দশ বছরে পা রাখল ‘এখন ডুয়ার্স’, বিশ্বাস করাটাই কঠিন। এই তো সেদিন টিম টিম করে ছোট্ট টিম নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা। অচিরেই কলকাতা থেকে সম্পাদকীয় দপ্তর নিয়ে আসা হলো উত্তরের সাংস্কৃতিক ভাবনা ও কর্মকান্ডের সদর জলপাইগুড়িতে। উত্তরের সমমনস্ক মানুষগুলি যাতে এক ছাদের তলায় বসে রাজনীতির সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে নিজেদের মৌলিক ভাবনাচিন্তা আরও সংহত করতে পারেন, সেইসঙ্গে যারা এককালে লেখালেখি গানবাজনা থিয়েটার কিংবা সাংগঠনিক কিছু করবার কথা ভাবতেন তারপর জীবনের ঘুর্ণিপাকে হারিয়ে যাচ্ছিলেন তাদেরকে টেনে আনবার জন্য শুরু হলো নতুন উদ্যোগ ‘আড্ডাঘর’। জনপ্রিয়তার বহর অনুমান করে পত্রিকা মাসিক থেকে পাক্ষিক হলো। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার নানান বৃত্তের বাইরেও এই অনালোকিত উত্তরে বহু গুণী মানুষ আছেন যাদের কথা কেউ কখনও সোচ্চারে কলকাতার কফিহাউসে ট্রামরাস্তায় কিংবা ময়দানে বলেনি, তাদের কথাই লিখতে শুরু করলো ‘এখন ডুয়ার্স’। এমন সব মানুষকে আবিস্কার করা হলো যারা এর আগে কলম ধরবার কথা কখনও ভাবেননি অথচ তাঁদের ভেতরে লুকিয়ে ছিল দুর্মূল্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার রাশি রাশি সম্পদ। ফলে যেটা হলো, কলমচর্চার জন্য কিংবা নিজের বই প্রকাশের জন্য আর সুদূর রাজধানী কলকাতার প্রকাশকের মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না– এই বার্তা উত্তরের কোনে কোনে পৌঁছতে দেরি হলো না।
এরপর ‘এখন ডুয়ার্স’ আবার পাক্ষিক থেকে মাসিক হলো, যার মূল কারণ অর্থ কিংবা বিজ্ঞাপনের অভাবের চাইতেও বেশি ছিল উত্তরে নিয়মিত নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখকের খরা ও সার্কুলেশনের দুর্বলতা। ফলে উত্তরের কারেন্ট অ্যাফেয়্যার্স ম্যাগাজিনের পরিচিতি পালটে এবার ধীরে ধীরে সাহিত্যধর্মী পত্রিকা হয়ে উঠল ‘এখন ডুয়ার্স’। এতে অবশ্য পত্রিকার ইমেজে ন্যুনতম আঁচড় লাগেনি, বরং ‘এখন ডুয়ার্স’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হতে থাকল উত্তরের লেখক-কবিদের গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের গুণমানে যেসব বই কলকাতার নামী প্রকাশনাকেও টেক্কা দিতে পারে। ‘এখন ডুয়ার্স’ পরিচালিত ‘প্রথম ডুয়ার্স সাহিত্য উৎসব’ টনক নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল বৈকি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এরপরই এলো দুঃসহ কোভিডকাল, এসে দুরন্ত গতিতে বেড়ে ওঠা এই চারা গাছটির দফারফা করে দিল। ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে গেল তিলে তিলে গড়ে ওঠা পত্রিকার নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক। কলকাতায় পত্রিকা ছেপে ডুয়ার্সের প্রত্যন্তে পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়াটাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াল। এর ফলে করোনাকালে পত্রিকার যে অনলাইন ভার্সনটি শুরু হয়েছিল সেই উদ্যোগই অবশেষে পুরোপুরি মাসিক অনলাইন ওয়েব ম্যাগাজিনে পরিণত হলো। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এই অনলাইন পত্রিকা থেকেই বাছাই লেখা নিয়ে বছরের শেষে বইমেলার মরসুমে বের হবে বাৎসরিক মুদ্রিত সংকলন, প্রিয় পাঠক বন্ধুরা যার কপি জেলা বইমেলা থেকে কিংবা অনলাইন অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করতে পারবেন অনায়াসে।
