পুরাণের কাহিনিকারেরা তাঁদের সৃষ্ট অসংখ্য চরিত্রের কথা প্রথমে এমনভাবে লিখেছেন যাতে মনে হয় সম্পূর্ণ কাহিনিতে তাঁদের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কাহিনি যত এগিয়েছে ধীরে ধীরে কমেছে তাঁদের গুরুত্ব। একেক সময় তো রীতিমতো উপেক্ষা করেছেন কাহিনিকার তাঁদেরকে।
রামায়ণেও এমন অনেক চরিত্র আছে যারা উপেক্ষিত। অথচ মূল কাহিনিতে তাঁরা আসলে অনুঘটকের কাজ করেছে। গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখা যাবে এই সব চরিত্রের অবতারণা না ঘটলে মূল কাহিনীতেও প্রবেশ করা যেত না।
রামায়ণের মন্থরা তেমনই এক চরিত্র, উপেক্ষিত, অবহেলিত। রাজা দশরথের তিন স্ত্রী কৌশল্যা, সুমিত্রা আর কৈকেয়ী। তৃতীয়জন সবচাইতে প্রিয় যেন রাজার সুয়োরানী। বিয়ের সময় আরও অজস্র যৌতুকের সঙ্গে তাই মন্থরাও চলে এল কৈকেয়ীর সঙ্গে নিজের ঘরদোর ছেড়ে। কৈকেয়ীর প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অপরিসীম।
তাঁর চেহারার সঙ্গে চরিত্রেরও মিল রেখেছেন কাহিনীকার। কুব্জা, বক্রদেহী, বিকৃতরূপের মন্থরা স্বভাবেও ঈর্ষাপরায়ণ আর কুবুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন। শুধুমাত্র কৈকেয়ীর ভালোমন্দের দিকেই তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর।
রামায়ণের প্রথমদিকে মন্থরার কথা তেমনভাবে কোথাও বলা নেই। মন্থরাকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় আমরা দেখি যখন রাজা দশরথ তাঁর বড় ছেলে রামকে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখানে লক্ষণীয় রামের বদলে ভরতের রাজা হওয়ার কথাও তাঁরই প্রথম মাথায় আসে। এমনকী কৈকেয়ীর মনেও তিনিই প্রথম ঈর্ষার বীজ বোপন করে দিতে সক্ষম হন। রামের রাজ্যাভিষেকের খবর কৈকেয়ীর মনে আনন্দের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। এতদিন কৈকেয়ী সপত্নী পুত্র রাম ও নিজের সন্তান ভরতের মধ্যে কোনো বিভেদ করেননি। মন্থরাই প্রথম জানান যে রাম রাজা হলে ভরতেরও যেমন রাজ্যে কোনো গুরুত্ব থাকবে না তেমনি কৌশল্যার কাছেও কৈকেয়ী হেরে যাবেন। মন্থরার কুমন্ত্রনা ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত কৈকেয়ী সম্পূর্ণরূপে মন্থরার কুবুদ্ধিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। মন্থরা কৈকেয়ীকে বারবার দশরথের দিতে চাওয়া দুটো বরের কথাও মনে করান।
অবশেষে কৈকেয়ী রাজি হলেন দশরথের কাছে নিজের প্রাপ্য দুটো বর চাওয়ার জন্য। প্রথম বরে ভরতের রাজ্যাভিষেক আর দ্বিতীয় বরে রামের চোদ্দ বছরের বনবাস। আর এসবই যে ঘটেছিল কুব্জা মন্থরার বুদ্ধিতেই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মন্থরা জটিলা, কুটিলা, ঈর্ষাপরায়ণ, কুচক্রী কিন্তু এখানে ভাবার বিষয় এটাই যে তিনি কিছুই নিজের জন্য চাননি। দাসী জন্মের থেকে কোনো উত্তরণের আশা তাঁর ছিল না। হয়ত ভরত রাজা হলে আর কৈকেয়ী রাজমাতার মর্যাদা পেলে দাসী হিসেবে হয়ত অন্যান্যদের চোখে একটু মান্যতা পেতেন তিনি, কিন্তু এর চাইতে বেশি তাঁর পাওয়া বা চাওয়ার কিছু ছিল না। সবটাই তিনি করেছেন কৈকেয়ীর প্রতি অপত্য স্নেহের বশবর্তী হয়ে।
