 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 মমি জোয়ারদার
                                            
                                                
                                                মমি জোয়ারদার
                                            
                                            
                                        দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিতে আমরা যেমন হাঁপিয়ে উঠি তেমনই আমাদের দু-একদিনের জন্যে কাছাকাছি ঘুরে আসার জায়গা অনেক আছে। দার্জিলিং কালিম্পং-এ পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্যের ডালি। আর সেই সৌন্দর্য পিপাসুদের ভীড় দিনদিন বাড়ছেই, বেড়েই চলেছে। এটা অবশ্য হওয়ারই কথা। বাঙালী বরাবরের ভ্রমণপিপাসু জাত। তার উপরে এখনতো পুরো পৃথিবীটাই হাতের নাগালে। তাই পাহাড় কি সমুদ্র, কাছে কি দূরে সর্বত্রই খুব ভীড়। কিন্তু যাঁরা নেহাৎই প্রকৃতির কোলে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে দুদন্ড জিরিয়ে নিতে চায়, তাদের কাছে চেনা পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন আর কোনো আকর্ষণ সৃষ্টি করে না। তারা খুঁজে বেড়ান এমন একেক জায়গা, যেখানে সময় ক্ষণিক থমকে যায়, আগে পরের দৌড় নেই, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছোটাছুটি নেই। শুধুই অখন্ড অবসর।
তেমনই এক জায়গার হদিস পেয়ে কাটিয়ে এলাম দুটো দিন। আমি আর আমার এক বোন। দুটো দিন তো শান্তিতে ধীরেসুস্থে কাটাতে চাই, তাই আর দলবলকে আমাদের পরিকল্পনার প-ফ জানালাম না। কোথায় যাই কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই পরিচিত একজনের কাছে পেলাম মুনথুম-এর হদিস।

মুনথুম। বলা যায় ছোটোর থেকেও ছোট্ট এক পাহাড়ী গ্রাম। কালিম্পঙ থেকে ১৫-১৬ কিমি দূরে, কাঁকে বং খাসমহলে। কিন্তু পর্যটনের দিক থেকে ভাবলে, বলা যায় এ গ্রামের কৌমার্য এখনো অটুট। পর্যটকদের পদধুলি এ গ্রামে এখনো সেভাবে পড়েনি। হোমস্টের সংখ্যাও খুব কম। দু-একটিই হবে। আমরা ছিলাম মুনথুম ভিলেজ হোমস্টেতে। থাকাখাওয়া জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫০০ টাকা। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো, আকর্ষণীয়। এই হোমস্টের মালিক বিশাল ভাই, ছিলেন দুবাইতে। সেখানকার চাকরী ছেড়ে পৈতৃক জমিতে হোমস্টে খুলেছেন। ফ্যামিলি থাকে শিলিগুড়িতে। তাই উনি শিলিগুড়ি আর মুনথুম যাতায়াত করেন। ওর ভাই রোহিত এখানেই থাকেন, দাদার অনুপস্থিতিতে হোমস্টের দেখাশোনা করেন।
দুজনে যাব তাই আর গাড়ি রিজার্ভ করলাম না। হোমস্টে থেকে কালিম্পং-এ গাড়ি আসবে আমাদের নিতে। ভাড়া নেবে ১৫০০টাকা। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং যাওয়ার বাস বা শেয়ার গাড়ি (সুমো বা বোলেরো) সহজেই পাওয়া যায়। আমরা সকাল সাড়ে সাতটায় চলে গেলাম পানিট্যাঙ্কি মোড়। সকালে এখান থেকেই গাড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া তেঞ্জিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাস বা তার পাশেই প্রাইভেট শেয়ার গাড়ির স্ট্যান্ড থেকেও গাড়ি পাওয়া যায়। বাসের ভাড়া মাথাপিছু ১২০ টাকা আর শেয়ার সুমোর ভাড়া ২৫০ টাকা। সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা মতো। আমাদের গাড়ি ছাড়লো পৌনে আটটায়, আমরা কালিম্পং পৌঁছালাম সকাল দশটার কিছু পরে। পেটে তখন ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। সেই সকাল সাতটায় চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছিলাম, ছুঁচোর আর দোষ কী!!
খুঁজেটুজে একটা খাবারের দোকান পাওয়া গেলো। দোকান তো অনেক আছে। কিন্তু সেগুলো হয় আমাদের পছন্দ হয় না, নয় তো সেখানে আমাদের খাওয়ার মতো খাবার নেই। যাইহোক শেষমেশ ঢুকে পড়লাম। অর্ডার করলাম একটা চিকেন থুক্পা আর এক প্লেট ভেজ মোমো। যা পরিমাণ দুজনে্র ভালোভাবে হয়ে যাবে। কালিম্পং পৌঁছানোর আগেই হোমস্টেতে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের অবস্থান। যাতে সঠিক সময় গাড়ি চলে আসে, আমাদের সময় নষ্ট না হয়। সত্যিই একদম সময় নষ্ট হয়নি। আমাদের খাওয়াও শেষ হয়েছে, হোমস্টে থেকে গাড়ি এসে হাজির। মুনথুম থেকে গাড়ি এসে পিক আপ করে নিয়ে যেতে নিলো ১৫০০ টাকা। একটু কি বেশি হলো? আমরা বাস থেকে নেমে একটু খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি নিলে কত লাগতে পারে। নাহ্, বেশিরভাগ ড্রাইভার বুঝতেই পারছিলো না আমাদের গন্তব্য। শেষমেষ একজন পারলো। তবে রেট ওই একই।