এই দশটা বছর কেমন গিয়েছে আমাদের উত্তর বাংলার, আমাদের বঙ্গ রাজ্য কিংবা আমাদের দেশের? কতটা এগিয়েছি কিংবা পিছিয়ে গিয়েছি আমরা? কী পরিবর্তন আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলেরই সম্ভবত কমবেশি জানা। আগামী দিনগুলি আমাদের কেমন যাবে তার ছবিও কেউ কেউ অনুমান করবার ক্ষমতা রাখেন। তাঁরা জানেন, অদূর ভবিষ্যতে পাঠ্য সিলেবাসের বাইরে বাংলা বই কিংবা পত্রপত্রিকার পাঠক আরো কমবে। কারণ বঙ্গ নামক অঙ্গদেশে লেখাপড়া জানা বাংলাভাষীর সংখ্যা অতিদ্রুত হ্রাসমান। নবীন প্রজন্ম যারা বাংলায় টুকটাক লিখছেন, গপ্পো উপন্যাস কিংবা ফিচার যাই লিখুন, তাঁরা পুরনোদের সম্পর্কে জানতে যেমন অনাগ্রহী, তেমনই দেশ কিংবা বিদেশের আধুনিক লেখালেখি নিয়ে তাঁদের সামগ্রিকভাবে উদাসীনতা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ধ্রুপদী সাহিত্যের কথা না হয় আপাতত বাদই দিলাম, কারণ কালের অমোঘ নিয়মেই ধ্রুপদী অনুসারীদের সর্বশেষ প্রজন্মও স্বল্প দিনের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু তাঁর বাইরে অধুনা বিশ্বে কী ধরণের ফিকশন বা নন-ফিকশন চর্চা চলেছে তা নিয়ে সাহিত্যের শিক্ষক বা ছাত্রছাত্রীরাই আদৌ কতোটা উৎসাহী সে নিয়ে কিন্তু এক বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন থেকে যায়। যেমন বিশাল প্রশ্ন ওঠে সাংবাদিকতার কিংবা কবি সাহিত্যিকদের মেরুদণ্ডের বলিষ্ঠতা নিয়ে, সরকারি স্তরে যাবতীয় অনাচার-অন্যায়ের পরেও তাঁদের আশ্চর্য নীরবতা নিয়ে।
আসলে আমরা সবাই মেতে আছি আমাদের এই করুণ কঠিন পরিস্থিতির কাটাছেঁড়া নিয়ে, একে অপরকে দোষারোপের হাস্যকর বিপণনে। এই পঙ্কিল নর্দমা থেকে উত্তরণের পথ বাতলানোর মতো আমাদের দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন কেউ নেই। গত এক দশকে দুনিয়া জুড়ে আবহাওয়ার উষ্ণতার মতোই বেড়েছে হিংসা-দ্বেষ-ঘৃণা-অবিশ্বাস-অসহিষ্ণুতা। আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে আজ চরম উদবিগ্ন দেশনেতারা বসছেন এক টেবিলে আলোচনায়, কিন্তু মানুষে মানুষে ব্যাপক ঈর্ষা বা হিংসা রোধে তাঁদের মাথাব্যথা কতটুকু রয়েছে? হিংসামুক্ত পৃথিবীর কথা শুনিয়ে গিয়েছেন যে মহাপুরুষেরা, তাঁদের ছবি দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে কিংবা তাঁদের বিশাল মূর্তি স্থাপন করে আজকের শাসক টিকে থাকে স্রেফ হিংসার রাজনীতি করেই, এ সত্য আজ আর কি কারো অজানা? কিন্তু তবু এত অন্ধকার কেন প্রভু? এসময় যদি কোনও মসীহা না-ই পাঠাতে পারো আমাদের উদ্ধারের জন্য তাহলে অন্তত কিছু আলো দাও অন্তরে। যে আলো ফিরিয়ে আনবে আমার প্রতিবেশীর প্রতি হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে, যে আলোয় সাফ হয়ে যায় সব বিদ্বেষকণা। আরেক নতুন বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজ যদি আগত দিনের দিকে তাকিয়ে বিধাতার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে হয়? তবে কি শুধু এটুকুই চাওয়া আমাদের?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team