বিষহরি, বা বিষহরা বা কানী বিষহরি একটি আনুষ্ঠানিক লোকনাট্য। ব্রত ও আচারধর্মী এই নাট্যধারা প্রচলিত আছে সমস্ত উত্তরবঙ্গে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো জলপাইগুড়ি জেলার লোকনাট্য সম্পর্কে আলোচনার সময়। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি কথা জেনে নেব।
বিবাহ, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশের মত শুভ অনুষ্ঠানের পূর্বে গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় এই পালার আয়োজন করা হয়। সম্পূর্ণ শ্রাবণ মাস জুড়েই এই পালার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও বছরের যে কোনও সময় গৃহস্থ তাঁর মানসিক অনুসারে এই পালার আয়োজন করেন। গীতপ্রধান এই নাট্যে অভিনয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বন্দনা অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয়ে মর্তে দেবীর পূজা প্রচলনের পর ভাসান। এভাবেই পালা চলে তিনদিন, পাঁচদিন, সাতদিন, নয়দিন অথবা এগারো দিন। একের পর এক ঘটনাক্রম অনুসারে প্রতিদিন চলে পালার অভিনয়। কখনও বা একদিনেই পালাটির সংক্ষিপ্ত রূপ অভিনীত হয়। একজন মূল গায়েন, একজন দোয়ারী, চারজন ছোকরা, অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতা, বাদ্যযন্ত্রী— এক একটি দলে সব মিলিয়ে চোদ্দ-পনের জন মহিলা ও পুরুষ শিল্পী থাকেন। বিষহরি পালা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করবো জলপাইগুড়ির লোক সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার সময়।
বিষহরি পালার একজন মূল গায়েন জীতেন বর্মণ। জামালদহের উছুলপুখুরি গ্রাম পঞ্চায়েত অঞ্চলে বাস করেন বিরল প্রতিভাধর মধ্যবয়সী এই শিল্পী। একমাথা ঘনকালো চুল, উজ্জ্বল চোখ, সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী এই মানুষটি শিল্পের জগতে জড়িয়ে পড়েন সতের-আঠারো বছর বয়সেই। উছলপুখুরি অঞ্চলের সে সময়ে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন ঢ্যাম গীদাল। তাঁর দলের একজন হয়ে গেলেন জীতেন। ছোকরা হয়ে। দিন মজুর পিতার এই ছোট ছেলে ঢ্যাম গীদালের বাড়ীতে ছিলেন কাজের লোক। দীর্ঘদিন সঙ্গীতের পরিবেশে থাকবার জন্যই হয়তো তাঁর জীবনে সঙ্গীত-নৃত্য-অভিনয় ঢুকে পড়ে। বিষহরি পালা দিয়েই তাঁর শিল্পী জীবন শুরু। পরবর্তীতে কুশান, সত্যপীর, দোতারাডাঙা পালাতেও তিনি সিদ্ধ হয়ে ওঠেন। দলের সঙ্গে থাকতে থাকতেই শিখে গেলেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কৌশল। ঢাক, ঢোল, তাসা, খোল, তবলা, খমক, একতারা, সারিঞ্জা, দোতারা, আড়বাঁশী, মোখাবাঁশী, হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন সমান দক্ষতায়।
ঢ্যাম গীদালের বয়স হয়ে গেলে দলের ভার পড়লো জিতেনের ওপর। ছোট্ট জিতেন ততদিনে অনেক পরিণত। গানের দলের নেতা হবার সবরকম গুণ তাঁর মধ্যে উদ্ভাসিত। দল নিয়ে ঘুরেছেন কত কত জায়গায়। অক্ষরজ্ঞানহীন এই মানুষটি মুখে মুখে রচনা করেছেন গান। তাতে সুর দিয়েছেন। বিষহরি পালা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। অভিনয়ের মান বাড়িয়েছেন। অনেক বেশী আকর্ষণীয় করেছেন পালাকে পূর্বের তুলনায়। নিজের দক্ষতা এমন উন্নীত করেছেন— সম্পূর্ণ বিষহরি পালা একাই সঙ্গীত, অভিনয় সহযোগে প্রদর্শন করতে পারেন।