হোমস্টে থেকে আসা গাড়িতে আমরা চললাম আমাদের গন্তব্যার দিকে। গাড়ি ছুটলো কালিম্পং বাস স্ট্যান্ডকে পেছনে ফেলে রেল্লি রোড ধরে। কিছু দূর এগোতেই জ্যামে পড়লাম। শহরটা এত ঘিঞ্জি হয়ে গেছে যে এই জ্যামে পড়া অবধারিত। যাহোক, মিনিট দশেক বসার পর গাড়ির চাকা আবার ঘুরলো। ধীরে ধীরে ঘিঞ্জিভাব কমে আসছে, পাহাড়ের ঢাল কেটে ছোটো ছোটো চাষের জমি, প্রকৃতি যেন দুহাত বাড়িয়ে আমাদের ডাকছে।
রাস্তায় দুটো ব্রীজ পড়লো। প্রথমে রেল্লি ব্রিজ, রেল্লি খোলা বা নদীর ওপর। কংক্রীটের তৈরী সাধারণ ব্রীজ যেমন হয় আর কি। দ্বিতীয়টি পালা নদীর ওপর, পালা ব্রীজ। লোহার ব্রীজ। গাড়ি থেকে নেমে একপ্রস্থ ফোটো সেশন হয়ে গেলো। এরপর একটু এগিয়ে পাকা রাস্তা ছেড়ে আমরা ঢুকে পড়লাম পাথর বাঁধানো কাঁচা রাস্তায়। তার দুদিক বড় বড় গাছে ভরা। ছায়াঘেরা রাস্তায় তিন-চার মিনিট সামনে এগোতেই চোখে পড়লো গাছের ডালের স্ট্যান্ডের ওপর কাঠের তক্তায় কালো কালিতে লেখা Munthum Village Homestay-এর সাইন বোর্ড।
জায়গাটা দেখেই মন ভরে যায়। মালিক বিশাল ভাই এর রুচির ছাপ সর্বত্র। খুব সাধারণ কিছু জিনিস দিয়ে অন্যরকম সাজিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। আমি অনেক হোমস্টে ঘুরেছি, কিন্তু এরকম ভাবনা চিন্তার ছাপ চোখে পড়েনি। ব্যবহারও খুব ভালো। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক। কাঠ ও বাঁশের তৈরী, খড়ের ছাউনি দেওয়াল কটেজগুলো প্রতিটাই অন্যটার থেকে একটু দূরে। চারিদিক নিঃশব্দ। সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে মাঝে মাঝেই শোনা যায় নানারকম পাখির ডাক, আর অনতি দূরে পালা ব্রীজের ওপর গাড়ি চলার শব্দ।
দুপুরের খাওয়ার আগে ভাবলাম একটু নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু কপাল মন্দ দু পা এগোতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। ছাতা নিয়ে বেরোইনি, অগত্যা এক জায়গায় একটু শেড দেখে মাথা বাঁচালাম। বৃষ্টি একটু ধরতে কোনোক্রমে ফিরে আসা। ততক্ষণে দুটো বেজে গেছে। আমাদের লাঞ্চ সার্ভ করা হলো। বসার জায়গাটি বড্ড সুন্দর। নীচু টেবিল, নীচে গদি পাতা। আসন করে বসে আমরা খেলাম। ততক্ষণে আকাশ আবার পরিস্কার। একটু রেস্ট নিয়ে আমরা চললাম আশপাশে একটু ঘুরে দেখতে। পাথর বাঁধানো রাস্তায় চড়াই ধরে উঠতে উঠতে একটা দুটো বাড়িই চোখে পড়লো। আর কোনো হোমস্টেও দেখিনি। অন্য কোনো টুরিস্টও নেই। দেখার মধ্যে দুটি বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেলাম, তারা তাদের বাড়ির সামনে খেলছে। আর একজায়গায় গুটিকয়েক শ্রমিক কাজ করছিলো। আমরা দুই বোন ঘুরে বেড়ালাম নির্ভয়ে, পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলোয় পাহাড়কে দেখলাম অন্যরূপে।
সন্ধ্যা নামতেই চলে এলো গরম গরম পকোড়া আর চা। ঠান্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। এখানে ক্যাম্প ফায়ার আর বারবিকিউ-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের বারবিকিউ খাওয়ার ইচ্ছা নেই। শুধু ক্যাম্প ফায়ার করতে কত লাগবে জানতে চাইলাম। “পহেলে আইয়ে না”। না, পরে অবশ্য আর কিছু লাগেনি। আমরা বসলাম আগুনের কাছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় একটু উষ্ণতা, সঙ্গে গীটার বাজিয়ে রোহিত ভাই-এর গান। উলটো দিকের কালিম্পং পাহাড়ও ততক্ষণে সেজে উঠেছে আলোর নেকলেসে। অন্যদিকে অনেক দূরে দূরে একাকী নিঃসঙ্গ বাড়িগুলোতে জ্বলছে অস্পষ্ট টিমটিমে বাতি আর ব্যাকগ্রাউন্ডে রোহিত ভাই এর গীটারে তখন “ইয়ে জীবন হ্যায়, ইস জীবনকা ইয়েহি হ্যায় ইয়েহি হ্যায় রঙ্গ রূপ”। একটা অমায়িক সন্ধ্যা।
ঠান্ডায় আর বসে থাকতে না পেরে ডিনার করে নিলাম। বাইরে খোলা আকাশের নীচে পর্দা ঘেরা গদি পাতা সুন্দর বসার জায়গা। খুব ইচ্ছা ছিলো সেখানে বসে ডিনার করি। কিন্তু দুপুর থেকে দফায় দফায় বৃষ্টিতে সব ভেজা। আর ঠান্ডাও খুব। তাই খড়ের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ডাইনিং-এই আমাদের ডিনার সারলাম।