রামের রাজ্যাভিষেকের ঘটনায় কিছু বিতর্ক রয়ে গিয়েছে। যেমন কৈকেয়ী রাজার প্রিয় রাণী হলেও তাঁর পুত্র ভরতকে কখনোই রাজসিংহাসনে বসানোর কথা ভাবেনি রাজা দশরথ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রথম এবং একমাত্র পছন্দ ছিল জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম। রামের রাজ্যাভিষেকের সিদ্ধান্ত খুব তড়িঘড়িই নেওয়া হয়, জানতে পারেন না প্রিয় পত্নী কৈকেয়ীও। এমনকি কৈকেয়রাজ (কৈকেয়ীর পিতা)কেও রাজ্যাভিষেকের সময় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাজ্যভিষেক এমন সময় করার কথা ভাবা হয় যখন ভরত তাঁর মাতুলালয়ে। তবে কি দশরথ আঁচ করেছিলেন কিছু? বুঝতে পেরেছিলেন বাধা কোন দিক থেকে আসতে পারে? নাকি দশরথ ভয় পেয়েছিলেন কৈকেয়ীর বুদ্ধিদাত্রী মন্থরাকে? মন্থরার মতো নারীরা জানে কীভাবে বিভেদ সৃষ্টি করতে হয়, রূপ দিয়ে নয় মুখ দিয়ে অসাধ্যসাধন করে এঁরা। কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, মন্থরার কানে খবরটা চলেই যায়। রাণীদের আগেই মন্থরা জেনে যান রামের রাজ্যাভিষেকের কথা।
এরপরই বলতে গেলে মূল রামায়ণ শুরু হয়। রামায়ণের নিয়ন্ত্রকই আসলে মন্থরাই। মহাকাব্যে তাঁর উপস্থিতি সামান্যই কিন্তু মন্থরার উপস্থিতি না থাকলে হয়ত রামের বনবাসও হত না, রাবণ সীতাকে হরণও করত না আর রামের দ্বারা রাবণের মৃত্যুও ঘটত না।
কাহিনীকার খুব যত্নের সঙ্গেই এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। চেহারা ও স্বভাবে এমন বানিয়েছেন যাতে পাঠকের মনের ঘৃণার সঞ্চার হয়। মন্থরা তাঁর চেহারার জন্য চিরকালই বিদ্রুপের পাত্র, উপহাসের পাত্র। ঘটনাক্রমে পরবর্তীতে তিনি হলেন সকলের ঘৃণার পাত্রও। রামায়ণের অন্যতম খলনায়িকা তিনি। যদিও খুব কম কথাই তাঁর পেছনে খরচ করেছেন কাহিনীকার। পরবর্তীতে আরও একবার মন্থরার কথা পাওয়া যায় যখন শত্রুঘ্ন সব জানতে পেরে মন্থরাকে আঘাত করেন।
তবে মন্থরার চরিত্র পর্যালোচনা করলে অনেক উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন কেন তিনি এত ঈর্ষাপরায়ণ? শুধু কি চেহারার জন্য বিদ্রুপের শিকার এই কারণেই তাঁর এত রাগ নাকি শুধুমাত্র কৈকেয়ীর প্রতি তাঁর অন্ধ স্নেহ? এসবের কোনো খোঁজ দেননি লেখক।
পুরানের মন্থরার জন্মের একটি কাহিনী বেশ প্রসিদ্ধ। আমরা সবাই জানি, বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে রাম হল সপ্তম। মূলত দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করার জন্যই তাঁর মর্ত্যে আগমন। গীতাতে বলাই আছে
‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত অভ্যুত্থানম অর্ধমস্য তদাত্মানম সৃজাম্যহম। পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’
কিন্তু রামের জন্মের পর সবকিছু ঠিকঠাক চললেও রামের রাজা হওয়ার খবরের দেবতারা ভয় পেয়ে যান। তাঁদের মনে হয় রাম রাজা হয়ে তাঁর জীবন হয়ত বিলাস ব্যসনেই কাটিয়ে দেবেন। তখন স্বয়ং বিষ্ণু দেবী সরস্বতীকে সম্পূর্ণ বিষয়টি জানান। দেবী সরস্বতী সবটা শুনে নিজে মন্থরা রূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তারপর তাঁর দ্বারাই পরোক্ষভাবে রামের বনবাস ঘটে, অবশেষের দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হয়, এবং বিষ্ণুর সপ্তম অবতার ব্যর্থ হয় না।
পুরাণমতে আমাদের জিভেই সরস্বতীর বাস, অর্থ্যাৎ জ্ঞানের বাস। জ্ঞান না থাকলে কে আর কিছু বলতে পারে? এইকারণেই অনেকেই বিশ্বাস করেন যে স্বয়ং দেবী সরস্বতীই মন্থরা হয়ে কৈকেয়ীর কানে এমন কিছু কুমন্ত্রণা দিয়েছিলেন যার জন্যই এই মহাকাব্য রচিত হল নয়ত আমরা এতদিনে হয়ত অন্য কোনো গল্প পেতাম। সেখানে কি রাবণ বধ আদৌ সম্ভব হত? কে জানে?
মন্থরা আসলে অনুঘটক, যা মূল ঘটনাকে চালিত ও নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তাই মহাকাব্যে মন্থরার উপস্থিতি স্বল্প হলেও পুরাণের পাতায় তাঁর নাম জ্বলজ্বল করে। তবে তা সুখ্যাতি না কুখ্যাতিতে তার বিচার এখনো বাকি আছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team