১৯৮৯ সাল থেকে বেতার শিল্পীর স্বীকৃতি পেলেন। ২০০৩ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৪১০ সালে শ্রাবন মাস বত্রিশ দিনের। সেমাসের প্রতিদিনই সন্ধ্যায় আকাশবাণী শিলিগুড়ি থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে বিষহরি পালা। আর তা শুনিয়েছেন জীতেন বর্মন। ২০০৪ সালে আব্বাসউদ্দীন মেলায় বিষহরি পালা পরিবেশন ক’রে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিদগ্ধ জনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সে বছরই গেছেন আহমেদাবাদে। গেছেন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশে এই পালা পরিবেশনের জন্য। ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। ইতালি সরকারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক কারণে যেতে পারেননি।
নেই তাঁর জীবনে অনেক কিছুই। নেই ভদ্রস্থ ঘর-বাড়ি। চাষের জন্য নিজস্ব জমি নেই। নিয়মিত অন্ন সংস্থানের নিশ্চয়তা নেই। আছে বুকের ভেতরে অনেক ভালোবাসা। শিল্পের জন্য। মানুষের জন্য। সাধনায় ডুবে থাকা মন চেনে অনেক কিছুই। জানে জীবনের অনেক গুঢ় তত্ব। একটি কাগজের পুরোনো কভার ফাইল থেকে কাগজগুলো দেখাচ্ছিলেন আর আলো হয়ে উঠছিল তাঁর মুখ। এসবই চিঠিপত্র, খবরের কাগজের কাটিং, ছবি ইত্যাদি। স্বীকৃতির দিন, সম্মানের ক্ষণগুলি আরও একবার যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল তাঁর মনে। পালাগানের সঙ্গেই তো কাটলো অর্ধেক জীবন। বাকীটাও চলবো তার সাথে। এ এক অপার বিশ্বাস। নিশ্চিন্ত নির্ভরতা।
ঘুরে বেড়ালাম গ্রামের এদিক ওদিক তাঁর সাথে। গল্পগাছা করে কাটলো সারাদিন। শুনলাম তাঁর উপলব্ধির কথা। জীবনকে গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে দুঃসহ পরিবেশেও সৃষ্টির সুখে দিন কাটাতে পারে মানুষ। এক অন্য অনুভূতি। অত্যন্ত কঠিন সময়েও জীবনকে ভালোবাসার অদম্য শক্তি। আর সৃষ্টির আনন্দ ভাগ করে নেওয়াও যে এক শিল্প। এক মাথা ঘন কালো চুল কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে দুলে ওঠে, দু’চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাথর কোঁদা শরীরে যে দোলা পেশির সঙ্গে, হাতের চলন, আঙুলের ব্যবহার সেও তো শিল্প হয়ে উঠতে দেখলাম। শিল্প করবো বললেই তো আর সৃষ্টির কাজে মন দেয় না মানুষ। সৃষ্টি শিল্প হয়ে ওঠে। এই হয়ে ওঠা জীতেনের কাজে অনাবিল। যে আনন্দের খোঁজে মানুষ ঘোরে পাগলের মত, সে পরশ পাথর এই মানুষটির সঙ্গে থাকে যেন সর্বদা। ছোঁয়া লাগলেই সোনার পরশ সবার জীবনেই। এ এক অনন্য অনুভূতি। জীবন যে অমুল্য।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লো। অন্ধকার তার কালো চাদর নিয়ে হাজির। এবার তো ফিরতে হবে নিজ নিকেতনে। উঠে পড়লাম বাসে। তিনিও উঠলেন। দেখে নিলেন ঠিকমত বসতে পেরেছি কিনা। বাস ছাড়লো আমার ঘরে ফেরার। তিনিও চললেন উল্টোদিকে। নতুন সৃষ্টির খোঁজে। আনন্দ সাথে ক’রে।
চণ্ডি নাচ
আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুখোশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মুখোশ মানুষের মূল আদলকে ঢেকে দিয়ে বদলে দেয়। প্রভাবিত করে পরিবেশকে। আমাদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা আছে যে দেবতা অপদেবতা বিভিন্ন সময়ে মানুষের ওপর ভর করে। মানুষের শরীরের দখল নেয়। সেসময় সে মানুষের মনও বদলে যায়। আর বিপরীতে থাকা অন্যান্য সকলে তাকে দেবতা বা অপদেবতার প্রত্যক্ষ রূপ বিশ্বাসে ভয় পায়, ভক্তিতে আনত হয়। অথবা দূরে সরে যায়।