জায়গাটা বার্ড ওয়াচারদের জন্যেও স্বর্গ হতে পারে। ভোরে উঠে ক্যামেরা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম। যদিও পাখির ছবি তোলার মতো লেন্স আমার নেই, তথাপি যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশা নিয়ে বেরোলাম। নানারকম পাখির কিচিরমিচির শুনলাম, কয়েকটা ছবি পেলাম, আরও অনেক পেলাম না। তাতে কী! আক্ষেপ মেটাতে নিজেদের ছবি অনেক তুলেছি।
এত সুন্দর একটা জায়গা, আবারও আসার ইচ্ছা রইলো। কিছুই নেই, কিন্তু এমন কিছু একটা আছে যাকে অনুভব করতে হয়। জানিনা কতদিন এখানকার শান্তি, নিঃস্তব্ধতা, চাকচিক্যহীন নির্ভেজাল সৌন্দর্য্য বজায় থাকবে! একটাই প্রার্থনা ব্যবসা হোক, হোমস্টে হোক, টুরিস্ট আসুক তবে তাতে যেন এই জায়গার নিজস্বতা যেন হারিয়ে না যায়, এটা যেন কংক্রীটের জঙ্গলে পরিণত না হয়।
এখানে আসার জন্যে শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং হয়ে আসা যাবে অথবা মালবাজার থেকে লাভা হয়েও আসা যেতে পারে। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং পর্যন্ত বাস, শেয়ার গাড়ি বা রিজার্ভ গাড়ি সবই পাওয়া যাবে। কিন্তু কালিম্পং থেকে মুনথুম আসার জন্যে রিজার্ভ ছাড়া অন্য কিছুর উপর ভরসা না করাই ভালো। শিলিগুড়ি থেকে রিজার্ভ গাড়ি ৪০০০-৪৫০০ টাকা নেবে। মালবাজার থেকেও তাই। এখান থেকে ঘোরার জায়গা অনেক। কালিম্পং শহরের দ্রষ্টব্য স্থান তো আছেই, সেখান থেকে একদিকে তিস্তাবাজার-ত্রিবেণী, সেভক হয়ে শিলিগুড়ি। অন্যদিকে লাভা, লোলেগাঁও, ঝান্ডিদারা, গরুবাথান হয়ে মালবাজার যাওয়া যাবে। এখানে সপ্তাহান্তের দুটো দিন অবিস্মরণীয় হতে পারে। শান্তি ও নিঃস্তব্ধতার ঠিকানা হোক মুনথুম।
যোগাযোগের নম্বর 9064650942
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
