্য না করিয়া আপন আড়তের গদিতে পড়িয়া থাকে, তবে এমন বৃহৎ অধিকার সে কেন পাইল?`
বসন্ত উৎসবের সব চাইতে প্রচলিত সংগীত `ওরে গৃহবাসী`তে তাই `দ্বার` খুলবার যে আহ্বান তা মনের দরজা খুলে দেওয়ার ডাক। যে সংকীর্ণতা আমাদের মনকে অন্ধকারে ঢেকে রাখে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার চিরন্তন বাণীই ধ্বনিত হয় এই গানের প্রতিটি ছত্রে। বসন্ত সেই প্রকৃতি যে নিজে উদার, যার পরতে পরতে অমৃতের আলো প্রজ্বলিত!
আজ যারা বসন্ত উৎসব পালন করছেন, আশা করা যায় তারা এই বিষয়টি ভালভাবে জানেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা প্রকৃতিকে ভালবেসে ও প্রকৃতির রঙে নিজেদের রাঙিয়ে এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। উৎসব শেষে ঘরে ফিরে নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে নিজের এলাকা ও শহরকে কলুষমুক্ত রাখছেন। নান্দনিক করে তুলছেন। সহ-নাগরিকদেরকেও সচেতন করছেন এই বিষয়ে। তাদের যাপনে ফুটে উঠছে শিল্পসত্তা। চর্চা করছেন মুক্ত চিন্তার। দূরে সরিয়ে রাখছেন সব রকম প্রাদেশিকতা। বিশ্ব নাগরিক হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ।
আসলে যে কোনও উৎসবের গভীরে থাকে এমন কিছু শিক্ষা, যা আমাদের আত্মিক উত্তরণ ঘটায়। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ যে উৎসবের সূচনা করেন, তার তাৎপর্য সবসময়ই আলাদা। বসন্ত উৎসব তাই কোনও হুজুগ নয়। বরং মুক্ত মনের ভাবনা থেকে জন্ম নেওয়া এক অত্যন্ত আধুনিক উৎসব। সেটি ভুলে যদি স্রেফ লোক দেখানোর বা সমাজমাধ্যমে ছবি দেওয়ার জন্য বসন্ত উৎসবে মাতি, তবে আর পাঁচটা অর্থহীন উৎসবের মতো সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই গা ভাসানো হবে!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team