ডুয়ার্সের নানা জনজাতির মধ্যে অন্যতম লুপ্তপ্রায় উপজাতি হলো অসুর। অসুরেরা মূলত ঝাড়খন্ড-বিহারের আদি জনজাতি। এখন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা বাগানে এই অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সম্প্রতি নিমতি চা বাগানের কয়েক ঘর অসুরের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের জীবনের বেশ কিছু তথ্য উঠে এলো।
বাগানের ডাইরেক্টরস বাংলো পেরিয়ে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গেলে শুরু হলো লেবার লাইন। সরু রাস্তার দুপাশে যতগুলো বাড়ি দেখা যায় সবই অসুর সম্প্রদায়ের। এদের সম্পর্কে জানার অসীম কৌতুহল নিয়ে যখন বাগানের অসুর লাইনে গেলাম, রূপেশ বির্জিয়া এগিয়ে এসে হাতজোড় করে নমস্কার জানালো। আশেপাশের ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে ও দরজার ফাঁক দিয়ে আরও অনেক কৌতূহলী মুখ উঁকি দিচ্ছে বুঝতে পারছি। প্রতি নমস্কার জানিয়ে রূপেশকে বললাম, আজ তোমাদের কথা জানবো এবং অনেক গল্প করবো বলে এসেছি। চওড়া হাসি হেসে রূপেশ ভেতরে যেতে যেতে হিন্দীতে বললো, কুর্সি নিকালো। দুটো মাঝারি উচ্চতার ছেলে ঘর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এসে উঠোনে রেখে ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বসতে বললো। বাড়ির চারপাশে গাঁদা, টগর, জবা ফুলের গাছ যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে।
"তোমরা তো শুনেছি দেবতার পূজায় বিশ্বাসী নও রূপেশ!"
বলতে না বলতেই উঠোনের একপাশে তুলসী গাছ ও তার পেছনে ছোট্ট শিব মন্দিরটার দিকে চোখ চলে গেল। আমার চোখমুখের বিস্ময় রূপেশেরও নজর এড়ায় নি। বললো, না, আমরাও পুজো করি। সামনের আরেক ঘর থেকে রঞ্জিত এবং তার বউ রূপান্তী অসুরও বের হয়ে এসেছে। জানতে পারলাম ওদের পূর্বপুরুষরা যখন প্রথম বাগানে এসেছে ওদের মধ্যে পূজা পাঠের প্রচলন ছিলো না। পরবর্তী সময়ে পূজা শুরু করে। কিন্তু স্থানাভাবে সেই পূজা হতো পাকঘরে। কিন্তু এখন ওরা কয়েকঘর মিলে বাড়ির লাগোয়া একটা শিব মন্দির বানিয়েছে। বললাম, দেবতা তো অসুরের শত্রু, তার পূজা করছো? একটু ইতস্তত করে বললো, রূপেশ এবং রঞ্জিত দুজনের বাবা কখনো দুর্গাপূজায় বের হতেন না। পুজোর সময়ে কালো কাপড়ের টুকরো ঘরের বাইরে ঝুলিয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে ঘরে পড়ে থাকতেন। পুজোর শেষে নদীতে স্নান সেরে কাজে ফিরতেন।
তবে এসবে এখন আর তাদের বিশ্বাস নেই। তারা দুর্গা পূজাতেও বের হয়, বিভিন্ন মন্ডপে যায়। ছেলেদের আবদারে এখন তারা পুজোতে শুধু যে বের হয় তাই না, নতুন জামাকাপড় ও কেনে। পুজোয় বিভিন্ন ফাংশনে তাদের মধ্যে অনেকে গান বেঁধে গান গায়। তিটুসমা টোপ্পো (অসুর) পুজোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে থাকেন। তার রচিত "মালাইয়া আবুরে বুঝাইয়া আবু" গানটা অসুর সমাজে খুব জনপ্রিয়। গানটার মানে জানতে চাইলে রূপান্তী বলে ওঠে, কোনো মেয়ে হয়ত বিপথগামী হচ্ছে, তাকে যাতে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক রাস্তায় নিয়ে আসা হয় সে উদ্দেশ্যেই এই গান বাঁধা হয়েছে।
রূপান্তী অসুরের বিয়ের উপযোগী ছেলে আছে। জানতে চাইলাম বউয়ের মধ্যে কী কী গুণ দেখতে চাও? রূপান্তী, রঞ্জিত সম্মিলিত ভাবে উত্তর দিলো, ঘরের কাম জানতে হবে, সংস্কারী হতে হবে। সংস্কারী মানে? একটু ভেবে রূপান্তী উত্তর দেয় বিয়ের পর শাড়ী ছাড়া অন্য কিছু পড়বে না, ঘরের বাইরে একা বের হবে না, শ্বশুর-শাশুড়ীর দেখভাল করবে। রূপেশ অসুরের ছেলেমেয়েরা সবাই নিমতি হাইস্কুলে পড়ে। স্বপ্ন দেখে স্কুলের পাঠ চুকলে ছেলেরা কলেজে যাবে। মেয়েদের একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার রীতি। মেয়েদের উপার্জনক্ষম করে তোলার রেওয়াজ বিশেষ নেই বললেই চলে।