মুখোশের সঙ্গে প্রাচীন জাদুবিশ্বাস জড়িয়ে আছে। মানুষ অনেকদিন আগে থেকেই বিশ্বাস করে মুখোশ পরলে মানুষ বদলে যায়। অনুমান করা হয় প্রাচীন কালে শিকার থেকে ফিরে অভিনয় করবার সময় মৃত পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে নিত অভিনেতারা। মাথায় বেঁধে নিত মৃত পশুর শিং। প্রাচীন গুহাচিত্রে মানুষের মুখোশ পরিহিত ছবি দেখা গেছে। এভাবে চলতে চলতে কিছু পরে পাথরের তৈরি মুখোশ দিয়ে ঢেকে দিত মুখ। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে মুখোশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে চামড়া, পাথর, কাঠ, বা কোনও ধাতু। মুখোশ পরে নাচ, অভিনয় অপার্থিব কোনও শক্তির আরাধনা।
কোচবিহারে প্রচলিত আছে ‘চণ্ডি নাচ’। ‘চণ্ডি নাচ’ নামে তার পরিচয় হলেও এ আদতে নৃত্যাভিনয়। বাংলা চৈত্র মাসের শেষে অর্থাৎ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার পুঁটিমারী অঞ্চলে ছেলেরা শোলার তৈরি মুখোশ বেঁধে গাঁয়ের ঘরে ঘরে মাগন সংগ্রহ করে বেড়ায়। শোলা একটি জলজ উদ্ভিদ। সেই উদ্ভিদ মালাকারেরা সংগ্রহ করেন এবং মুখোশ, ফুল, প্রতিমার গয়না, বিয়ের মুকুট ইত্যাদি সামগ্রী তৈরি করেন।
চণ্ডি নাচের আয়োজন করেন একজন ‘মারেঞা’ (প্রধান আয়োজক, সভাপতি, দলপতি, পরিবারের প্রধান ‘মারেঞা’ উপাধিতে পরিচিত হন)। তিনিই আর্থিক দায়িত্ব বহন করেন। দলের খরচও তাঁর। কোনও কোনও মারেঞা প্রতিবছর নিয়মিত এই আয়োজন করেন। কারুর মানসিক থাকলে চণ্ডি নাচের ব্যবস্থা করেন।
চৈত্র মাসের শেষ সাতদিন বা দশদিন একজন মুখোশ বেঁধে পোশাক পরে চণ্ডির রূপ ধারণ ক’রে ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে নেচে নেচে ঘুরে বেড়ান গাঁয়ের পথে পথে। প্রতিটি গৃহস্থের কাছে যান নৃত্য পরিবেশন করেন ও মাগন সংগ্রহ করেন। নাচের দলে তিন থেকে চারজন থাকেন। চণ্ডি, ঢাকি, ভারী, শিব। ঢাকের বোলের সঙ্গে শিব ও চণ্ডি নৃত্যাভিনয় করেন। গৃহস্থ ভক্তিভরে দান করেন। তা ভারীর সঙ্গে থাকা ঝোলায় জমা হয়। মাগন সংগ্রহ শেষ ক’রে চৈত্র মাসে শেষ দিন গ্রামের কোনও কালী মন্দিরে বা মারেঞার বাড়িতে তাঁর তত্ত্বাবধানেই ধূমধাম ক’রে পুজো হয়। সেই গ্রামের সমস্ত অধিবাসী তাতে অংশগ্রহণ করেন। সকলের জন্য খিচুরী প্রসাদ তৈরি হয়, প্রত্যেকেই তা গ্রহণ করেন। চণ্ডি নাচের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন জাদু বিশ্বাস ও তান্ত্রিক পদ্ধতি।
চণ্ডি নাচ আচার ধর্মী অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে আচার কেন্দ্রিক আয়োজনটুকুই হয়। কিন্তু চণ্ডি নাচের মঞ্চ উপস্থাপনা যথেষ্ট আকর্ষণীয় ও নাট্য উপকরণ সমৃদ্ধ। চণ্ডি নাচের চরিত্র চন্ডি, শিব, ডাকিনি, যোগিনি, শৃগাল ও অসুর। এখানে উপস্থাপিত হয় চন্ডি রূপে দেবশত্রু দৈত্য বিনাশের কাহিনি। কেবল মাত্র ঢাকের বাদ্য আবহ রূপে ব্যবহার করা হয়। কোনও সংলাপ বা গীত থাকে না।
দেবী চণ্ডির উল্লেখ পাওয়া যায় মার্কেন্ডয় পুরাণে। তিনি লোকদেবী। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িষা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী চণ্ডির অনুষ্ঠান ও পুজো প্রচলন আছে। প্রচলিত আছে মঙ্গল কাব্য। চণ্ডি মঙ্গল কাব্য দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। কবিকঙ্কন মুকুন্দ বিরচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল পরিচিত। চণ্ডি নাচে সাধারণত পুরুষ শিল্পীরাই অংশ গ্রহণ করেন।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team