আধুনিকতা আর ভোগবাদ
আদি অকৃত্রিম ঐতিহ্য সংস্কৃতির সূতিকাগার হল পাড়া। মানুষ তো খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের তাগিদে যূথবদ্ধ হয়েছে। কল্পনা বুদ্ধি আবেগ তাকে উদ্দীপ্ত করেছে জীবন সংগ্রামে। আবার সঞ্চয়ের নেশা যৌথ জীবনে ভাঙন ধরিয়েছে ।ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ার পরম্পরা। যৌথ পরিবার বিলুপ্তপ্রায়। চটুল আধুনিকতা আর ভোগবাদ সর্বস্ব নব্যদর্শনের উচ্ছিষ্টভোগী ফাঁপা মানুষ হয়ে বেপাড়ায় হাঁসফাঁস করছি আমরা। ‘সোনার হরিণের’ আকাঙ্খায় ঘোড়দৌড় ধ্বংস করছে সনাতন ঐতিহ্যে লালিত পাড়া সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ হীরকের দ্যুতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
পাড়া সংস্কৃতি
জীবন চর্চার অপর নামই তো সংস্কৃতি, যার জন্ম হয়েছে চিরকাল পাড়ায় পাড়ায়।সে পঁচিশে বৈশাখ হোক বা উৎসব পার্বণ। বাংলার পাড়া সংস্কৃতি অন্য প্রদেশ থেকে ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ সব পাড়ার সাহিত্য সংস্কৃতির যেন অভিভাবক। সকলের আপনজন। পাড়ার ক্লাবেই তো জীবনের প্রথম কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘বর এসেছে বিয়ের ছাঁদে/বিয়ের লগ্ন আটটা’ কিংবা ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে’… আবৃত্তির হাতেখড়ি। কখনও ভুলে যাওয়া নাটকের ডাইলগে হাততালি। সোহাগে শাসনে সকলের সঙ্গে বড় হওয়া। ‘দেখ আমি বাড়ছি মাম্মি’ গোছের বিজ্ঞাপনের বহরে নয়। কিংবা ঠিকানা থেকেও ঠিকানাহীন হয়ে ‘ছায়াবাজির ছায়ার মতো’ বেঁচে থাকা নয়। আমার পাড়া আমাকে শিখিয়েছে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা, দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধে একাত্ম হয়ে যাবার বেদমন্ত্র।
একঝাঁক অভিভাবকহীন প্রজন্ম
খেলাধূলা, ফুটবল কাবাডি হা-ডু-ডু খো-খো লুকোচুরি সে যাই হোক, উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা কিংবা সমস্যার সমাধানের নিদান শিখেছি পাড়ার অভিভাবকদের কাছে। সকল বয়স্করা যেন সকলের অভিভাবক। চেতনায় দিয়েছি শান। সে শহর কিংবা গ্রাম যেখানে হোক সরস্বতী কিংবা কালী-কার্তিক পূজার প্যান্ডেল হয়েছে পাড়ার কাকিমা, জেঠিমাদের রঙবেরঙের কাপড়ে দিয়েই। পূজার বাজারে নতুন জামা-কাপড়ের গন্ধে বিভোর হয়ে থাকতাম কয়েকটা দিন। যৌথ পরিবারের সদস্য হিসাবে দেখেছি পূজার বাজার দেখতে গোটা পাড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ত ঘরে ঘরে। শহর সভ্যতার আধুনিকতায় একঝাঁক অভিভাবকহীন প্রজন্মকে দেখি বীভৎস পোশাকে মোটর বাইকের বিকট আওয়াজে পাড়ার পবিত্রতা নষ্ট করছে। প্রমত্ত সিটি মারার উল্লাসে ভেঙে দিচ্ছে পাড়ার ঐতিহ্যের চিরাচরিত নির্মাণ। তখন আমি আর কিছু মেলাতে পারি না। মনে হয় এপাড়া আমার পাড়া নয়। পাড়ায় পাড়ায় যেন আজ বেপাড়ার রাজ। এক সময় বন্ধুত্ব, মিতা কিংবা সই পাতানোর মধ্য দিয়ে নির্ভেজাল বন্ধুত্বের স্বাদ খুঁজে পেতাম।
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বড়মা, আরিমা, রেনুমা, রাঙামা, কাকিমারা যেন সকলের মাতৃরূপা নারী হয়ে অপশক্তিকে থেকে পাড়ার সব প্রজন্মকে রক্ষা করত। একটা শক্ত বাঁধন ছিল সর্বত্র। আজ সেই বান্ধন যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই আমরা এক সুচিভেদ্য অন্ধকারের দিকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছি। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে…’’। বিলাসিতার উগ্র উত্তেজনায় আর আত্মকেন্দ্রিকতার যাপনে সত্যিই খোকা নয় পাড়াই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকে যেন বৃষ্টিভেজা দুপুরগুলো ভীষণ বোকা মনে হয়। সামাজিক সংস্কৃতির স্তম্ভ ছিল গ্রাম। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাস করেছে চিরকাল। ধর্মীয় উৎসব হয়ে গিয়েছে সর্বজনীন। কিন্তু বর্তমানে পাড়ার সেই পরম্পরায় ভোটরাজনীতি যখন ছোবল মারে ভয়টা হয় তখনই। প্রতিবেশীর বিপদ মানে সকলের বিপদ। বিবাহ উৎসবের আয়োজন ও তদারকির দায়িত্বে থাকতেন বয়স্করা। পাড়ার সমস্যা মেটাত পাড়ার মানুষজন। এখন সবাই সবজান্তা। গ্রামের পাড়ায় লেখাপড়া না থাকলেও ভালোবাসার প্রগাঢ়তা ছিল। সুখ-দুঃখে প্রতিবেশীরাই প্রথমে এগিয়ে আসে। আত্মীয়স্বজনের থেকে পাড়াপ্রতিবেশী অধিক কাজে আসে।
সাফ করবার সময় এসেছে
‘পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে’ কিংবা ‘আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে। রঙ্গলালবাবুও এখনি আসবেন।’ কবিগুরুর সহজ পাঠের এই চরম সত্যকথাগুলি খুবই সময়পযোগী মনে হয় এখনও। সত্যি এযুগের পাড়াগুলো কিন্তু আজও জঙ্গলময়-জঞ্জালময়।এই জঙ্গল আত্মকেন্দ্রিকতার, এই জঙ্গল অপসংস্কৃতির। তাই আমাদের সাধের পাড়া পুঁতিগন্ধময়। সত্যিকারের সাফ করবার সময় এসেছে বৈইকি। তবুও আশাবাদী আমি ‘রঙ্গলালবাবুও এখনি আসবে’ বলে। কিংবা আমার হারিয়ে যাওয়া পাড়া তেমনই জঞ্জালমুক্ত বিশ্ব গড়বে। সুকুমার রায়ের ছড়ায় হারানো আমার পাড়াকে খুঁজে পাই,‘পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দুপুর রোদে গাছের ডালে উঠি/ আয়রে সবাই হল্লা করে হরেক মজা লুঠি/একদিন নয় দুইদিন দুই দুমাস ছুটি।’
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team