রূপেশ বির্জিয়া (অসুর), ও রঞ্জিত বির্জিয়ার সাথে কথা বলে জানা গেল প্রায় ৭৫ বছর ধরে এই বাগানে তাদের বসবাস। ঝাড়খন্ড থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা চা বাগানে এসেছিল। এখন তারা ভীষণ ভাবে নদী, পাহাড়, চা বাগানের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। তাদের নিজস্ব ভাষার বদলে সাদ্রী ও হিন্দী মিশিয়ে তারা কথোপকথন চালায়। তাদের অনেকে এখন অসুর পদবীর বদলে টোপ্পো পদবী ব্যবহার করছে। কিন্তু রূপেশ, রঞ্জিত এবং তাদের ছেলেরা পদবী বদলাতে নারাজ।
জানা গেল, অসুর সমাজের ছেলে যদি অন্য জাতের মেয়ে বিয়ে করে তাহলে পন্ডিত দিয়ে পুজো করে তাকে অসুর সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে তারপর বউ হিসেবে ঘরে তোলা হবে। তাদের সমাজে সম্পত্তির অধিকার এখনোও ছেলের। যদি দু'জন স্ত্রী থাকে তাহলে প্রথম স্ত্রীর পুত্রের সম্পত্তির মালিক হবে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে পুত্রের সন্তান না থাকলে দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। তাদের রোজকার খাবারে মধ্যে চাওল(চাল), ডাইল(ডাল), উতু(মাছ) থাকলেও চৌররুটি তাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
অসুর সম্প্রদায়ের কিছু নিজস্ব পুজো আছে। কথিত আছে একবার কলেরায় অসুর সম্প্রদায়ের বহুজন মারা যায়। অসুরদের ধারণা হয় তারা প্রকৃতির রোষে পড়েছে। প্রকৃতিকে তুষ্ট করতে একটি জিতিয়া গাছের পুজো তারা শুরু করে। যেটি সারণা পুজো নামে প্রচলিত। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে এই পুজো হয়। সকালে স্নান করে দলে দলে তারা ফলমূল নিয়ে যায় এবং উপোস থেকে জিতিয়া গাছের পূজো করে। প্রত্যেক বছর ভালাই চাল উঠলে তারা চিড়া, ভাত বানিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করে। এই পুজো নাওয়াখানি নামে পরিচিত। কার্তিক মাসে গোয়ালের গোরু, বাছুর রাতে কোনো রোগ, ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয় সেইজন্য অসুর সম্প্রদায় গোহালী পুজো করে থাকে। এছাড়া ফাল্গুনী পূর্ণিমায় তিনদিন ধরে পূর্বপুরুষদের পুজো করার রীতি চালু আছে অসুর সমাজে। তাদের বিশ্বাস এতে তাদের পরিবারকে পূর্বপুরুষরা সুরক্ষিত রাখবে। এই পুজো হোলি পুজো নামে পরিচিত।
অসুর সমাজে শিকার প্রথা ভীষণভাবে প্রচলিত ছিল। তারা দল ধরে শিকার ধরতে যাওয়ার আগে বনদেবীর পুজো করতো। তাদের বিশ্বাস এই পুজো করে শিকার ধরতে বের হলে তারা শিকার পাবে এবং কেউ আহত হবে না। এই পুজো শিকারী পুজো নামে পরিচিত। বছরের প্রথম ধান যখন অসুরেরা লাগায় তখন সেই ধানের বীজ তারা মা লক্ষ্মীকে অর্পণ করে প্রার্থনা করে বলে এ ধান সুন্দর হোক। অসুর সমাজে এ পুজো বনগারি পুজো নামে পরিচিত।
তবে ক্ষোভ তো তাদের মনের কোনে আছেই। অসুরদের সবচেয়ে বড় ক্ষোভ সমাজে এখনও তারা ব্রাত্য। তারা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশতে চাইলেও আমরা তাদের অসুর বলে আলাদা করে রেখেছি। তবে আজকের দিনে তারা অনুভব করে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সন্তানকে যে কোনো মূল্যে তারা স্কুলে পাঠায়। তাদের একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। তবে কন্যা সন্তানকে নিয়ে চিন্তা এখনও কিছুদিন স্কুল এবং তারপরেই বিয়ে এই চিন্তার মধ্যেই আবদ্ধ। আমার মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানোর দায় খানিকটা শিক্ষিত, প্রগতিশীল সমাজের প্রতিও বর্তায় বৈকি! সমাজের একটা শ্রেণী অনগ্ৰসর থাকলে, তাদের বোধবুদ্ধির বিকাশ না ঘটলে তা সমগ্ৰ দেশের অগ্ৰগতিকেই রোধ করে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team